বাংলাদেশে প্রবেশ করতে হলে কভিড সনদ নেগেটিভ থাকা বাধ্যতামূলক। গত ৩ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা আরোপ করার পরও দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনস কভিড সনদবিহীন বা কভিড রোগী যাত্রীদের বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। একপর্যায়ে এসব এয়ারলাইনসকে জরিমানা করতে শুরু করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
গত ১৫ ডিসেম্বর কভিড সনদবিহীন যাত্রী পরিবহন এবং কভিড রোগী নিয়ে বাংলাদেশে আসার কারণে সৌদি এয়ারলাইনসের কয়েকজন ক্রু আটক করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমগ্রেশন পুলিশ। এ সময় বিমানবন্দরে কর্মরত সৌদি এয়ারলাইনসের স্টাফদেরও আটক করা হয়। পরে সৌদি এয়ারলাইনসের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা আদায় করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় বেজায় চটেছে সৌদি সরকার। তারা কূটনৈতিক চ্যানেলে বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছে এবং অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে দেশটি অতীতের বিভিন্ন রেফারেন্স টেনে এনে বলেছে এভাবে চলতে থাকলে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ব্যাহত হতে পারে। সৌদির প্রতিবাদে বাংলাদেশ সরকার বিব্রত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সৌদি সরকারের কড়া মনোভাব টের পেয়ে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব এবং সিভিল এভিয়েশন অথরিটির চেয়ারম্যানকে এক চিঠিতে বলেছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক খেয়াল রাখা প্রয়োজন। পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেছেন, বাংলাদেশ-সৌদি আরব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় এবং ক্রমাগত তা বাড়ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সৌদি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ পরিস্থিতিতে ইমিগ্রেশন পুলিশের সৌদি এয়ারলাইনসের ক্রু ও স্টাফদের আটক এবং জরিমানা আদায় সাপেক্ষে মুক্তি দেওয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সিভিল এভিয়েশন অথরিটির চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান গতকাল মঙ্গলবার রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, এতে দুই দেশের সম্পর্ক নষ্ট হবে না। একটি বাণিজ্যিক বিমান সংস্থা এভাবে যাত্রী আনতে পারে না। বিষয়টি সৌদি আরবকে বোঝাতে হবে। উভয় দেশকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মানতে হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগামী মাসে বাংলাদেশে আসতে পারেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। এসব বৈঠকে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও সহযোগিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হবে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে সৌদি এয়ারলাইনসের ক্রুদের আটক করার বিষয়টি হতাশাজনক। এসব কর্মকর্তা আরও জানিয়েছেন, সৌদি আরব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। দেশটিতে ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশি বাস করে। জর্ডান, লেবাননে থাকলেও সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি নারী শ্রমিক রয়েছেন সৌদি আরবে। এসব নারী শ্রমিকের সঙ্গে পুরুষ শ্রমিক রপ্তানিরও সম্পর্ক রয়েছে। সৌদি আরবের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে এর ফলাফল কী হতে পারে তা বিবেচনায় নিতে হবে। তাছাড়া কভিডের কারণে দীর্ঘদিন ধরে কিছু নারী শ্রমিক ওই দেশের ফিমেল ডিপোর্টেশন সেন্টার ও সেফ হোমে রয়েছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কভিড পরীক্ষা করা দরকার। আটকেপড়া এসব নারী শ্রমিকের কভিড পরীক্ষার খরচ কে দেবে? সৌদি আরবের দৃষ্টিতে এসব শ্রমিক অবৈধ। তাই এসব শ্রমিকের কভিড পরীক্ষার খরচ তারা বহন করবে না। বেসরকারি পর্যায়ে এসব নারী শ্রমিকের কভিড পরীক্ষা করতে হলে জনপ্রতি সর্বোচ্চ দুই হাজার রিয়াল দরকার। সম্প্রতি সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, এসব নারী কর্মীর কভিড পরীক্ষার কোনো বরাদ্দ তাদের নেই।
বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রতি মাসেই কিছু না কিছু নারী শ্রমিক সৌদি আরব থেকে ফিরে আসেন। ভিটামাটি বিক্রি করে সহায়-সম্বলহীন এসব নারী সে দেশে যান। তাদের কাজের উন্নত পরিবেশ, পর্যাপ্ত বেতনভাতা এসব বিষয় মীমাংসা করার জন্য সৌদি আরবের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক দরকার।
নিয়ম অনুযায়ী বিদেশ থেকে কেউ দেশে এলে তার করোনা নেগেটিভ সনদ থাকা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে আসার আগে সব যাত্রীকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পিসিআর ল্যাবে করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। শুধু নেগেটিভ সনদ থাকলেই তারা বাংলাদেশে আসার অনুমতি পাবেন। আর বিমানবন্দরে যাত্রীদের সেই মেডিকেল সনদ দেখাতে হবে। এ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও বিমান সংস্থাগুলো সেটি মানছে না। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিএমইটি কার্ডধারী বাংলাদেশি কর্মীরা যে দেশে আছেন সেখানকার পিসিআর ল্যাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা সহজলভ্য না হলে তারা অ্যান্টিজেন বা অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য পরীক্ষার সনদ নিয়ে দেশে আসতে পারবেন। এছাড়া বিমানবন্দরে কর্মরতদের শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করাসহ যাত্রী, ক্রু ও উড়োজাহাজ জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়া যথাযথভাবে করতে হবে। কিন্তু অনেক বিমান সংস্থা এ নির্দেশনা মানছে না। সম্প্রতি ১০টির বেশি এয়ারলাইনসের মাধ্যমে পাঁচশোর বেশি যাত্রী করোনা সনদ ছাড়াই শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করেন। কিছুদিন আগে সৌদি এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে মকবুল ও মহসিন নামে দুই যাত্রী করোনা পজিটিভ সার্টিফিকেট থাকার পরও দেশে আসেন। পরে তাদের বিমানবন্দর থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়।
স্বাস্থ্যবিধি না মানায় সৌদি এয়ারলাইনসকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করেছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মোবাইল কোর্ট। গত ১৫ ডিসেম্বর এ জরিমানা করা হয়। এর আগের দিন ১৪ ডিসেম্বর ২৫৯ জন যাত্রী নিয়ে সৌদি এয়ারলাইনসেরই একটি বিশেষ ফ্লাইট ঢাকায় আসে। ওই ফ্লাইটের কোনো যাত্রীর কাছে কভিড পরীক্ষার সনদ ছিল না। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় অবতরণ করা সৌদি এয়ারলাইনসের আরও দুটি ফ্লাইটে যথাক্রমে ৩ ও ২৫৪ জন যাত্রী আসেন কভিড পরীক্ষার সনদ ছাড়াই।
সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, সিভিল এভিয়েশন অথরিটির নীতিমালা ছাড়া যাত্রী আনতে হলে বিশেষ ছাড়পত্র থাকতে হবে। কিন্তু সৌদি এয়ারলাইনসের কর্মীরা অনুমতিপত্র বা ছাড়পত্র কিছুই দেখাতে পারেননি। তিনটি ফ্লাইটের কভিড সনদবিহীন ৫১৬ জন যাত্রী প্রায় এক কাপড়ে ঢাকায় এসেছেন। কেউ কেউ খালি পায়ে এসেছেন, অনেকের শীতের কাপড়ও ছিল না। সৌদি আরবের কারাগারে সাজা খেটে দেশে ফিরেছেন তারা। কভিড সংক্রমণ ঠেকাতে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ বিমানসহ সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে সৌদি আরব। হজ হয়েছে সীমিত পরিসরে। ওমরাহ পালনের সুযোগ এখনো সীমিত। এ অবস্থায় সৌদি এয়ারলাইনস যখন কভিড পরীক্ষা ছাড়া শত শত যাত্রী বিমানে তোলে এবং তাদের পাইলট ও কেবিন ক্রুরা সেসব যাত্রীর সঙ্গে ছয় ঘণ্টা আকাশযাত্রা করেন, তখন আমরা বিস্মিত হই। শুধু সৌদি এয়ারলাইনসই নয়, এসব কারণে গত কয়েক দিনে দেশি-বিদেশি মোট ১০টি এয়ারলাইনসকে মোবাইল কোর্টের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে।