দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও এখন যাচ্ছে ইয়াবা। জিপিও (জেনারেল পোস্ট অফিস) থেকে ফরেন পার্সেলের মাধ্যমে নিউইয়র্কে ইয়াবার তিনটি চালান গেছে বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। এবার চতুর্থ চালান পাঠানোর সময় গত ৬ ডিসেম্বর পাচারকারী চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে গত শুক্র ও শনিবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এতে বেরিয়ে আসে এসব চমকপ্রদ তথ্য। একই চক্র এর আগে অন্তত তিনবার নিউইয়র্কে ইয়াবার চালান পাঠিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। নিউইয়র্কে প্রতিবারই মিল্টন শিকদার নামে এক ব্যক্তি ইয়াবার এই চালান গ্রহণ করেন। তবে পার্সেলে প্রাপক হিসেবে লেখা থাকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী মিল্টনের স্ত্রী অরিন মেহজাবিনের নাম। জানা গেছে, মিল্টন শিকদারের আপন ভাই মোস্তফা জামাল মিলন শিকদার বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়রের একান্ত সচিব। এই ঘটনায় মিলন শিকদারের ভূমিকা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল রাতে মোস্তফা জামাল মিলন শিকদার সমকালকে জানান, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। পুলিশও তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। তবে তিনি স্বীকার করেন, তার ছোট ভাই মিল্টন শিকদার স্ত্রীসহ নিউইয়র্কে থাকেন প্রায় দশ বছর ধরে। তবে মিল্টন তার ভাইয়ের ডাক নাম। আর শিকদার বংশের পদবি। ঢাকা মহানগর পুলিশের খিলগাঁও জোনের সহকারী কমিশনার জুলফিকার আলী সমকালকে বলেন, বিদেশে ইয়াবার চালান পাঠানোর নেপথ্যে আরও কারা রয়েছে তা বের করার চেষ্টা চলছে। খোঁজা হচ্ছে অর্থের জোগানদাতাদেরও।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই চক্রটি অভিনব কায়দায় কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে ইয়াবা ট্যাবলেট সংগ্রহ বিদেশে পাচার করে। যার কাছ থেকে এই ইয়াবা সংগ্রহ করা হয় তার নাম দ্বীন মোহাব্বত। তিনি টেকনাফের চিহ্নিত একজন ইয়াবা কারবারি। তারা শুধু দেশের অভ্যন্তরে ইয়াবা বিক্রি করেন না, সরকারি প্রতিষ্ঠান জিপিও’র মাধ্যমে পার্সেল আকারে বিভিন্ন দেশে পাঠান। এই চক্রের কারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। গ্রেপ্তার আসামিরা মাদক কারবার ছাড়াও আর কী ধরনের অপরাধে জড়িত তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা জানান, এ ঘটনায় জড়িতদের জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে কতগুলো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে তা সরবরাহ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপককে (ফিন্যান্সিয়াল ইউনিট) নির্দেশ দিতে আদালতের কাছে আবেদন করেছে পুলিশ। মামলা-সংক্রান্ত আসামিদের জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে কতগুলো মোবাইল সিম রেজিস্ট্রেশন করা আছে তাও সরবরাহ করতে এলআইসিকে আদেশ প্রদানের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়। এছাড়া অরিন মেহজাবিনের ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য এআইজি (এনসিবি) বরাবর আবেদন করা হয়েছে। জিপিও তথ্য দিয়ে যাতে সহযোগিতা করে সে বিষয়েও আদালতের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া জব্দ করা ৪টি মোবাইল ফোন সেটের ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য অনুমতি চাওয়া হয় আদালতে।
৬ ডিসেম্বর রাজধানীর খিলগাঁও থেকে চার মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছে পাওয়া যায় ৮০ পিস ইয়াবা। তবে জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র থেকে জিপিওর মাধ্যমে পাঠানো নিউইয়র্কগামী একটি পার্সেল আটকে দেওয়া হয়। ওই পার্সেল খুলে পাওয়া যায় তিনটি ফুল প্যান্ট, একটি থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ও শিশুদের একটি জুতা। তবে তখনও ইয়াবা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এক পর্যায়ে সেলাই খুলে দেখা যায়, অভিনব কৌশলে সরু পলিথিনের ভেতর একটির পর একটি ইয়াবা সাজিয়ে বেল্টের মতো তৈরি করা হয়েছে। একে একে এমন ৬৮টি ইয়াবার বেল্ট পাওয়া যায়। শিশুর এক পাটি জুতা কোনো কোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধারণা পুলিশের। চালানটি খুলে পাওয়া যায় মোট দুই হাজার ৪০ পিস ইয়াবা।
এখন পর্যন্ত যে চারজন বিদেশে ইয়াবা কারবারি হিসেবে শনাক্ত হয়ে বাংলাদেশে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন তারা হলেন- নাহিদ পারভেজ তাহিন, মিজানুর রহমান জুয়েল, এনাম হোসেন খান রাহাত ও রাজিব শিকদার। মূলত দেশে এই চারজনের মূল হোতা হিসেবে পরিচিত রাজিব। মিল্টন শিকদার ও মিলন শিকদারের চাচাত ভাই এই রাজিব শিকদার।
রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠানো পার্সেলে প্রেরকের নাম লেখা রয়েছে রাজিব শিকদার। তার ঠিকানা দেওয়া হয়েছে মতিঝিলের এজিবি কলোনি। অন্যদিকে পার্সেলের প্রাপক অরিন মেহজাবিন। তার ঠিকানা ৪৩ স্ট্রিট উডসাইড, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। নিয়ম অনুযায়ী পার্সেলে দু’জনেরই ফোন নম্বর দেওয়া ছিল।
একাধিক সূত্র জানায়, জিপিও থেকে কৌশলে ইয়াবার পার্সেল পাঠানো হলেও কেন তা স্ক্যানারে ধরা পড়েনি সেই অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। স্ক্যানার মেশিনটি ইচ্ছে করেই অকেজো করে রাখা হয়েছিল কিনা তারও তদন্ত শুরু হয়েছে। হয়তো মাদক কারবারিদের সুযোগ করে দিতেই এই আয়োজন। ইয়াবা কারবারের মাধ্যমে নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত ডাক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার রাষ্ট্রবিরোধী কোনো গভীর ষড়যন্ত্রে এই সিন্ডিকেট জড়িত কিনা তারও তদন্ত করছে পুলিশ।
সাহাদাত হোসেন পরশ