তেজগাঁওয়ের গ্রামীণফোনের সার্ভিস সেন্টারে কর্মরত এক কর্মীর সহযোগিতায় সার্ভার থেকে গ্রাহকের তথ্য চুরির পর তাদের ব্ল্যাকমেইল করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত একটি চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকার হাতিরঝিল থানা পুলিশ। ওই চক্রের নেতৃত্বে ছিলেন পারভীন আক্তার নূপুর নামে এক নারী।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, দৃশ্যমান কোনও পেশা না থাকলেও সপ্তম শ্রেণি পাস নূপুর থাকেন গুলশানের নিকেতনে। তার ফ্ল্যাট ভাড়া মাসে লাখ টাকা। তার মেয়ের স্কুলের বেতন প্রতিমাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা। সে বনানীর ১১নং রোডের ই-ব্লকের গ্রিন ডিলাক্স হাউজ নামের একটি জিমে নিয়মিত যায়। সেখানে প্রতিমাসে ৩০ হাজার টাকা বিল দেয়। গুলশান থানায় সে একবার অভিযোগ করেছিল যে তার ৬টি লিপস্টিক চুরি হয়েছে, যেগুলোর দাম ৯০ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে বুধবার (৯ ডিসেম্বর) তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চক্রটির নেতৃত্বে রয়েছে পারভীন আক্তার নূপুর। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করে। তার টার্গেট ছিল মূলত ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরা। টার্গেট করা ব্যক্তির সব ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে পরিবারের সব সদস্যকে জানিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে পাঁচ লাখ থেকে শুরু করে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে সে।’
জানা গেছে, এমনকি ভুয়া আইনজীবীর মাধ্যমে ফোন করে নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণ মামলার হুমকি দিয়ে ভয় দেখানো হয়। এই চক্রকে টার্গেট করা ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহ করে গ্রামীণফোনের সার্ভিস সেন্টারের কর্মী রুবেল মাহমুদ অনিক। চক্রের প্রধান পারভীন আক্তার নূপুর, তার বোন শেফালি বেগম, গ্রামীণফোনের কর্মী রুবেল মাহমুদ অনিক এবং নূপুরের সহযোগী শামসুদ্দোহা খান বাবু নামে ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরপরই বেরিয়ে এসেছে এ ধরনের ভয়ঙ্কর প্রতারণার নানা তথ্য।
প্রতারক পক্রের চার সদস্য
গত বৃহস্পতিবার থেকে রবিবারের মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, হাতিরঝিল ও বাড্ডা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। হাতিরঝিল থানায় দায়ের করা প্রতারণা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুই মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আইনজীবী পরিচয়দানকারী ইসা নামে চক্রের এক সদস্য এখনও পলাতক।
৫-৬ সদস্যের এই সংঘবদ্ধ চক্রটি উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের টার্গেট করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ষাটোর্ধ্ব বয়সের লোকজনই তাদের মূল টার্গেট। চক্রের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার ২০-২৫ জনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে।
যেভাবে ব্ল্যাকমেইল করা হয়
গ্রামীণফোনের সার্ভিস সেন্টারের কর্মী রুবেল মাহমুদ অনিক ও ট্রাভেল এজেন্সিতে কর্মরত শামসুদ্দোহা খান বাবুর সঙ্গে নূপুরের সখ্য রয়েছে। অনিক ও বাবু নূপুরকে বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তির মোবাইল নম্বর দিয়ে সহযোগিতা করে। এরপর নূপুর নিজেকে কখনও সমাজকর্মী কখনও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য তহবিল সংগ্রহকারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য তহবিল সংগ্রহে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে, চাকরির প্রার্থী বা সাংবাদিক পরিচয়ে এসব ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি দেখা করে। নানা অজুহাতে টার্গেট করা ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে। অনেক সময় ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর বা গোপন কথা বলে তা মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে। এমনকি মোবাইল ফোনে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে নূপুর। বয়স্ক ব্যক্তিদের টার্গেট করে এমন প্রেমের সম্পর্ক করে। পরবর্তীতে ওই ব্যক্তির পরিবারকে সব জানিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করে।
অনিক
এদিকে এসব ব্যক্তির মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে নূপুরকে গ্রামীণফোন সার্ভিস সেন্টারে কর্মরত রুবেল তাদের ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহ করে। বিস্তারিত এসব তথ্য নিয়ে নূপুর ওইসব ব্যক্তিকে হুমকি দিতে থাকে। নূপুরের চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে এমন হুমকি অব্যাহত থাকে। এমনকি তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে এমন কথা পরিবারের সদস্যদের জানানোর হুমকি দেওয়া হয়। দাবিকৃত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে নূপুরের বড়বোন শেফালী টার্গেট করা ব্যক্তিকে ফোন করে মামলার হুমকি দেয়। অনেকেই সম্মানের ভয়ে দাবিকৃত টাকা দিয়ে দেন। তবে কেউ দাবিকৃত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আইনজীবী পরিচয় দিয়ে ইসা নামে অপর এক সদস্য ওই ব্যক্তিকে ফোন করে মিথ্যা ও বানোয়াট ধর্ষণ মামলা বা নারী নির্যাতন মামলা করার হুমকি দেয়। ইসা বিভিন্ন মিথ্যা ও বানোয়াট বিল ভাউচার তৈরি করার কথাও জানায়। এমনকি শারীরিক অসুস্থতার অজুহাতে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী টার্গেট করা ব্যক্তিকে ফাঁসানোর জন্য নামকরা চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে প্রেসক্রিপশনে স্বামীর নাম অপশনে ওই ব্যক্তির (টার্গেট) নাম লিখে আনে নূপুর।
কয়েক মাসে পারভীন তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর এবং আরও কয়েকটি মোবাইল নম্বর থেকে ১৫-২০ জন ব্যক্তিকে টার্গেট করে ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অংকের অর্থ আদায় করেছে। এমনকি রুবেলের মোবাইল নম্বরে এসএমএসের মাধ্যমে ৬টি গ্রামীণফোন নম্বর পাঠিয়ে মোবাইল নম্বরধারী ব্যক্তির সিম রেজিস্ট্রেশন তথ্য (নাম, পিতার নাম, ঠিকানা, জন্ম তারিখ, জন্মনিবন্ধন নম্বর) জানতে চায় নূপুর। দশ হাজার টাকার বিনিময়ে রুবেল গ্রামীণফোনের সার্ভার থেকে এ তথ্যগুলো সংগ্রহ করে হাতে লিখে নূপুরকে দেয়।
নূপুরের বোন শেফালী
প্রতারক চক্রের অন্যরা কী করে?
নূপুরের বোন শেফালী ক্লাস থ্রি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। সে চাঁদনী চক মার্কেটে স্কার্ফ, হিজাব ও বোরকার ব্যবসা করে। শামসুদ্দোহা মতিঝিল দৈনিক বাংলা মোড়ে পারফেক্ট ট্রাভেল এজেন্সিতে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে। অবিবাহিত শামসুদ্দোহা মোহাম্মদপুরে শেফালীর ফ্ল্যাটেই থাকে। রুবেল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন নাবিস্কো মোড়ে অবস্থিত গ্রামীণফোন সার্ভিস সেন্টারে কাজ করে। ইসা নিজেকে আইনজীবী ও একটি ল’ ফার্মে কাজ করে বলে পরিচয় দিয়েছে।