সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তোলা ছবি কয়েকদিন পর পর নিজের ফেসবুকে প্রচার করতো। ক্যাপশনে লিখতো ‘ভালোবাসার শেষ ঠিকানা’। ফেসবুক আইডি’র কভার ফটোতেও দীর্ঘদিন ধরে সেতুমন্ত্রীর সঙ্গে একটি গ্রুপ ছবি রাখা। ছবি প্রচার করে জানান দিতো মন্ত্রীর সঙ্গে তার দারুণ সখ্য আছে। শুধু তাই নয়, পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সরকারি আরো অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলেও ফেসবুকে প্রচার করতো। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে গিয়ে পরিচয় দিতো সেতুমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে। আর এই পরিচয় দিয়ে ভাগিয়ে নিতো চাকরি, টেন্ডার, বিভিন্ন পদমর্যাদার সরকারি কর্মকর্তার পোস্টিং। এছাড়া মন্ত্রীর স্বাক্ষর, সিল জাল করেও নানা প্রতারণা করতো।
কাজ হাসিল হলে ওই ব্যক্তিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতো বড় অংকের টাকা। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে সেতুমন্ত্রীর পরিচয় ও স্বাক্ষর, সিল জাল করে তদবির বাণিজ্য ও প্রতারণা করে আসছিল এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। তার নাম মোজাম্মেল হক ইয়াছিন (৩৩)। সে এক সময় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। সর্বশেষ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর মাধ্যমে এক ব্যক্তির চাকরির ব্যবস্থা করতে গিয়ে ইয়াছিন গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ধরা খেয়েছে। গতকাল দুপুরে গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি জোনাল টিম প্রতারক ইয়াছিনকে গ্রেপ্তার করেছে।
ডিবি জানায়, প্রতারক ইয়াছিন নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার বনতিয়শ্রী গ্রামের আঃ রশিদের ছেলে। সে ঢাকার কামরাঙ্গীচরের জাউলহাটী চৌরাস্তার ৭৭৩ নম্বর বাসায় থাকতো। ঢাকা কলেজে লেখাপড়াকালীন সময়ে সে ছাত্রলীগের সাধারণ সদস্য হিসেবে কাজ করতো। পরে ছাত্রলীগের সোহাগ-জাকিরের নেতৃত্বাধীন সময়ে সে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে স্থান পেয়েছে বলেও দাবি করেছে। ২০১৪ সালে মাস্টার্স শেষ করে বিভিন্ন ধরনের তদবির বাণিজ্যর সঙ্গে যুক্ত হয়। পাশাপাশি তার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে বলেও জানিয়েছে। ডিবি সূত্র জানিয়েছে, প্রতারক ইয়াছিন এলজিইডি’র অস্থায়ী কার্য-সহকারী পদে জামালপুরের সরিষাবাড়ীর মো. মাঈন উদ্দিনের চাকরির বিষয়ে এলজিইডি’র প্রধান প্রকৌশলীর কাছে তদবির করছিল। চাকরির আবেদনের কপিতে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সিল ও স্বাক্ষর জাল করেছে ইয়াছিন। এছাড়া ওই আবেদনে হাতে লিখে সেতুমন্ত্রীর একটি সুপারিশও দেয়া হয়েছে। ডিবি জানিয়েছে, প্রধান প্রকৌশলী সেতুমন্ত্রী সুপারিশ দেখে মাঈন উদ্দিনের চাকরি প্রায় নিশ্চিত করেছিলেন। পরে সেতুমন্ত্রীর আসল এপিএস’র সঙ্গে তার কর্মকাণ্ড, চলফেরার মিল না হওয়াতে সন্দেহ হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই নামে মন্ত্রীর কোনো এপিএস নেই এবং কখনই ছিল না।
ডিবি জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ইয়াছিন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও সেতুমন্ত্রীর এপিএস পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সরকারি অফিস চষে বেড়াতো। তার দাপটে বিভিন্ন সরকারি অফিসের বড় বড় কর্মকর্তারাও চেয়ার থেকে উঠে তাকে সম্মান জানাতেন। তার চলাফেরার স্টাইল দেখে মনে হতো না ভুয়া পরিচয় দিচ্ছে। দিনভর সরকারি এক অফিস থেকে আরেক অফিসে আনাগোনা ছিল। সরকারি অফিসের বড় কর্তাদের সেতুমন্ত্রীর এপিএস ও ছাত্রলীগ নেতার পরিচয় দিতো। টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ, বদলি, পোস্টিং করিয়ে লাখ লাখ টাকা কামিয়েছে বলেও প্রমাণ পেয়েছেন ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ মানবজমিনকে বলেন, প্রতারক মোজাম্মেল হক ইয়াছিন এক সময় ঢাকা কলেজ ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য ছিল বলে আমাদেরকে জানিয়েছে। এছাড়া সেতুমন্ত্রীর এপিএস পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরির তদবির, পোস্টিং, বদলি বাণিজ্য করতো। বিভিন্ন দপ্তরে এপিএস পরিচয় দিয়ে দাপট দেখাতো। সর্বশেষ এলজিইডি’র প্রধান প্রকৌশলীকে একই পরিচয় দিয়ে একজনের চাকরির ব্যবস্থা করেছিল। সন্দেহজনক হওয়াতে তার পরিচয় যাচাই-বাছাই করে তাকে গ্রেপ্তার করেছি। শেরেবাংলা নগর থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, বুধবার সকালেও সে মদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ওই পরিচয়ে ফোন দিয়ে একটি চাকরির সুপারিশ করেছে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর একান্ত সচিব গৌতম চন্দ্র পাল মানবজমিনকে বলেন, ডিবি পুলিশের একজন কর্মকর্তা ফোন করে গতকাল দুপুরে ওই প্রতারকের বিষয়ে জানিয়েছেন। আমরা ওই কর্মকর্তাকে বলেছি মোজাম্মেল হক ইয়াছিন নামে স্যারের (সেতুমন্ত্রী) কোনো এপিএস নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন তাদের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেটিও আমরা বলেছি।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুর রশীদ খান মানবজমিনকে বলেন, যে পরিচয়ে এসে তদবির করেছিল ওই পরিচয়টা ছিল ভুয়া। কারণ সে যার পরিচয় দিয়েছিল ওই ব্যক্তিকে আমি চিনতাম। ক্রস চেক করে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। আমরা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর পর তারাও প্রমাণ পেয়ে তাকে গ্রেপ্তার করেছে।