টাওয়ার কোম্পানির ৩০০ কোটি টাকার শেয়ার আত্মসাৎ

জালিয়াতির মাধ্যমে একটি শীর্ষ টাওয়ার কোম্পানির ৩০০ কোটি টাকার শেয়ার আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) না জানিয়ে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির (আরজেএসসি) একটি সিন্ডিকেট কাজটি করেছে।

এজন্য একটি মামলাও হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এ ঘটনায় ১৭ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। ভুক্তভোগীরা প্রতিকার চেয়ে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন বিটিআরসিতেও। অভিযোগটি তদন্ত করছে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)।

মামলার বাদী ও এবি হাইটেক কনসোর্টিয়ামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, ওয়াশিংটনে বসবাসকারী ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতা এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা।

তিনি কনসোর্টিয়ামের অন্য পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে এই শেয়ার পকেটে পুরেছেন। তার নিজের স্বাক্ষর স্ক্যান করে রেজুলেশন তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই ঘটনায় তারা উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন।

আদালত তাদের কথা শুনে মামলা গ্রহণ করেছেন, শিগগিরই শুনানি হবে। তিনি বলেন, কোর্টের কাছে তার স্বাক্ষরসহ কোনো অর্জিনাল রেজুলেশন দেখাতে পারবে না আসামিরা। এ ধরনের একটি কোম্পানির শেয়ার ও মালিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তদন্ত, কাগজপত্র যাচাই-বাছাইসহ অনেক সময় লাগার কথা ছিল।

কিন্তু রহস্যজনক কারণে আরজেএসসির ইতিহাসে মাত্র একদিনে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে সিন্ডিকেট নতুন কোম্পানির মাধ্যমে একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ২৩২ কোটি ৪০ লাখ টাকার লোন অনুমোদন করিয়ে ফেলছিলেন। পরে তাদের বাধার মুখে ব্যাংক ওই লোন বাতিল করে।

বিটিআরসির মহাপরিচালক লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং মেসবাউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, তিনি এই শাখায় নতুন যোগদান করেছেন। যতটুকু শুনেছেন লাইসেন্স ট্রান্সফারের প্রক্রিয়া তিনি যোগদানের আগেই সম্পন্ন হয়ে গেছে। এ সংক্রান্ত কোনো লিখিত অভিযোগ তিনি পাননি বলেও জানান।

আরজেএসসির নিবন্ধক মকবুল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এবি হাইটেক কনসোর্টিয়ামের শেয়ার ও মালিকানা পরিবর্তনে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। পুরো প্রক্রিয়াটি বৈধ পন্থায় হয়েছে। কোম্পানিটির লাইসেন্সিং অথরিটি হচ্ছে বিটিআরসি।

রেগুলেটরি অথরিটি থেকে নির্দেশনা অনুযায়ী তারা শুধু কোম্পানিটিকে আরজেএসসিতে তালিকাভুক্ত করেছেন। এছাড়া কোম্পানির বর্তমান মালিকানায় যিনি প্রধান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তিনি মালিকানা পরিবর্তন সংক্রান্ত যেসব কাগজপত্র ও ডকুমেন্ট জমা দিয়েছেন, সবই ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সত্যায়িত করে জমা দিয়েছেন।

তবে বিটিআরসির শীর্ষপর্যায়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এবি হাইটেক কনসোর্টিয়ামের শেয়ার পরিবর্তনের বিষয়টি প্রথমে বিটিআরসিকে জানানো হয়নি। এ কারণে কোম্পানিটিকে মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পরে তারা বৈধ কাগজপত্র জমা দিয়ে শেয়ার স্থানান্তরের অনুমোদন নিয়েছেন।

এ নিয়ে কেন মামলা হয়েছে জানতে চাইলে বিটিআরসির ওই কর্মকর্তা বলেন, যারা আগের মালিকানায় ছিলেন, তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে কিংবা লেনদেনে কোনো ধরনের ঝামেলা থাকতে পারে। জানা গেছে, শেয়ার হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে এবি হাইটেক কনসোর্টিয়াম লিমিটেড কোম্পানির নামে মামলা হয়েছে।

২০১৮ সালের ১ নভেম্বর কোম্পানিটির নামে টাওয়ার শেয়ারিং লাইসেন্স ইস্যু করে বিটিআরসি। কনসোর্টিয়ামের কোম্পানিগুলোর মধ্যে এবি হাইটেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে ৯৫ হাজার, এডিএন টেলিকম লিমিটেডের নামে ১ হাজার, জেডএন এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের নামে ১ হাজার, সেনার্জি লজিস্টিকস লিমিটেডের নামে ৫শ’ শেয়ার, অরেঞ্জ ডিজিটাল লিমিটেডের নামে ৫শ’, চায়না কমিউনিকেশন সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে ১ হাজার এবং চ্যাংসু ফেরগপ্যান পাওয়ার ইকুইপমেন্ট কোম্পানির নামে ১ হাজার শেয়ার ছিল।

কিন্তু অভিযোগ উঠেছে কনসোর্টিয়ামের চেয়ারম্যান কোনো ধরনের বোর্ড মিটিং না করে অন্যান্য শেয়ার হোল্ডারদের স্বাক্ষর জাল করে সব শেয়ার আত্মসাৎ করেছেন। তিনি রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির (আরজেএসসি) কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে বেআইনিভাবে মেমোরেন্ডাম অব আর্টিক্যাল ফরম-৮, সিডিউল-১০ ফরম ১২ ও ১৫ পরিবর্তন করে আরজেএসসিতে তালিকাভুক্ত করে ফেলেছেন। একই সঙ্গে এবি হাইটেক ইন্টারন্যাশনালসহ কনসোর্টিয়ামের ৭টি কোম্পানির ৯ লাখ ৫ হাজার শেয়ার ও ৯ লাখ অথরাইজড রিজার্ভ শেয়ার বেআইনিভাবে হস্তান্তর এবং মালিকানা পরিবর্তন করে ফেলেছেন।

পরে নতুন মালিক হিসেবে ডানহিল সার্ভিসেস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানিকে অথরাইজড রিজার্ভ থেকে ৯ লাখ শেয়ার ও আরোসা জনশক্তি লিমিটেডের নামে ৪ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার হস্তান্তর করেন। মামলায় বলা হয়েছে, পুরো এই প্রক্রিয়ায় তারা ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও সরকারের ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত করেছে। এজাহারে আরও বলা হয়েছে, এসব ঘটনায় এবি হাইটেক কনসোর্টিয়ামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান মোল্লার স্বাক্ষর জালিয়াতি করে তিনি পদত্যাগ করছেন বলে পদত্যাগপত্র আরজেএসসিতে দাখিল করা হয়েছে।

একই সঙ্গে ফজলুর রহমান মোল্লাকে কনসোর্টিয়াম থেকে অপসারণ দেখানো হয়েছে। এই ঘটনায় কোনো ধরনের বোর্ড মিটিং করা হয়নি। শুধু ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরই স্বাক্ষরই জাল করেনি সিন্ডিকেট, একে একে ৭ জন পরিচালকের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে মিথ্যা ও ভুয়া রেজুলশন তৈরি করে আরজেএসসিতে জমা দিয়েছে।

মামলায় বলা হয়েছে আসামিরা জালিয়াতি করে কনসোর্টিয়াম থেকে এডিএন টেলিকম, জেডএন এন্টারপ্রাইজ, সেনার্জি লজিস্টিক, অরেঞ্জ ডিজিটাল, চায়না কমিউনিকেশন এবং চ্যাংসু ফেনগফ্যান পাওয়ার ইকুইপমেন্ট কোম্পানিকে বহিষ্কার করে তাদের জায়গায় ডানহিল সার্ভিসেস লিমিটেডকে ১ হাজার শেয়ার, আরোসা জনশক্তির নামে ২৫০০ শেয়ার এবং মেজবা উদ্দিনের নামে ১৫শ’ শেয়ার হস্তান্তর করেন।

মামলার অপর বাদী জেডএন এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং এবি হাইটেক লিমিটেডের পার্টনার আমান উল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, টাওয়ার শেয়ারিং লাইসেন্সের আইন অনুযায়ী লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান মালিকানা বা শেয়ারের কোনো ধরনের পরিবর্তন আনার আগে রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) কাছ থেকে লিখিত অনুমোদন নিতে হয়। কমিশনের অনুমোদন ছাড়া মাালিকানা ও শেয়ারের কোনো ধরনের পরিবর্তন বৈধ বা কার্যকর হবে না।

বিটিআরসির অনুমতি ছাড়া কোনো শেয়ার হস্তান্তর বা নতুন শেয়ার ইস্যু এবং নতুন মালিকানা পরিবর্তন করতে পারবে না। এসব আইন কেউ অমান্য করলে ওই কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, বিটিআরসির আওতাধীন সব ধরনের লাইসেন্সের শেয়ার পরিবর্তনের বিষয়ে এরকম আইন বিটিআরসি থেকে গেজেট আকারে জয়েন স্টক রেজিস্ট্রারকে অবহিত করা থাকলেও তারা বিটিআরসির এই নির্দেশনার তোয়াক্কা করেনি।

এমনকি বিটিআরসির অনুমোদন ব্যতিরেকে মালিকানা পরিবর্তন ও শেয়ার হস্তান্তর করে ফেলেছেন। নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের শেয়ার এবং মালিকানা পরিবর্তনের জন্য মোট ধার্যকৃত মূল্যের ৫.৫ শতাংশ টাকা বিটিআরসিকে পরিশোধ করতে হয়। এই ক্ষেত্রে বিটিআরসির অনুমতি ছাড়া এই শেয়ার হস্তান্তর করে আরজেএসসি সরকারকে ১৭ কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছে।

আমান উল্লাহ চৌধুরী আরও বলেন, শেয়ার হস্তান্তর ও মালিকানা পরিবর্তনের বিষয়টি তারা আগে থেকে লিখিতভাবে আরজেএসসিকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারা রহস্যজনক কারণে ওই আবেদনের কোনো ভ্রুক্ষেপ করেননি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সাব ইন্সপেক্টর সিরাজ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, তিনি তদন্ত শুরু করেছেন। প্রাথমিক কাজ হিসেবে যেসব ডকুমেন্ট ও কাগজপত্র পেয়েছেন, সেগুলো যাচাই-বাছাই করছেন। ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সত্যায়িত কাগজপত্রগুলো ঠিক আছে কি না, তা যাচাই করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। বিটিআরসি এবং আরজেএসসিকেও একইভাবে চিঠি দিয়ে সব ধরনের কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। এগুলো পাওয়ার পরই মূল তদন্ত শুরু করবেন। এ প্রসঙ্গে জানতে এবি হাইটেক কনসোর্টিয়ামের চেয়ারম্যান খালিদ হাসানের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। মুজিব মাসুদ

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ