ম. আমিনুল হক চুন্নু: রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘মানুষের সত্তায় দ্বৈধ আছে’। তার যে সত্তা জীব সীমার মধ্যে সেখানে যে টুকু আবশ্যক সেই টুকুতেই তার সুখ। কিন্তু অন্তরে অন্তরে জীবমানব বিশ্ব মানবে প্রসারিত; সেই দিকে সে সুখ চায় না, সে সুখের বেশি চায়, সে তোমাকে চায়। তাই সকল জীবের চেয়ে মানুষই কেবল অমিতাচারী। তাকে পেতে হবে অমিত, তাকে দিতে হবে অমিত, কেননা তার মধ্যে অমিত মানব। সেই অমিত মানব সুখের কাঙ্গাল নয়, দুঃখভীরু নয়। সেই অমিত মানব আরামের দ্বার ভেঙ্গে কেবলই মানুষকে বের করে নিয়ে চলেছে কঠোর অধ্যবসায়ে। আমাদের ভিতরকার ছোটো মানুষটি তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করে থাকে; বলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো, উপায় নেই। বিশ্বের মানুষটি ঘরের মানুষ কে পাঠিয়ে দেন বনো মানুষটাকে দাবীয়ে রাখতে, এমন কি, ঘরের খাওয়া যথেষ্ট না জুটলেও।” আমাদের এই ভূখন্ডের মানব উন্নয়নের এরকম অমিত মানবের দেখা মিলেছে খুবই কম। তাই হয়তো আমাদের সমাজ আজও রুগ্ন দশা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু এই ভূখন্ডের সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচির পাশাপাশি ক্রমে দারিদ্র বিমোচন, আর্থিক ক্ষমতায়ন, মানবসক্ষতা ও মানব মর্যাদা প্রতিষ্টার সব উপাদান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য অধিকার ও আর্থিক উন্নয়নের চিন্তা, সৃজনশীলতা, অধ্যবসায় নিয়ে কিছু কিছু সমাজকর্মী তাদের বিরাট স্বপ্ন, মহান কল্পনা, অবিচল আদর্শ নিষ্টা ও কঠোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে কাজ করে গেছেন, যা জনমনে বড়ভাবেই ছাপ ফেলেছে। এই বিরল ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের উন্নয়ন জগতের পথ প্রদর্শক, যিনি বটবৃক্ষের মতো একজন অভিভাবকও হয়ে উঠেছিলেন, তিনি হলেন, “বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিষ্ট্যান্স কমিটি (ব্র্যাক) ও বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিওর প্রতিষ্টাতা এবং ইমেরিটাস চেয়ার স্যার ফজলে হাসান আবেদ। নিজের প্রতিষ্টিত এনজিওর মাধ্যমে সারাবিশ্বে তিনি বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধবিধস্ত দেশের তৃনমূল মানুষের সেবা করতে গিয়ে ব্র্যাক প্রতিষ্টা করে ছিলেন তিনি। মাত্র এক লাখ কর্মী নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর ১২ টি দেশের ১২০ মিলিয়ন মানুষকে বিভিন্ন সেবা দিয়ে চলেছে ব্র্যাক। বাংলাদেশের আজকের অগ্রযাত্রা ও সাফল্যে এখন স্যার আবেদের নাম নিতে হয় সব ক্ষেত্রে, সব সময়। তিনি যে চিরকাল থাকবেন না। সে উপলদ্ধি থেকে গুছিয়ে দিয়ে গেছেন প্রতিষ্টানটিকে ঠিক করে গেছেন উত্তরাধিকার। ব্র্যাকের সঙ্গেঁ তাই তিনিও বেঁচে থাকবেন এসব কাজের মধ্য দিয়ে।
স্যার ফজলে হাসান আবেদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল, হবিগঞ্জ জেলার বানিংয়াচং গ্রামে। বাবা সিদ্দিক হাসান- ছিলেন ভুস্বামী, মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। পূর্ব পুরুষ ছিলেন ওই অঞ্চলের জমিদার। তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরু হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। দেশভাগের ঠিক আগে বাবা অসুস্থ হলে গ্রামের বাড়ী থেকে চলে এসে ভর্তি হন চাচার কর্মস্থলে, কুমিল্লা জিলা স্কুলে। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন। পরে চাচা জেলা জজ হিসেবে পাবনায় বদলি হলে তিনিও তার সঙ্গে চলে যান এবং পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে তিনি ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ^বিদ্যালয়ে নৌ স্থাপত্যে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে সেটা বাদ দিয়ে লন্ডনের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টে ভর্তি হন। ১৯৫৮ সালে ফজলে হাসান আবেদের মায়ের মৃত্যু হয়। ১৯৬২ সালে তিনি তার পেশাগত কোর্স সম্পন্ন করেন। পরে তিনি লন্ডনে চাকরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন চাকরি করার পর চলে যান কানাডা। সেখানে ও একটি চাকরিতে যোগ দেন। পরে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে এসে শেল ওয়েল কোম্পানীর হেড অড ফাইন্যান্স পদে যোগ দেন। এ প্রতিষ্টানে কাজ করার সময়ই ১৯৭০ সালে বন্ধুদের সঙ্গে “হেল্প” নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে ঘূর্নিঝড় উপদ্রুত চট্রগ্রাম জেলার মনপুরা দ্বীপের অধিবাসিদের পাশে গিয়ে দাড়ান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধ শুরু হলে ফজলে হাসান আবেদ ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে আত্মনিয়োগ করেন যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযোদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনের কাজে এবং ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার আগে ১৯৭১ সালে লন্ডনে সমমনা বন্ধুদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধে সহায়তার জন্য “অ্যাকশন বাংলাদেশ” ও হেল্প বাংলাদেশ নামে দুইটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তারপর সহযোদ্ধাদের আরও কয়েকজনকে নিয়ে ব্রিটিশ এমপিদের সঙ্গে দেখা করা সহ বিশ^ জনমত গঠনের লক্ষ্যে লন্ডন থেকে প্যারিস, তারপর জাতিসংঘ পর্যন্ত বিরামহীন প্রচারনা অব্যাহত রাখলেন। তারা অস্থায়ী সরকারের তহবিলে অনুদান ব্যবহার দেওয়া ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধের কাজে ব্যবহারের জন্য অনেকগুলো দূরবিন এবং অসন্ন শীত মৌসুমের মোকাবেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাপড়ের ব্যবস্থা করলেন। আর্থিক সংগ্রহের এক স্মৃতিচারন জনাব আবেদ বলেছিলেন, শুধু প্রবাসী বান্ডেলী সমাজ নয়, একজন বৃটিশ মহিলা এক স্পাউন্ডের একটি নোট পাঠিয়ে লিখেছেন, আগামী দুই মাস আমি আর ডিম খাব না। আমি তোমাদেরকে দিলাম ডিম কেনার আমার পয়সাটা। এভাবে অনেক অর্থ এসেছিল তাদের কাছে। যারা তাঁকে অর্থ সংগ্রহে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। তারা হলেন ব্যারিষ্টার মোহাম্মদ, ইলিয়াস, আইয়ুব আলী মাস্টার, নূরুল ইসলাম (প্রসাসী কথা গ্রন্থের লেখক) চানু মিয়া, মোঃ মখলিছ মিয়া (লেখকের বাবা) তছদ্দোক আহমেদ, রাজিয়া বেগম, মোঃ আব্দল কাদির (মুক্তার মিয়া, মোঃ মিরাজুল হক ও আব্দুর কাদির। অতএব ৯ মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধের অবসান ঘটল ১৬ ডিসেম্বর ১৯১৭। ১৭ জানুয়ারি দেশে ফিরলেন স্যার আবেদ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পূনগঠনের ইচ্ছা নিয়ে কাজে যোগ দিলেন, জনকল্যানমূলক কাজ সমাধান করে সৃষ্টি করেছেন এক যুগান্তকারী ইতিহাস, সময়ের সীমা অতিক্রম করে দেশে বিদেশে জ্যোতি ছড়িয়ে নিরস্বার্থ অবদান। তাছাড়া তাঁর যে চিন্তাভাবনা ও কাজের উচ্চতা; সেটার সঙ্গেঁ তুলনা করার মতো কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্টান দেখি না।
সত্তরের ভয়ংকর জলোচ্ছাস ও মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের বর্বরতা ফজলে হাসান আবেদের জীবনকে এমন ভাবে নাড়া দিল যে বহুজাতিক কোম্পানির আরাম আয়েশের জীবন বর্জন করে মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। এটাকেই ধ্রুব হিসেবে মেনে নিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি আর চাকরির দিকে ফিরে তাকাননি। তিনি তাঁর লন্ডনের ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে যুদ্ধবিধস্ত দেশের পুনগঠনে সাহায্য ও অবহেলিত নির্যাতিত মানুষের পাশে থাকার জন্য তহবিল গড়ার কাজে মনুযোগী হলেন। ফ্ল্যাট বিক্রীর অর্থ দিয়ে ১৯৭২ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্টা করেন। তখন নাম ছিল বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিষ্ট্যান্ট কমিটি বা ব্র্যাক। তবে ১৯৭৩ সালে যখন পরোদস্তুর উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে ব্র্যাক কার্য়ক্রম শুরু করে, তখন তার নাম পাারিবর্তন করে রাখা হয়। বাংলাদেশ রুরাল এ্যাড-ভান্সমেন্ট কমিটি। তবে সংক্ষিপ্ত নাম ব্র্যাকই থাকে। কবি বেগম সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, কাজী ফজলুর রহমান, আকবর কবীর, ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, এস আর হোসেন এবং ফজলে হাসান আবেদ এই সাত জনকে নিয়ে ১৯৭২ সালে ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ড গঠিত হয়। ফজলে হাসান আবেদকে প্রতিষ্টানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব অর্পন করে। কবি বেগম সুফিয়া কামাল হন ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারম্যান। ব্র্যাকের প্রতিষ্টা সম্পর্কে ২০১৭ সালে গনমাধ্যমে দেয়া এক স্বাক্ষাতকারে স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলেছিলেন ১৯৭১ সালের যুদ্ধ চলাকালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশ স্বাধীন হলে অসহায় ও দূর্গত মানুষের কাছে গিয়ে ত্রাণ ও পূনর্বাসনের কাজ করব। এক কোটি লোক যুদ্ধের সময় ভারতে শরনার্তী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা ফিরে আসতে শুরু করল। ছিন্নমূল সেই মানুষগুলোর তখন জরুরী ভিত্তিতে ত্রান ও পুনর্বাসনের প্রয়োজন। ত্রাণ কর্মকান্ড পরিচালনার অভিজ্ঞতা আমার আগেই ছিল। আমি সহজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। লন্ডনের আমার নিজস্ব ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা নিজের কাছে রেখেছিলাম। ওই টাকা দেশে নিয়ে এসে ত্রাণকার্য পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলাম উত্তর-পূর্ব সিলেটের প্রত্যন্ত থানা শাল্লার পুরো এলাকায়। পাশ্ববর্তী দিরাই ও বানিয়াচং থানার কয়েকটি ইউনিয়নে কাজ ও শুরু করেন। তখন তাঁকে বিশেষ ভাবে সহযোগিতা করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ আব্দুল লতিফ তালুকদার, মাহতাবুর রহমান (চেয়ারম্যান), গোলজার আহমেদ (রাজনীতিবিদ), মান্নান চৌধুরী রাজনীবিদ, মুহিন চন্দ্র দাশ, কালা মিয়া (চেয়ারম্যান), রনদা প্রশান্ত দাশ ও আইয়ুব আলী (চেয়ারম্যান) ও মোঃ আব্দুল আজিজ, ফজলে হাসান আবেদ প্রথম দিকে অনেক সমালোচিত হয়েছেন কেন উন্নয়ন সয়স্থা ব্যবসা করবে? কেন ব্র্যাক উপকারভোগী কে ক্ষুদ্র ঋণের পাশাপাশি বিভিন্ন শাক- সবজির বীজ কিনতে বাধ্য করবে? তিনি গরীব মানুষের পৃষ্টির কথা ভেবেই এটা করে ছিলেন। ব্র্যাকের দেখাদেখি অনেক এনজিও সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্টানে গড়ে তুলেছে। কিন্তু সবাই সফল হতে পারেনি। তার কারণ যেটি শ্রদ্ধেয় আবেদ স্যার অনুধাবন করতে পেরে ছিলেন, সেটা অন্যরা করতে পারেন। তিনি এটা বুঝেছিলেন যে একটি সংগঠনকে টেকসই ভাবে এগিয়ে নিতে হলে দিকনির্দেশনার জন্য উপযুক্ত পর্ষদ, সংগঠন পরিচালনার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাদারি প্রয়োজনীয় জনবল, হিসাববিদ, অভ্যন্তরিন নিরীক্ষা, প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই।
তাছাড়া কোনো কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়া যোগ্যতা সম্পন্ন মেয়েদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এমন কি বিধবা ডিভোর্সি, সিঙ্গেল নারীদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে জীবনের হাল ধরতে সাহায্য করেছেন। তাদের তিনি সুযোগ দিয়েছেন সম্ভাব্য গুনাবলি বিকাশে এবং পেশাগত জীবনে উন্নতি সাধনের এবং শীর্ষপদে কেউ কেউ সাফল্যতার সঙ্গে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন, পরবর্তী সময়েও কোন ব্যক্তি অথবা প্রটতিষ্ঠান যখন বিপদে পড়েছে, তিনি সাহায্যের হাত বাড়াতে কার্পন্য করেননি। মাঝেমধ্যে ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্যও তিনি সাহায্য করেছেন এবং সারা বিশে^ এনজিওর কনসেপ্ট বদলে দিয়েছেন স্যার আবেদ একটি এনজিও দেশব্যাপী প্রায় সকল সমস্যার সামগ্রিক সমাধান দেয়ার জন্য এগিয়ে আসতে পারবে এরকম ধারণা ছিল একেবারে অকল্পনীয়। দেশে-বিদেশে অসংখ্য প্রতিষ্টান ও কর্মসূচি নিয়ে একটি বিশালায়নের এনজিওর ধারণা শ্রদ্ধেয় আবেদ স্যারই দিয়ে গিয়েছেন। তার চাইতেও বড় তাঁর বড় অবদান একক এনজিও ও বহুমাত্রিক এনজিওর ব্যবস্থাপনাকে একটা নতুন বিজ্ঞানে প্রতিষ্টিত করে দিয়ে যেতে পারা। এই অবদান তাকে চিরস্মরনীয় করে রাখবে। অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান, নেপালও শ্রীলংকার অর্থনৈতিক গবেষকদের কাছ থেকে বারবারই একটি প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশে যে যাই করে সেটা দেশ ব্যাপী করে ফেলে- আমাদের দেশে এরকম হয়না কেন? জবাব একটাই তোমাদের দেশে তো এখনো স্যার ফজলে হাসান আবেদের জন্ম হয়নি। তার জন্য তো যুক্তরাজ্য থেকে নাইট উপাধি পেয়ে তার নামের আগে বসল ‘‘স্যার”।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন- “আমার একমাত্র মনোকষ্ট হলো আরও দ্রুত চলা উচিত ছিল। বিদেশে হয়তো আরও আগেই যাওয়া উচিত ছিল আমার (ব্র্যাকের)। বাংলাদেশ থেকে বের হতে আমাদের ৩০ বছর লেগেছে।” ২০১৪ সালে থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে এক সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলেছিলেন তিনি। স্যার আবেদ এমন একজন মানবহিতৈষী ছিলেন, যিনি আমাদের শিখিয়েছেন উন্নয়ন কাজ কীভাবে করতে হয়। তিনি একটি দক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেও ভূলে যাননি, কাদের জন্য এটি কাজ করছে, তিনি জীবনে বহু প্রতিষ্টানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেছেন এই প্রতিভাবান মানুষ। হার্ভার্ড ইউনিভার্সির – হাভার্ড ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের ভিজিটিং স্কালার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৮১ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ১৯৮৬ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, জেনেভার এনজিও কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভাড ইউনিভাসির ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন হেলথ রিসার্চ ফর ডেভেলপমেন্টের সদস্য হিসেবে এবং ১৯ বছর গণ স্বাক্ষরতা অভিযানের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৪ এবং ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন ও ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট (ইরি), ফিলিপাইনের বোর্ড অব গভর্ণরনের সদস্য এবং ২০০২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ইন্টারন্যাশন নেটওয়ার্ক অব অলটারনেটিভ ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন (ইনাফি) এর গ্লোবাল চেয়ারপারসন এর দাযিত্ব পালন করেন তাছাড়া ২০১০ সালে জাতিসংঘের তদানীন্তন মহাসচিব বান কি মুন স্যার ফজলে হাসান আবেদকে বিশে^র স্বল্পোন্ন দেশ সমূহের “স্বনামধন্য ব্যক্তি বর্গর একজন হিসেবে নিযুক্তি প্রদান করেছিলেন। অশোকা গ্লোবাল একাডেমি ফর সোশ্যাল এন্টোপ্রেনিউর শিপ স্যার আবেদ কে ‘গ্লোবাল গ্রেট’ স্বীকৃতি প্রদান করেছিলো এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত উক্ত প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিলেন।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য স্যার ফজলে হাসান আবেদ তার জীবনে অসংখ্য পুরষ্কার লাভ করেছেন। যেমন সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকার জন্য র্যামন ম্যাগসেসে পুরষ্কার, জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার মাহবুবুল হক পুরষ্কার, গেটস ফাউন্ডেশনের বিশ^স্বাস্থ্য পুরষ্কার, ইউনিসেফ মরিস পেট ও ইউনোস্কো নোমা পুরষ্কার, হাঙ্গার দারিদ্র বিমোচন ও দরিদ্র নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য সুইডেনের ওলফ পাস পুরষ্কার, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন আজীবন সম্মাননা, হেনরী আর ক্রাভিস ও প্রথম ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেন এবং শিক্ষা ক্ষেত্রের ‘নোবেল’ বলে খ্যাত ইয়াইদান পুরষ্কার, তাছাড়া দেশ বিদেশ থেকে এই মানবকে দেওয়া হয়েছে অনেক সম্মান, খেতাব, এত কিছুর পরও তার প্রতিষ্টানের সব সদস্য, নারী ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের কাছে তিনি সব সময়ই রয়ে গিয়েছেন শ্রদ্ধেয় ‘আবেদ ভাই’ হিসেবে, তাঁর ও তাঁর হাতে গড়া ব্র্যাকের সব কর্মকান্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাজ্যের রানী দিয়েছেন তাঁকে ‘স্যার’ উপাধি, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক সা¤্রাজের সবনিকা টানার পর এই প্রথম কোন বাঙালী এই উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।
কিন্তু, কেন জানি আমার হৃদয়ে একটি অতৃপ্তি বারবার সন্তর্পনে আমাকে পীড়া দেয়, তা আমি জানিনা। এ কারনে পীড়া দেয়, কেন স্যার ফজলে হাসান আবেদকে ‘‘নোবেল’’ প্রাইজ দেওয়া হলো না।
ব্র্যাক এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারী সংস্থা (এনজিও)। এশিয়া ও আফ্রিকার ১২ টি দেশে এখন ব্র্যাক কাজ করে। জেনেভাভিত্তিক প্রতিষ্টান এনজিও ‘এ্যাডভাইজার’ বিশে^র শীর্ষে থাকা ৫০০ টি এনজিও মূল্যায়ন করে বলেছেন, প্রভাব, সৃজনশীলতা ও টেকসই হওয়ার বিচারে বিশে^র সেরা এনজিও ব্যাক। বাংলাদেশের উন্নয়নের পালাবদলের অন্যতম এই পথদ্রষ্টা ও ব্র্যাকের প্রতিষ্টাতা চলে গেলেন ২০ ডিসেম্বর ২০১৯। ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিশ^াস ত্যাগ করেন। বাংলাদেশ তথা পৃথিবী হারিয়েছে একজন ভাগ্যবান মানবকে যিনি কিনা তাঁর জীবনের সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছিলেনে অভাগা মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে। জনাথন সুইফটের ভাষায়, আপনি যেন জীবনের সব দিন বেঁচে থাকেন, এ কামনাই করি। তা না হলে কি করে বুঝব, গধহ পধহ নব ফবংঃৎড়ুবফ নঁঃ হড়ঃ ফবভবধঃবফ. কী করে পূরণ হবে স্যার আবেদের অতৃপ্ত বাসনা নারী-পুরুষ সমতা? ভেঙ্গেছে দুয়ার ও এসেছে জ্যোতির্ময় এই উদার মনের মানুষটি ছিলেন এক ভিন্ন মানবিক গুনাবলির, যার কাছে অন্যের সমস্যা সমাধান করাই ছিল প্রধান কাজ। তাই তো ৪৮ বছর নিরলসভাবে সমাজকে দিয়ে গেছেন তার মূল্যবান সময় এবং রেখে গেছেন প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও নেতৃত্ব পরিবর্তনের অনন্য এক দৃষ্টান্ত। তাছাড়া ব্র্যাককে সামনে এগিয়ে নেওয়ার কাজে যথাযোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়টি ছিল তার সিদ্ধান্তের গুরুত্বপূর্ন অংশগর্ব ও আত্মবিশ^াসের সঙ্গে তিনি এ সিদ্ধান্ত দিয়ে গিয়েছেন।
বিশাল এই ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে বিশিষ্টজন গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছেন, শারীরিক ভাবে প্রস্থান করলেও তার দীর্ঘ কর্মময় জীবন যুগ যুগ ধরে মানুষের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরনা হয়ে থাকবে। এমন মহান মানুষের মৃত্যু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এক শোকবার্তায় বলেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবন মানবতার জন্য এক বিরাট উপহার, ব্র্যাকে ৪৮ বছরের নেতৃত্বের তিনি বাংলাদেশ এবং তার বাহিরে কোটি কোটি মানুষের জীবন অমুল বদলে দিয়েছেন। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, তিনি আমাদের জন্য এক অনুপ্রেরণা দায়ক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিত ব্যানার্জি এবং এস্তার দুফলো বলেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদের মত মানুষ কয়জন হয়। তাঁর প্রয়ানে আমরা সবাই ছোট হয়ে গেলাম। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, তিনি একজন অসাধারন বিনয়ী মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রয়োজনকে বিষ্মুত না হয়ে কীভাবে বৃহৎ ও কার্যকর সংগঠন গড়ে তুলতে হয়। নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, “বাংলাদেশে সমাজের যে বিপুল পরিবর্তন হয়েছে, আবেদ তার প্রধান রূপকার”। আইডিযার নির্বাহী প্রধান-নজমুল হক বলেন, “স্যার ছিলেন বটবৃক্ষ। তাঁর কাছ থেকে শিখেছি কী করে মানুষের সঙ্গে মানুষের জন্য কাজ করতে হয়, তাঁর স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া তিনি তৃনমূল থেকে কাজ করে আসছেন।” উইমেন ফর উইমেনের প্রতিষ্টাতা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক জয়নব সালবি টুইটে লিখেছেন- স্যার ফজলে হাসান আবেদ ভাইয়ের মৃত্যুতে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। তিনি ছিলেন দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশে^র বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকের প্রতিষ্টাতা। সবচেয়ে উদ্ভাবনী ও সাহসী পন্তায় দারিদ্র্য দূর করার জন্য কাজ করে গিয়েছেন এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ দারিদ্র্য দূরীকরণ ও মানুষের কল্যানে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি যেমন দেশকে সম্মানিত করেছেন, একই ভাবে তাকেও বিশে^র বিভিন্ন জায়গা থেকে সম্মানিত করা হয়েছে। এটিও দেশের জন্য সম্মানের এবং তাঁর সুনাম বাংলাদেশ সহ সারা বিশে^ ছড়িয়ে আছে। তাছাড়া আমার বিশ^াস যে, স্যার আবেদের চিন্তাভাবনা, কর্মকান্ড একাত্তরে শুরু হয়ে ছিল, সেটি সামনে এগিয়ে নেবেন বর্তমানে ব্র্যাকের কর্নধার।
মানুষ হিসেবে স্যার ফজলে হাসান আবেদের এমন কিছু বিশেষ দিক ছিল যা অনেকের জন্য অনু প্রেরনীয়। স্যার আবেদ নারী পুরুষের সমতায় বিশ^াস করতেন তিনি মনে করতেন, নারী পুরুষের সমতা ছাড়া কখনো এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এবং তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণটি হলো তাঁর নির্মোহ স্বভাব। তিনি চাইলে ব্যক্তিগত ভাবে অনেক সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সিনিয়র সিটিজেন হওয়া সত্বেও স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন প্রযুক্তি বান্ধব এবং ভবিষ্যৎ স্বপ্নদ্রষ্টা। তাছাড়া মানুষের জীবনে লক্ষ্যে অটল থাকতে পারলে এবং কঠোর পরিশ্রম করলে সফলতা আসে। তারই এক উজ্জ¦ল দৃষ্টান্ত স্যার ফজলে হাসান। আর তিনি সব সময়ই ক্ষুধা- দারিদ্র্য মুক্ত বাংলা দেশের স্বপ্ন দেখে এসছেন। সুখী জীবনকে পাশ কাটিয়ে সাধারনের জন্য স্বপ্ন দেখা মানুষটিকে অনন্য বলতেই হবে।
লেখক ম. আমিনুল হক চুন্নু, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্টাতা অধ্যক্ষ, নুরজাহান মেমোরিয়াল মহিলা ডিগ্রী কলেজ, সিলেট। পি এইচ, ডি ফেলো।