সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম ইপিজেডের প্রবাসী বিনিয়োগকারী নাজমুল আবেদিন। একসময় ছিলেন বিদেশি ব্যাংকের কর্মকর্তা। কিন্তু পেশাগত অনিয়মের অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। এর কয়েক বছর পর দেশে ফিরে পোশাক খাতের ব্যবসায় আসেন। এরপর কাঁচামাল আমদানির এলসি ও পরিচালন মূলধন হিসেবে চার ব্যাংক থেকে প্রায় ২৭৭ কোটি টাকা ঋণ নেন। কিন্তু সেই ঋণের অর্থ পরিশোধ না করে এবং শ্রমিকের বেতন, সরবরাহকারীর বকেয়া পাওনা ও সরকারি বিভিন্ন ধরনের চার্জ বকেয়া রেখে আবারও লন্ডনে পালিয়ে গেছেন। তিনি সব মিলিয়ে প্রায় ৩৩০ কোটি টাকা পাওনা পরিশোধ না করে উধাও হলেন, যা রীতিমতো বিস্ময়কর।
ব্যাংক কর্মকর্তা ও ইপিজেড সংশ্লিষ্টরা বলেন, নাজমুল আবেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে পড়াশোনা শেষ করে বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে যোগ দেন। পেশাগত সাফল্যে অল্প সময়ে করপোরেট জগতে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু পেশাগত অনিয়মের অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। এর কয়েক বছর পর দেশে ফিরে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) পোশাক খাতের ব্যবসায় আসেন। এঅ্যান্ডবি আউটফিট, নর্ম আউটফিট লিমিটেড এবং কোল্ড স্কুল প্লে লিমিটেড নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তোলেন।
নিজের ব্যাংকে কাজের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে অল্প মূলধনি প্রতিষ্ঠানকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করে ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের ঋণ হাতিয়ে নেন। এর মধ্যে এঅ্যান্ডবি আউটফিটের কাছে ব্র্যাক ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১০১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের পাওনা রয়েছে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। পাশাপাশি নর্ম আউটফিটের কাছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার প্রায় ৭৫ কোটি ও ওয়ান ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৩৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। অর্থাৎ দেশের চারটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন ২৭৭ কোটি টাকা। একই সঙ্গে তিন পোশাক কারখানার এক হাজার ৯০৮ শ্রমিকের বেতন-ভাতা, বেপজার পাওনা আর অ্যাকসেসরিজ সাপ্লায়ারদের আরও অন্তত ৫৩ কোটি টাকা না দিয়েই গোপনে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী এই ব্যবসায়ী ২০১৯ সালের শুরুর দিকে পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেন।
চট্টগ্রাম ইপিজেডের কর্মকর্তারা বলেন, দেড় বছরের বেশি সময় ধরে মালিকপক্ষের সাড়া না পেয়ে বেপজার পাওনা এবং ১০ মাসের শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থতায় নাজমুল আবেদীনের মালিকানাধীন তিন প্রতিষ্ঠানকে গত ২৩ নভেম্বর নিলামে তুলেছে চট্টগ্রাম ইপিজেড কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে নাজমুলের মালিকানাধীন তিন কারখানা থেকে বেপজার পাওনা দুই কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এছাড়া এক হাজার ৯০৮ শ্রমিকের ৯ মাসের বেতন-ভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ প্রায় ২৫ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। নিলামে আগ্রহী ক্রেতাদের অনুমোদন কমিটি যাচাই-বাছাই করবে। এরপর যোগ্য ক্রেতাকে কারখানাগুলোর মালিকানা হন্তান্তর করা হবে।
অপরদিকে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড ১০১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা পাওনা আদায়ে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করেছে। আর খেলাপি হলেও মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক পাওনা আদায়ে মামলা দায়ের করেনি। যদিও ঋণগ্রহীতা নাজমুল আবেদিন দেশে না থাকায় আইনি পদক্ষেপের পরও এ পাওনা আদায় হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কারণ এ ঋণের বিপরীতে কোনো ব্যাংকের কাছে কোনো সিকিউরিটি জমা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের একাধিক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, নাজমুল আবেদিন একসময় ভালো ব্যাংকার ছিলেন। তিনি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের চৌকস কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু পেশাগত অনিয়মের অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। এর কয়েক বছর পর দেশে ফিরে পোশাক খাতের ব্যবসায় আসেন। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সহজে কোটি কোটি ঋণ নেন, কিন্তু পরে আর ফেরত দেননি, যা কল্পনা করা যায় না।
অপরদিকে মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, নাজমুল আবেদিনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আমাদের খেলাপি গ্রাহক। দেড় বছর আগে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান। তারপর আর দেশে আসেননি। তখন থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এখন ইপিজেড কর্তৃপক্ষ বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো নিলাম বিক্রি করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু আমাদের জানানো হয়নি। অথচ আমরাও তো স্টেকহোল্ডার।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ইপিজেডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ‘প্রথমে তিনি এঅ্যান্ডবি আউটফিট লিমিটেড দিয়ে শুরু করেন। এরপর ২০১৭ সালের শেষ দিকে স্ত্রী সোহেলা আবেদীন ও শ্বশুর একেএম জাহেদ হোসাইনের নামে নর্ম আউটফিট নামের কারখানাটি কিনে নেন নাজমুল। যদিও এঅ্যান্ডবি আউটফিটের সাবকন্ট্রাক্টের কাজ করত নর্ম আউটফিট। সেই প্রতিষ্ঠানটি মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কীভাবে ব্যাংক থেকে ৭৫ কোটি টাকা ঋণ পেল, সেটাই আমাদের কাছে রহস্যজনক। মনে হচ্ছে, নাজমুল কারখানাটি কিনেছেনই ব্যাংকঋণ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে। মনে হচ্ছে তার এমন ইচ্ছা ছিল। এখানে ব্যাংকগুলোর দোষ আছেÑকীভাবে এত টাকা ঋণ দেয়!’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ইপিজেডের জেনারেল ম্যানেজার মসিহউদ্দিন বিন মেসবাহ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নাজমুল আবেদনের মালিকানাধীন এঅ্যান্ডবি আউটফিট, নর্ম আউটফিট লিমিটেড ও কোল্ড স্কুল প্লে লিমিটেড বন্ধ আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের এক হাজার নয়শ’র বেশি শ্রমিকের বেতন বকেয়া রয়েছে। পাশাপাশি আমাদের বিভিন্ন ধরনের চার্জ বকেয়া রয়েছে এবং ব্যাংকের অনেক ঋণ আছে। আর আমাদের পাওনা আদায়ে গত ২৩ নভেম্বর নিলাম প্রক্রিয়া হয়েছে। এতে আগ্রহী ক্রেতা পাওয়া গেছে। এখন কমিটি যাচাই-বাছাই করে মালিকানা হস্তান্তর করবে। তবে এখন ব্যাংকগুলোকে নিলামের বিষয়ে জানানোর সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, নিলামের পাওনা অর্থ প্রথমে আমাদের পাওনা, তারপর শ্রমিকের বকেয়া পাওনা। আর অবশিষ্ট থাকলে তখন অন্যদের পাওনা দেওয়া হবে।’