ঢাকা শহরকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী। চারটি নদীর তীর দখলমুক্ত করে ৫২ কিলোমিটার হাঁটার পথ করাসহ সীমানা পিলার স্থাপন, তীররক্ষা ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলছে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে। মেয়াদ আরও আড়াই বছর বাকি থাকতেই প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব এসেছে পরিকল্পনা কমিশনে। সংশোধনীতে বিভিন্ন খাতের কাজের পরিমাণ কমিয়ে বাড়তি খরচের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নদীর তীরে একেকটি সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড স্থাপনে এক লাখ ৫১ হাজার টাকা, প্রায় সাড়ে ১৫ মিটার দীর্ঘ ও চার মিটার প্রস্থের প্রতিটি আরসিসি সিঁড়ির জন্য ৪১ লাখ, একেকটি বসার বেঞ্চ স্থাপনে ৮০ হাজার, নিচু ভূমিতে প্রতিটি সীমানা পিলার স্থাপনে তিন লাখ সাত হাজার এবং উঁচু ভূমিতে প্রতিটি সীমানা পিলার স্থাপনের জন্য এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা খরচ প্রস্তাব করেছে।
সম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বিআইডব্লিউটিএ’র সদস্য (অর্থ) ও প্রকল্প পরিচালক মো. নুরুল আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে প্রস্তাবিত খরচকে ‘যথার্থ’ বলে দাবি করেছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক। খরচের খাতগুলোর তথ্য শোনার পর তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আশা করি, যথার্থই করা হয়েছে।’
ঢাকার চারপাশে নির্মিত হবে এমন ওয়াকওয়ে
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এগুলো স্বাভাবিক বলেই তো প্লানিং কমিশন দিচ্ছে। খরচ প্রস্তাবগুলো নিয়ম অনুযায়ী করা। এ ধরনের প্রস্তাব গেলে যাচাই-বাছাই করা হয়। প্লানিং কমিশন দেখে, আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা আছেন, তারাও দেখেন।’
গোলাম সাদেক জাগো নিউজকে আরও বলেন, ‘এখন যাচাই-বাছাই হওয়ার সুযোগ খুব কম, কারণ মিটিং (পিইসি সভা) হয়ে গেছে। এখন হয়তো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) যাবে পাস করার জন্য। খুব সম্ভবত কিছু অবজারভেশন ছিল, সেগুলো চূড়ান্ত হলেই হয়তো একনেকে প্রস্তাব যাবে।’
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) পর্যন্ত পিইসি সভার রেজুলেশনে সই করেননি পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. মামুন-আল-রশীদ।
২৩ ও ২৪ ডিসেম্বর দুদিন তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।
ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) কাজী জাহাঙ্গীরকে ফোন করা হলে তিনিও বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। কাজী জাহাঙ্গীর বিষয়টি নিয়ে এ বিভাগের রেল পরিবহন উইংয়ের উপ-প্রধান আবুল বাকের মো. তৌহিদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
উল্লিখিত খরচগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল বাকের মো. তৌহিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা প্রকল্পের খরচ প্রাক্কলন করি না, করে মন্ত্রণালয়-সংস্থা।’
এ কথা বলার পর তিনিও তার অধস্তন আরেক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
অবশ্য ভৌত অবকাঠামো বিভাগের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পটির খরচের সারসংক্ষেপ এখনও অনুমোদন হয়নি। প্রকল্পটির কেবল পিইসি সভা হয়েছে। পিইসি সভায় তারা এসব খরচ প্রস্তাব করেছেন। এটার ওপর সভা হবে। সভার ওপর ভিত্তি করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। এরপর তারা যখন সামারি পাঠাবেন, তখন তা পরিকল্পনামন্ত্রী অনুমোদন দেবেন। তারপর একনেকে যাবে। তখনই এটা যে ধরা হয়েছে, তা বলা যাবে। তারা কেবল এ ব্যয় প্রস্তাব করেছেন।’
পিইসি সভায় এ বিষয়ে কোনো মূল্যায়ন দেয়া হয়েছে কি-না, এর জবাবে তিনি বলেন, ‘পিইসি সভার রেজুলেশন এখনও সই করেননি সদস্য।’
বুড়িগঙ্গার দূষিত পরিবেশ থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে চলছে উচ্ছেদ অভিযান
সূত্র জানায়, ‘বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরে পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ নামে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রথম সংশোধনে মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পাশাপাশি প্রকল্পটির অনুমোদিত ব্যয় ৮৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। প্রথম সংশোধনে ৩৩২ কোটি ৫৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ১৮১ কোটি ১০ লাখ ৩১ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রথম সংশোধনে ৩৯ দশমিক ১৯ শতাংশ খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
প্রকল্পটি ঢাকার কেরানীগঞ্জ; নারায়ণগঞ্জের সদর, বন্দর ও সোনারগাঁও; গাজীপুর সদর এবং ঢাকা মহানগরের সদরঘাট, উত্তরখান, তুরাগ, মোহাম্মদপুর, কামরাঙ্গীরচর, কোতোয়ালি ও মিরপুর এলাকায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকা মহানগরীর চারদিকে নদীগুলোর উচ্ছেদ করা তীরবর্তী ভূমিতে ৫২ কিলোমিটার হাঁটার পথ উন্মুক্ত হবে।
প্রকল্পটির সংশোধন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) সূত্র জানায়, ১০০টি আরসিসি সিঁড়ি নির্মাণে খরচ অনুমোদন রয়েছে ৩১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। সিঁড়ি প্রতি খরচ করা হচ্ছে ৩১ লাখ ১৮ হাজার টাকা। সংশোধনীতে সংখ্যা কমিয়ে ৮০টি সিঁড়ি নির্মাণের জন্য ৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এ পর্যায়ে প্রতিটি সিঁড়ির পেছনে ৪১ লাখ টাকা খরচের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০টি সিঁড়ি কমলেও খরচ বেড়েছে এক কোটি ৬২ লাখ টাকা।
৪০৯টি বসার বেঞ্চ নির্মাণে দুই কোটি ৭৮ লাখ ১২ হাজার টাকা খরচ অনুমোদন রয়েছে। প্রতিটি বেঞ্চ নির্মাণে খরচ করা হচ্ছে ৬৮ হাজার টাকা। সংশোধনীতে বেঞ্চ সংখ্যা কমিয়ে ২৯১টি নির্মাণে খরচ প্রস্তাব করা হয়েছে দুই কোটি ৩২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এতে প্রতিটি বেঞ্চ তৈরিতে খরচ পড়বে ৮০ হাজার টাকা করে।
নদীতীরে সচেতনতামূলক ৩৬টি সাইনবোর্ড স্থাপনে খরচ অনুমোদন রয়েছে ৫৪ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। প্রতিটি সাইনবোর্ডে খরচ করা হচ্ছে এক লাখ ৫১ হাজার টাকা করে। সংশোধনীতে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০০টি এবং খরচ প্রস্তাব করা হয়েছে এক কোটি ৫১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। সাইনবোর্ড বেড়েছে ৬৪টি এবং খরচ বেড়েছে ৯৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে সাইনবোর্ড প্রতি খরচ বাড়ানো হয়নি।
ছয় হাজার ২০৩টি নিচু ভূমিতে নদীর সীমানা পিলারের খরচ অনুমোদন রয়েছে ১৫০ কোটি ৭৩ লাখ ২৯ হাজার টাকা। প্রতিটির পেছনে খরচ করা হচ্ছে দুই লাখ ৪৩ হাজার টাকা করে। সংশোধনীতে প্রায় অর্ধেক কমিয়ে তিন হাজার ৮৫০টি সীমানা পিলার নির্মাণের জন্য খরচ প্রস্তাব করা হয়েছে ১১৮ কোটি হাজার ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রতিটি পিলারে এখন খরচ পড়বে তিন লাখ সাত হাজার টাকা করে।
নদীর তীর দখল করে গড়ে ওঠা স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান
চার হাজার ৬১৭টি উঁচু ভূমিতে সীমানা পিলার নির্মাণের জন্য ৪৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা ১৯ হাজার টাকার অনুমোদন রয়েছে। প্রতিটি পিলারের জন্য খরচ হচ্ছে এক লাখ সাত হাজার টাকা। সংশোধনীতে কমিয়ে তিন হাজার ৭১২টি পিলার নির্মাণের জন্য খরচ প্রস্তাব করা হয়েছে ৫৩ কোটি ৮২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এখন প্রতিটি পিলারে খরচ পড়বে এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা। ৯০৫টি পিলার কমলেও খরচ বেড়েছে চার কোটি ৪২ লাখ ২১ হাজার টাকা। এছাড়া আরও অনেকখাতে এভাবে ব্যয় বাড়ানো ও সংখ্যা কমানো হয়েছে।
নদী দখল করে আরসিসি কাঠামো করে ব্যবসা
প্রকল্পটি সংশোধনের ব্যাখ্যা জানাতে গিয়ে পরিকল্পনা কমিশনকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ লিখিতভাবে জানিয়েছে, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা – এই চারটি নদীর তীরভূমির বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ দখলদারদের কবলে এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা ব্যবসা পরিচালনার জন্য আরসিসি কাঠামো তৈরি করেছেন। ফলে নদীগুলোর প্রশস্ততা এবং নৌ চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় গভীরতা দিন দিন কমছে। এছাড়া অননুমোদিত ও অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।
তারা আরও বলেছে, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটি অনুমোদনের পর ২০১৯ সালের ২৭ মার্চে প্রকল্পের কারিগরি কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল প্রকল্পের ওপর পিএসসি সভা অনুষ্ঠিত হলে কারিগরি কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। সেই আলোকে খরচ ও সময় বাড়িয়ে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধন প্রস্তাব করা হয়েছে।