ভোরের আলো ডেস্ক: সিএমএসডির সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহ মৃত্যুর আগে লিখিতভাবে সরকারকে জানিয়েছিলেন, কেনাকাটায় অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির কারণ, স্বাস্থ্য খাত ‘মিঠুচক্র’–এর কবজায়। এরপরই মূলত রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) বেশ কয়েকটি সংস্থা নড়েচড়ে বসে। তবে তত দিনে মিঠুচক্রের প্রধান মোতাজজেরুল ইসলাম ওরফে মিঠু বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক শহীদউল্লাহ গত ২৫ জুলাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এর আগে ৩০ মে জনপ্রশাসন সচিবকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, মোতাজজেরুল ওরফে মিঠু সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে বাজেট থেকে শুরু করে কেনাকাটার পরিকল্পনাও তৈরি করেন। তারপর সেই তালিকা ধরে সিএমএসডিকে দিয়ে জিনিসপত্র কেনান। নামে-বেনামে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে তাঁর। ঘুরেফিরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোই দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়।
প্রয়াত শহীদউল্লাহ আরও জানান, সিএমএসডি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য কিছু যন্ত্রপাতি কেনাকাটার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। একটি প্রতিষ্ঠান কাজ শেষ করে সাড়ে চার শ কোটি টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আবিষ্কার হয় যে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে যন্ত্রপাতিই পৌঁছায়নি। এই প্রতিষ্ঠানটিসহ যত প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল, প্রতিটিরই মালিক মোতাজজেরুল ওরফে মিঠু।
মোতাজজেরুল স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটা থেকে গত ১০ বছরে ঠিক কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারছেন না। কারণ, এ ব্যাপারে কখনোই কোনো তদন্ত হয়নি। প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় খরচ হয় সাত–আট শ কোটি টাকা। এর বাইরেও প্রকল্পভিত্তিক কেনাকাটা হয়। আ ফ ম রুহুল হক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ওই সময়ের ১৮টি মেডিকেল কলেজে যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ পান মোতাজজেরুল ওরফে মিঠু।
তিনি এখন কোথায়? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালে পানামা পেপারসে নাম ওঠা মোতাজজেরুল ওরফে মিঠু বিনিয়োগকারী কোটায় এখন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। নিউইয়র্কের কাছে ব্রংসভিল নামের অভিজাত একটি এলাকায় বাড়ি কিনেছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই বাড়ির দাম দুই মিলিয়ন ডলারের বেশি (১৬ কোটি টাকা)। আটলান্টায় ‘মোটেল সিক্স’ নামে একটি বিলাসবহুল মোটেলের তিনি অংশীদার। অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবসার কাজে তাঁর ঘনঘন যাতায়াত আছে। চড়েন রোলস রয়েসে। ঢাকায় তাঁর মূল প্রতিষ্ঠান লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজসহ নামে-বেনামে থাকা বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো আপাতত কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে।
সিএমএসডির বর্তমান পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর মিঠুচক্রের কাউকে সিএমএসডিতে দেখেননি।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মোতাজজেরুল ওরফে মিঠুকে আর পাওয়া যাবে না, এটা নিশ্চিত হয়েই সিএমএসডির সদ্য প্রয়াত পরিচালকের অভিযোগ খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কারণ, সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের অব্যাহত আশীর্বাদ তিনি পেয়ে আসছেন। এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে দুদক তথ্য সংগ্রহ করেছিল, দোষ খুঁজে পায়নি।
তিনি এখন কোথায়? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালে পানামা পেপারসে নাম ওঠা মোতাজজেরুল ওরফে মিঠু বিনিয়োগকারী কোটায় এখন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। নিউইয়র্কের কাছে ব্রংসভিল নামের অভিজাত একটি এলাকায় বাড়ি কিনেছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই বাড়ির দাম দুই মিলিয়ন ডলারের বেশি (১৬ কোটি টাকা)। আটলান্টায় ‘মোটেল সিক্স’ নামে একটি বিলাসবহুল মোটেলের তিনি অংশীদার। অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবসার কাজে তাঁর ঘনঘন যাতায়াত আছে। চড়েন রোলস রয়েসে। ঢাকায় তাঁর মূল প্রতিষ্ঠান লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজসহ নামে-বেনামে থাকা বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো আপাতত কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে।
সিএমএসডির বর্তমান পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর মিঠুচক্রের কাউকে সিএমএসডিতে দেখেননি।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মোতাজজেরুল ওরফে মিঠুকে আর পাওয়া যাবে না, এটা নিশ্চিত হয়েই সিএমএসডির সদ্য প্রয়াত পরিচালকের অভিযোগ খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কারণ, সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের অব্যাহত আশীর্বাদ তিনি পেয়ে আসছেন। এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে দুদক তথ্য সংগ্রহ করেছিল, দোষ খুঁজে পায়নি।
কাগজপত্রে দেখা যায়, মোতাজজেরুল ওরফে মিঠুর ব্যাপারে তদন্তের শুরু ২০১৩ সালে। মহাহিসাব নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে শুধু মুগদা হাসপাতালে ৩০০ কোটি টাকা গরমিলের অভিযোগ ওঠার পর দুদক কিছুদিন খোঁজখবর করেছিল। ২০১৬ সালে বিদেশে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচারের অভিযোগে পানামা পেপারসে তাঁর নাম উঠেছিল। ২০১৭ সালে দুদক তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কোনো প্রমাণ খুঁজে না পেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দেয়।
সরকার মোতাজজেরুলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে কতটা মনোযোগী জানতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা দিলেও সাড়া দেননি। জানা গেছে, শুধু বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী নন, আওয়ামী লীগ আমলের আগের স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের সঙ্গেও মোতাজজেরুলের সুসম্পর্ক ছিল।
কে এই মিঠু, কীভাবে কবজায় নিলেন সব
মোতাজজেরুল ইসলাম ‘মিঠু কন্ট্রাক্টর’ নামে পরিচিত। বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহীপুরে তিস্তা নদীর পারে। মোতাজজেরুলের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি এসএসসি পাসের পর আর লেখাপড়া করেছেন এমন কোনো খবর নেই তাঁদের কাছে। স্থানীয় সরকার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ছোটখাটো ঠিকাদারি করতেন।
রংপুরে অনেক ভূসম্পত্তির মালিক হয়েছেন মোতাজজেরুল। নামে-বেনামে চরে জমিজিরাত আছে। রংপুর মেডিকেলের পূর্ব দিকের ফটকের পাশে আধুনিক একটি তিনতলা ভবন, শহরের বাবু খাঁ এলাকায় জমি ও ধাপ এলাকায় একটি বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে এখন। বাবা কছিরউদ্দীনের নামে একটি বেসরকারি হাসপাতাল করেছেন। শহরের ধাপ এলাকায় একটি বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। বাবু খাঁ এলাকায় একটি সড়কের নাম এখন ভিআইপি মোতাজজেরুল ইসলাম মিঠু সড়ক।
গোয়েন্দা সংস্থা ও বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, স্বাস্থ্য খাতের ঠিকাদারিতে তাঁর প্রবেশ সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হকের হাত ধরে। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রুহুল হকের ছেলে জিয়াউল হকের সঙ্গে ২০১১ সালে শ্যামলীর রিং রোডে চালু করেন ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ। অনুমোদন না নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সে সময় মামলা করেছিল কলেজটির বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমালোচনার মুখে জিয়াউল হক পরে তাঁর শেয়ার প্রত্যাহার করে নেন। পরের দুই দফায় মন্ত্রী পরিবর্তন হলেও মোতাজজেরুল ইসলামের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
মোতাজজেরুল কীভাবে স্বাস্থ্য খাত নিজের কবজায় নিয়েছেন, সে সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) প্রয়াত পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহ জনপ্রশাসনসচিবকে লেখা চিঠিতে বলেন, গত বছরের ২২ নভেম্বর পরিচালক পদে তিনি যোগ দেন। তখনই তাঁকে একটি কেনাকাটার তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব সিরাজুল ইসলাম তাঁকে মৌখিকভাবে জানান, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তাঁর ছেলের রিকোয়েস্ট আছে। তালিকা ও প্রাইস লিস্ট অনুযায়ী কেনাকাটার ব্যবস্থা চূড়ান্ত করতে হবে।’ প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের আমলেও কেনাকাটায় মিঠুচক্রের একচেটিয়া প্রভাব ছিল।
অতিরিক্ত সচিব সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় তাঁকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে বদলি করে দেওয়া হয়। গতকাল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
সিএমএসডির সব কেনাকাটায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন, তাই এসব জায়গায় মিঠুচক্র তাদের পছন্দনীয় কর্মকর্তাদের বদলির ব্যবস্থা করে। এমনকি কেনাকাটার প্রক্রিয়া মনমতো না হলে অনেক সময় ক্রয়াদেশ বাতিলও করতে হয়েছে। প্রয়োজনে কর্মকর্তাদের বদলিও করা হয়েছে।
মো. শহীদউল্লাহর চিঠিতে আরও বলা হয়েছিল, মোতাজজেরুল একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। এর নাম মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেড, যার পরিচালক হুমায়ূন কবির ওরফে পিটু। এই হুমায়ূনই আগে লেক্সিকোন নামে মোতাজজেরুলের একটি প্রতিষ্ঠানে ছিলেন।
চিঠি থেকে জানা যায়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব সিরাজুল ইসলাম সিএমএসডির পরিচালককে মৌখিকভাবে জানান, কোভিড-১৯–এর জন্য নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) স্থাপনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনতে হবে। এ জন্য মেডিটেক ইমেজিং যেসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে পারে, সেসব যন্ত্রপাতির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর অনেক প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়। মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেডের যন্ত্রপাতির দাম বেশি ও মান খারাপ হওয়ায় তারা তুলনামূলক বিচারে বাদ পড়ে যায়। এতে মোতাজজেরুল ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বলে চিঠিতে বলা হয়।
আন্তর্জাতিক একটি আর্থিক সংস্থার সাবেক একজন কর্মকর্তা কাছ থেকে মোতাজজেরুল ওরফে মিঠুর উত্থান দেখেছেন। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আ ফ ম রুহুল হকের সঙ্গে মোতাজজেরুলের সুসম্পর্কের কথা তিনি শোনেন ২০০৯-১০ সালে। প্রায় সব সময় মন্ত্রীর অফিসে তাঁকে দেখা যেত। সে সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক এ বি এম আবদুল হান্নান পরিচিত ছিলেন মিঠুচক্রের লোক হিসেবে। দেখা যেত মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর থেকে চাহিদাপত্র তৈরি করে সারা দেশের হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ককে পাঠানো হতো ও চাপ দেওয়া হতো সেটি ঢাকায় পাঠানোর জন্য। তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সচিব মো. হুমায়ুন কবীর বড় কিছু কেনাকাটার বিল আটকে দেওয়ায় মন্ত্রী তাঁর ওপর খেপে যান। পরে তাঁকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরে যেতে হয়। হুমায়ূন কবীর পরে পদত্যাগ করেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, মোহাম্মদ নাসিমের সময়েও একই রকম সুবিধা তিনি পেয়েছেন। ১০-১২টি প্রতিষ্ঠান খুলে তিনি একাই সব কাজ বাগিয়েছেন।
২০১৬ সালে দুদক মোতাজজেরুল ও তাঁর স্বজনদের মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে জানতে চেয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ছাড়াও লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ অ্যান্ড টেকনোট্রেড, সিআর মার্চেন্ডাইজ, এল আর এভিয়েশন, জিইএফ অ্যান্ড ট্রেডিং, মেহেরবা ইন্টারন্যশনাল, ক্রিয়েটিভ ট্রেড, ফিউচার ট্রেড, লেক্সিকোন আইটি, টেকনোট্রেড, বেল্লায়ের এভিয়েশন, জিইএস অ্যান্ড ট্রেডিং, হেভ ইন্টারন্যাশনাল, লেক্সিকোন হসপিটালেট, নর্থটেক লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান।
স্বাস্থ্য খাতের জন্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে থাকেন এমন একজন ঠিকাদারের সঙ্গে কথা হয় ২৯ জুলাই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মিঠুচক্রের দৌরাত্ম্যের কারণে তিনি এখন আর সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করেন না। তাঁর মতো অনেকেই করছেন না।
ওই ঠিকাদার বলেন, সিএমএসডি এমনভাবে বিজ্ঞপ্তি দেয়, যাতে আর কেউ অংশ নিতে পারে না। কখনো একসঙ্গে ২০০ পণ্যের জন্য দর চায়। এ দেশে জিই, ফিলিপস, হিটাচি, তোশিবা, সিমেন্সের কেউ একসঙ্গে এতগুলো পণ্য সরবরাহ করে না। মোতাজজেরুল ওরফে মিঠু একেক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে একেকটি পণ্য কিনে নিয়ে সরকারের কাছে দ্বিগুণ-তিন গুণ দামে একাই বিক্রি করেন। সরাসরি বড় প্রতিষ্ঠানগুলো অংশগ্রহণ করতে না পারায় দাম বেশি পড়ে।
আবার কখনো কখনো মোতাজজেরুল যে যন্ত্রটি দিতে পারবেন, দরপত্র বিজ্ঞপ্তিতে পণ্যের বিবরণে ঠিক ওই যন্ত্রটির যে যে বৈশিষ্ট্য আছে, তার উল্লেখ থাকে। তখন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান আর অংশগ্রহণ করতে পারে না। চলতি বছরও সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একসঙ্গে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি সরবরাহের বিজ্ঞপ্তি এসেছে বলে জানান খ্যাতনামা একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা ওই ঠিকাদার। তিনি জানান, মোতাজজেরুল ওরফে মিঠু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে একাই সব দরপত্রে অংশ নেন।
সরকারের সবই জানা
দুর্নীতির এসব তথ্য সরকারের অজানা নয়। এর আগে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে মুগদা হাসপাতালে ২০১৩-১৪ সালে ৩০০ কোটি টাকার গরমিলের খবর পাওয়া যায়। ওই সময় তিনটি প্যাকেজে ও পাঁচটি লটে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছিল মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে ফিউচার ট্রেড, জিইএস অ্যান্ড ট্রেডিং, থ্রিÊআই, আরডেন্ট সিস্টেম, বায়োটেক ইন্টারন্যাশনাল, মার্কেট ল্যাব, মেড ইকুইপ এবং ইনফরমড টেকনোলজি দরপত্র কেনে। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রথম তিনটি যোগ্য ঘোষিত হয়। শেষ পর্যন্ত ফিউচার ট্রেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মোতাজজেরুলের স্ত্রী নিশাত ফারজানা। দরদাতা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোরও মালিক ছিলেন মোতাজজেরুল।
ওই সময় এ নিয়ে প্রথম আলো ‘৪০০ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছেপেছিল।
মোতাজজেরুল ওরফে মিঠুকে চেনেন কি না জানতে চাইলে আ ফ ম রুহুল হক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘আমি চিকিৎসকদের প্রমোশন দিয়েছি, কমিউনিটি ক্লিনিক দিয়েছি, সেসব দেখে না, দেখে মিঠুকে। আমি মিঠুকে চিনি না। আমি কোনো কন্ট্রাক্টরকেই চিনি না।’
ধরাছোঁয়ার বাইরে কেন
একটি সংস্থার নথিতে দেখা যাচ্ছে, আ ফ ম রুহুল হকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে মিঠু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ঢুকলেও পরে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল তাঁর।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক একজন কর্মকর্তা বলেন, মোতাজজেরুল ওরফে মিঠুর বদনাম থাকায় মোহাম্মদ নাসিম প্রথম দিকে তাঁকে একটু এড়িয়ে চলেন। এ সময় মোতাজজেরুল ওরফে মিঠু একটি বাহিনীকে বিনা পয়সায় নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র তৈরি করে দেন। সেটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হাজির ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে মোতাজজেরুল ছবিও তোলেন। তবে মোহাম্মদ নাসিম সেখানে ছিলেন না। মোতাজজেরুল ওরফে মিঠু একপর্যায়ে মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে তমাল মনসুরের সঙ্গে যোগাযোগ করে আবার স্বাস্থ্যের কেনাকাটায় যুক্ত হয়ে যান। মোহাম্মদ নাসিমের একান্ত সচিব (এপিএস) মীর মোশাররফ হোসেনের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল তাঁর। তমাল মনসুর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। মেসেঞ্জারে তাঁর বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়েছে। তিনি কোনো জবাব দেননি।
সিরাজগঞ্জে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য নিম্নমানের ব্যবহারের অনুপযোগী যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ২৭৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে দুদকের তদন্তে। এতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে মীর মোশাররফ হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় গত বছর।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি নথিতে বলা হয়, দুদকের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার সঙ্গে মোতাজজেরুল ওরফে মিঠুর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। ওই কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী স্ত্রী, কন্যা ও জামাতার দেখভাল করেন মোতাজজেরুল। ওই কর্মকর্তার ভাইয়ের মোতাজজেরুল ওরফে মিঠুর অফিসে নিয়মিত যাতায়াত আছে।
এ বিষয়ে জানতে মোতাজজেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর ব্যাপারে খোঁজখবর রাখেন এমন একাধিক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেছেন, সরকারের প্রভাবশালী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেরই পরিবার-পরিজন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তাঁদের হাতে রেখে কাজ উদ্ধারের কৌশল রপ্ত করেছেন তিনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দীন খান বলেন, এটা আসলে একটা কৌশল। তিনি বিদেশে চলে গেছেন বলেই এখন তোড়জোড়। করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির অনেক খবর এসেছে। সেগুলোয় সরকারের যে সাড়া, তা আশাপ্রদ নয়। তিনি মনে করেন, মোতাজজেরুলকে নোটিশ দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। তদন্ত করে যদি দেখা যায় তিনি দোষী, তাহলে তাঁর এখানকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হোক এবং তাঁকে আইনের অধীনে আনা হোক।