প্রশাসন ক্যাডারের মাঠপর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুনের সাহসী বক্তব্যে প্রশাসনজুড়ে তোলপাড় চলছে। বিশেষ করে তিনি এক শ্রেণির এসি ল্যান্ড ও ইউএনওদের দুর্নীতি, অদক্ষতা, ক্ষমতা অপব্যবহার এবং নেতাগিরি নিয়ে যে সত্যভাষণ দিয়েছেন তা সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। প্রশাসনের বেশিরভাগ কর্মকর্তা সাধুবাদ জানিয়ে বলেছেন, অতীতে কোনো জনপ্রশাসন সচিব এ রকম বক্তব্য দেননি। প্রশাসনের ইতিহাসে এটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
বৃহস্পতিবার ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের সম্মেলন কক্ষে ২০২০ সালের সামগ্রিক দক্ষতা বিবেচনায় ঢাকা বিভাগের জেলা পর্যায়ের ‘শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা স্বীকৃতি প্রদান’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ সভায় বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় জনপ্রশাসন সচিব রীতিমতো এসি ল্যান্ড ও ইউএনওদের আমলনামার পর্দা উন্মোচন করে দেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তবে তিনি সরাসরি যোগ না দিয়ে ভার্চুয়ালি ভিডিও বক্তৃতা করেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন সচিবের দেয়া বক্তব্যের কয়েকটি মৌলিক দিক ছিল। প্রথমত তিনি বলতে চেয়েছেন, প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেক বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। যে কারণে তাকে প্রতিদিন অস্বাভাবিক হারে বিভাগীয় মামলা শুনতে হচ্ছে। অনেকে আবার এসব অপরাধ থেকে বাঁচতে নানাভাবে তদবির করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও করেন। এছাড়া অধিকাংশ কর্মকর্তা ঢাকায় থাকার জন্য তদবির করেন। কেউ আবার এসি ল্যান্ডের প্রাইজ পোস্টিংগুলোতে বেশিদিন থাকতে চান। কিছু কর্মকর্তা আছেন, যারা বাস্তবে কাজ করার তুলনায় কিছু একটা করেই তা ফেসবুকে পোস্ট করে বেশি সরব থাকতে চান। সেখানে তারা রুটিন ওয়ার্কের কাজকে বড় করে তুলে ধরেন। কেউ আবার তার গায়কী প্রতিভাকে জনসম্মুখে নিয়ে আসেন। আবার গণমাধ্যম ফেস করার সক্ষমতা না থাকলেও প্রয়োজন ছাড়াই কিছু কর্মকর্তা টিভি টকশোতে যুক্ত হচ্ছেন। বেশ কয়েকটি বাস্তব ঘটনার উদাহরণ টেনে তিনি ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সভায় দেয়া সচিবের কয়েকটি বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হল-
জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বক্তৃতার একপর্যায়ে বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তাদের অপরাধ প্রবণতা এখন এত পরিমাণে বেশি যে- প্রতিদিন আমাকে ৩-৪টি করে বিভাগীয় মোকদ্দমা শুনতে হয় এবং অনেকের শাস্তি হয়। এটি কিন্তু আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আবার একজন কর্মকর্তা যখন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হন, তখন তিনি তার ফোরামের লোকজন নিয়ে তদবির করতে জনপ্রশাসন সচিবের কাছে আসেন। এরপর তারা বলেন, স্যার ও তো ভালো কর্মকর্তা। পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে করে ফেলছেন, তাকে মাফ করে দেন। কিন্তু এসব তদবিরে আমরা চরমভাবে বিব্রত হই। অপরাধের ক্ষেত্রে মানবিক দিক বিবেচনা করা হয়। অনেকের তো বড় শাস্তি হওয়া উচিত। তারপরও পরিবেশ-পরিপ্রেক্ষিতসহ সবকিছু বিবেচনা করা হয়।’ তিনি সব কর্মকর্তার উদ্দেশে বলেন, ‘মনে রাখবেন আমি একজন কর্মকর্তা হয়ে যেন অ-কর্মকর্তাসুলভ আচরণ না করি। আমার যে দায়িত্ব, সেটি যেন ভালোভাবে পালন করি।’
সচিব বলেন, ‘আর একজন কর্মকর্তা ফেসবুকে লিখেছেন, অমুক ব্যাচের কর্মকর্তা তো এতদিন এসি ল্যান্ড ছিলেন। তাহলে আমরা কেন এক বছর এসি ল্যান্ড থেকে প্রত্যাহার হব। কারণ হল যে, তার খাওয়াটি আসলে কম হয়েছে। এক বছরে খাওয়া শেষ হয়নি। আরও যদি দুই বছর উনি থাকতে পারতেন তাহলে উনার পেটটি ভরত।’
শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘আমরা দেখলাম যে পেকুয়ার ইউএনও হঠাৎ করে একটি বেসরকারি টিভিতে গিয়ে বক্তব্য দিলেন। কিন্তু তিনি সেখানে একটা প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারলেন না। অথচ সেখানে ঘটে যাওয়া ঘটনার সঙ্গে ইউএনওর কোনো সম্পর্ক নেই। কী আর বলব, আমি যখন ওই অনুষ্ঠানটি দেখলাম তখন লজ্জায় ভাবলাম, আমার একজন ইউএনও ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে একটা প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারলেন না। তাহলে তিনি সেখানে গেলেন কেন? যে ঘটনার সঙ্গে তার (ইউএনও) কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ তিনি সেখানে গেলেন এবং বললেন, আমি ওসিকে নির্দেশ দিয়েছি। ওসিকে নির্দেশ দেয়ার কে আপনি? দেখুন, এগুলো কিন্তু জনগণ ও অন্য সার্ভিসের লোকজন ভালোভাবে নেন না।’
কিছুদিন আগে একজন জেলা প্রশাসকের একটি টিভি টকশোতে যুক্ত হয়ে কথা বলা প্রসঙ্গে সচিব বলেন, ‘তার (ডিসি) কাজটি ছিল যুগান্তকারী। তিনি (ডিসি) বলেছেন, যে ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে তারা সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকতে পারবে না। এর চেয়ে ভালো কাজ আর কী হতে পারে? অথচ ওই চ্যানেলে নিয়ে উপস্থাপক তাকে যেভাবে হেনস্তা করলেন। তারা এমনভাবে প্রশ্ন করলেন, যেন পুরো প্রশাসনকে বিব্রত করা হল। তাহলে প্রশ্ন হল, আমার ওই চ্যানেলে যেতে হবে কেন। সম্মান যেখানে থাকবে না, সেখানে যাবেন কেন। কই আমরা তো যাই না। হ্যাঁ, আমরা যাই; যেখানে গেলে বুঝি আমার মর্যাদা থাকবে, আমাকে কোনো অবান্তর প্রশ্ন করা হবে না, এরকম ক্ষেত্রে আমরা যাই।’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কিন্তু সার্কুলার দিয়েছি। সার্কুলার মানে আচরণবিধি স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। অর্থাৎ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া এসব অনুষ্ঠানে না যাওয়ার জন্য। এগুলো আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘একজন কর্মকর্তা তিনি তার ব্যাচের পক্ষে এপিডি (অতিরিক্ত সচিব, নিয়োগ-বদলি ও পদোন্নতি উইংয়ের প্রধান) সাহেবকে বললেন- স্যার, আমার ঢাকায় একটা পোস্টিং দরকার। কেন ঢাকায় পোস্টিং দিতে হবে জানতে চাইলে তিনি জবাবে বলেন, স্যার আমি তো ওই ব্যাচের সভাপতি। আমার ব্যাচের অনেক কাজকর্ম করতে হয়। এজন্য তার ঢাকায় আসা প্রয়োজন।’
‘প্রশ্ন হল, উনি একটি ব্যাচের সভাপতি- এজন্য তাকে ঢাকায় আনতে হবে। কিন্তু কেন? আমি চাকরি শুরু করেছি সুনামগঞ্জ দিয়ে। ২৫ বছর পর ঢাকায় এসেছি। মাঠেই ছিলাম। আর এখন! এ হল আমাদের দুর্ভাগা কর্মকর্তা।
কোনো কাজ করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি পোস্ট করা নিয়ে সচিব বলেন, ‘একজন কর্মকর্তা ইউনিয়ন ভূমি অফিস পরিদর্শন করে সেই ছবি ফেসবুকে দিয়ে দিলেন। কিন্তু কেন? এমন একটি ভাব- যেন ইউনিয়ন ভূমি অফিস একমাত্র তিনিই পরিদর্শন করেছেন। আর আগে জীবনে কোনোদিন কোনো কর্মকর্তা সেটি পরিদর্শন করেননি।’
সচিব বলেন, ‘একজন কর্মকর্তা ভালো গান করতে পারেন। গান গেয়ে তিনি ফেসবুকে দিলেন। কিন্তু কেন? আবার কোনো কোনো কর্মকর্তার কথা আমরা শুনি, তিনি প্রায় সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এটি আমি মনে করি সঠিক নয়। কেন তিনি সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করবেন? হ্যাঁ গান গাওয়ার যদি খুব প্রয়োজন হয়, তাহলে বাসার মধ্যে ইনহাউস কর্মকর্তাদের নিয়ে একান্ত পরিবেশে করুন।’
সার্ভিসে আসা নতুনদের আচরণ সম্পর্কে উদাহরণ দিতে গিয়ে সচিব বলেন, ‘৩৭তম বিসিএসের একটি ফোরাম হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা একজন উচ্চপদের কর্মকর্তাকে নিয়ে সভাও করেছেন। অথচ তারা এখনও চাকরিতেই যোগ দেননি, কিন্তু ফোরাম হয়ে গেছে। এ হল অবস্থা।’
এদিকে জনপ্রশাসন সচিবের এ বক্তব্যের অডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মুঠোফোনে ভাইরাল হয়েছে। প্রশাসনে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের বেশিরভাগ কর্মকর্তাসহ সাধারণ মানুষও সচিবের বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। অনেকে যুগান্তরের কাছে এ বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, জনপ্রশাসন সচিবের মতো সচিব আমাদের দরকার। যারা নির্দ্বিধায় নিজেদের দুর্বলতার বিভিন্ন দিক এভাবে তুলে ধরবেন। পাশাপাশি এ শ্রেণির কর্মকর্তাদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। অপরাধীকে রক্ষায় যারা তদবির করতে আসবেন উল্টো তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া যেই কর্মকর্তা তদবির করাবেন তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তারা মনে করেন, প্রশাসনসহ সব স্তরে ভালো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু কিছু খারাপ লোকজনের কারণে পুরো প্রতিষ্ঠান ইমেজ সংকটে পতিত হয়। যা কারও কাম্য নয়। তারা বলেন, এ অবস্থা শুধু মাঠপর্যায়ে বললে ভুল হবে। সব খানে এ রোগ বাসা বেঁধেছে। অনেক ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা না থাকা এবং অতি মাত্রায় দলীয় রাজনীতিকে প্রাধান্য দেয়ার কারণে আজকে এ ধরনের পরিস্থিতি বেশি করে ফেস করতে হচ্ছে।
জানা গেছে, বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের বহু ঘটনা তদন্তাধীন রয়েছে। এর মধ্যে নারীঘটিত ঘটনাও কম নয়। কিন্তু তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও বিভাগীয় মামলা চলে খুবই মন্থর গতিতে। কারণ, পেছনে কাজ করে শক্ত তদবির। তদবিরের কারণে ভিকটিমের ফোনালাপের আলামতও অনেকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিতে ভয় পান। কারণ তাহলে তো অপরাধ হাতেনাতে প্রমাণিত হবে এবং শাস্তি নিশ্চিত। আগে তদবির করতেন রাজনীতিবিদরা। এখন সবার আগে শক্ত তদবির করেন অভিযুক্ত কর্মকর্তার ব্যাচের নেতা নামধারীরা। কেউ কেউ বিভাগীয় মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের সময়ও ঢুকে পড়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। বোঝাতে চান, তিনি খুব ক্ষমতাধর। তাই তার ব্যাচমেট অন্যায় কিছু করে থাকলেও তাকে ছাড় দিতে হবে।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ‘সত্য যে বড় কঠিন, সেই কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’ কবির এ শক্ত উক্তিটি অন্তত জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন যে দৃঢ়তার সঙ্গে ধারণ করতে পেরেছেন তা প্রশাসনের জন্য বড় গৌরবের। সবার প্রত্যাশা থাকবে, এটি যেন শেষ পর্যন্ত অটুট থাকে।