মাজেদা খাতুন। বয়স ৫০ বছর। থাকেন রাজধানীর উত্তরার আজমপুরের মাটির মসজিদ এলাকায়। অল্প
বয়সে বিয়ে হওয়াতে স্বামী-সংসার এবং সন্তান সম্পর্কে তার তেমন ধারণাই ছিল না। প্রথম সংসারে চার ছেলে-মেয়ে জন্ম নেয়ার পর স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে বাবার বাড়ি উত্তরায় চলে আসেন। স্কুলের গণ্ডি না পেরোলেও পরবর্তীতে জীবিকা নির্বাহে মাজেদা খাতুন উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে আয়ার কাজ নেন। এদিকে মার্কিন নাগরিক রবার্ট মাইরন বার্কার পেশায় একজন উন্নয়নকর্মী হওয়ার সুবাদে এক দুস্থ নারীকে চিকিৎসা করাতে ওই হাসপাতালে যান। এ সময় দুস্থ নারীর ছেলে সন্তান হওয়ার পরে রবার্টের কাছে মাজেদা খাতুন সম্মানী দাবি করেন।
মাজেদাকে রবার্ট চার হাজার টাকা দেয়ার পরে বাচ্চা কোলে তুলে দেন। এভাবেই তাদের প্রথম পরিচয়। পরবর্তীতে কারণে-অকারণে রবার্ট মাজেদার কর্মস্থলে এসে হাজির হতেন। মাজেদাকে কখন যে মন দিয়ে বসেন এই মার্কিন নাগরিক তা নিজেও হয়তো জানতেন না! মাজেদার কর্মস্থলের সিনিয়র স্টাফ নার্সের সঙ্গে মাজেদাকে ভালো লাগার কথা খুলে বলেন রবার্ট। ততদিনে বরার্ট বিভিন্নভাবে বাংলা ভাষা রপ্ত করে নিয়েছেন।
ছয় থেকে আট মাসের মাথায় মাজেদা-রবার্ট সিদ্ধান্ত নেন তারা বিয়ে করবেন। তাদের উভয়ের প্রথম সংসারে চারজন করে ছেলে-মেয়ে রয়েছে। রবার্ট ছিলেন বিপত্নীক। ছেলে-মেয়েরা থাকেন মার্কিন মুল্লুকে। এদিকে মাজেদার ছেলে-মেয়ে ছোটো হওয়াতে তারা কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি। । ২০১৪ সালের ১লা এপ্রিলে ঢাকার বাড্ডার একটি গির্জায় রবার্টের সঙ্গে মাজেদা খাতুনের বিয়ে হয়। সুখেই দিন কাটছিলো মাজেদা-রবার্ট দম্পতির। বিদেশ থেকে আসা অর্থ দিয়ে কখনো ক্রয় করে, কখনো বা মাজেদা নিজের হাতে রান্না করে বড় গাড়িতে খাবার নিয়ে অসহায় মানুষদের খায়িয়েছেন। কিন্তু রবার্টের মৃত্যুর পর এখন মাজেদা খাতুনের নিজেরই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। মাজেদার সঙ্গে তার উত্তরা আজমপুরের চালাবন মাটির মসজিদের বাসায় কথা হয়। তিনি বলেন, ভালোবেসে বিয়ে করলাম। ভালোবাসার জন্য নিজ ধর্ম ত্যাগ করলাম। কিন্তু সংসারের সুখ বেশিদিন কপালে সইলো না। আমার জন্য রবার্ট ওর বাংলাদেশে থাকা বসের সঙ্গে হাতাহাতি পর্যন্ত করেছে। আমার আগের সংসারের ছেলে-মেয়েকে বড্ড আপন করে নিয়েছিলেন রবার্ট। ওর ডাক নাম বব। আমি ওকে বব বলেই ডাকতাম। জীবদ্দশায় কোনো চাওয়াই অপূর্ণ রাখেনি। ছেলে-মেয়েদের যাবতীয় খরচ সে চালাতো। আর আমার সন্তানেরাও তাকে নিজের বাবার মতোই আপন করে নিয়েছিলো। ববকে নিয়ে অভিনেত্রী পূর্ণিমার বাসায় ভাড়া থেকেছি। আরো কত কি স্মৃতি! বব ছিলেন বরাবরই স্বাস্থ্য সচেতন। সকালে উঠে নিজে নিজেই ওজন, রক্তচাপসহ যাবতীয় পরীক্ষা করে কাজে বের হতেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে ২০১৮ সালের ১৫ই মে দক্ষিণ খানের কেসি হাসপাতালে ভর্তি হন বব। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ দিন পর তিনি মারা যান। সে সময় তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। পরবর্তীতে হাসপাতালের বিল আসে দেড় লাখ টাকা। বব মারা যাওয়ার পরে আমি চারদিকে অন্ধকার দেখছিলাম। আমার জন্য সে তেমন কিছুই রেখে যায়নি। আমিও এসব বিষয়ে কখনো চিন্তা করিনি। মাজেদা খাতুন বলেন, পরবর্তীতে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে না পারায় আমাকে তিনদিন হাসপাতালের ভেতরেই আটকে রাখে। আমার বিরুদ্ধে মামলা করে। তখন ববের মরদেহ সেখানেই ছিল। পরবর্তীতে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পাঠানো হয়।
তিনি বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে আমি ববের মরদেহ আমেরিকায় তার ছেলে-মেয়েদের কাছে পাঠাতে অ্যাম্বাসিতে (দূতাবাসে) যাই। অনেক ঘোরাঘুরির পরে অ্যাম্বাসির পক্ষ থেকে ববের পাসপোর্ট চাওয়া হলে আমি দিয়ে দেই। কিন্তু এরপর থেকে আর তারা আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। মাজেদা খাতুন বলেন, আমার তো বয়স হয়েছে। করোনার কারণে ছেলেদের কাজ নেই। বড় ছেলে একটি ছোট্ট চায়ের দোকান চালায়। দোকান থেকে যা আয় হয় তা দিয়েই কোনোভাবে বেঁচে আছি। সাড়ে তিন হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতে হয়। তিনি বলেন, আমার একটিই চাওয়া, ববকে হাসপাতালের মর্গে না রেখে হয় আমাদের দেশে অথবা নিজ দেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার পরিবারের কাছে সমাধিস্থ করা হোক। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা তার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আগে যোগাযোগ করলেও এখন তাদের থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন আমি। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বব নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, আড়াই বছর ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে তার লাশ পড়ে আছে। বিদেশি নাগরিক হওয়ায় তার লাশ এই দেশে সমাধিস্থ করা যাচ্ছিল না। এক্ষেত্রে মার্কিন দূতাবাসের ছাড়পত্র প্রয়োজন। সেটাও পাইনি। ববের এই অসম্মান আমি আর সইতে পারছি না। এ বিষয়ে দক্ষিণ খান থানায় ইতিমধ্যে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী বব যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এবং তার পাসপোর্টে ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের একটি ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেন, এখনো মার্কিন নাগরিক রবার্টের মরদেহটি আমাদের কাছ থেকে নিচ্ছেন না তারা। হাসপাতালের ফ্রিজে এখনো লাশটি পড়ে আছে। এতে আমাদের মর্গের ফ্রিজের ক্ষতি হচ্ছে। এবং আমাদের দৈনন্দিন ময়নাতদন্তের কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। যেহেতু তিনি বিদেশি নাগরিক তাই আমেরিকান দূতাবাসকে এ বিষয়ে উদ্যোগ এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে।