লিখেছেন রিয়েল্টর শিহাব উদ্দিন
কোভিড-১৯ মহামারীর কবলে পড়ে চাকরিচ্যুত হওয়া বা ব্যবসায় লোকসান এরকম উদাহরণ শুধু কানাডা নয়, পুরো বিশ্ব জুড়েই। যারা বাড়ি কিনেছেন, কিন্তু মর্টগেজ শেষ হয়নি, হঠাৎ করেই আয় অনেকাংশে কমে যাওয়াতে তারা অকূল পাথারে পড়েন কোভিড-১৯ এর ফার্স্ট ওয়েবে। ব্যক্তিগত ও সাংসারিক খরচের বাইরে নিয়মিত মর্টগেজ প্রদান রীতিমতো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় প্রায় সবার ক্ষেত্রেই।
নাগরিকদের এই ঝক্কি থেকে সাময়িক রেহাই দিতে প্রণয়ন করা হয় মর্টগেজ ডিফারেল সিস্টেম। ব্যাংক কর্তৃক প্রণীত এই ব্যবস্থায় একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত সকল প্রকার মর্টগেজ স্থগিত করা হয়েছিল, যাতে সীমিত আয় দিয়েও সমস্যাগ্রস্তরা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারেন। স্থগিতকৃত মর্টগেজ পরবর্তীতে সম্পূর্ণ মেয়াদকালের শেষে যোগ হবে, এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্যাংক তথা আর্থিক প্রতিষ্টান গুলি। সেই সাথে এমন প্রতিশ্রুতিও ছিল যে, যারা ডিফারেল সুবিধা গ্রহণ করবেন, তাদের ক্রেডিট স্কোরে এই সুবিধা নেবার জন্যে কোনো পরিবর্তন হবে না। কিন্তু আসলেই কি ডিফারেল সিস্টেম ভুক্তভোগীদের জন্যে নিঃশর্ত এক আশীর্বাদ হয়ে এসেছে? দুইটা কেস স্টাডি থেকে এ ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে।
সেপ্টেম্বর এর শেষ পর্যন্ত পাওয়া হিসেব অনুযায়ী প্রায় আট লক্ষ কানাডিয়ান মর্টগেজ ডিফারেলের জন্যে আবেদন করেছিলেন। এছাড়াও প্রায় পাঁচ লক্ষ কানাডিয়ান কার লোন, ক্রেডিট কার্ড, লাইন অব ক্রেডিট, পার্সোনাল লোন, স্টুডেন্ট লোন এসব থেকে পেমেন্ট ডিফারেল সুবিধা চেয়েছেন। সাময়িকভাবে এসব পেমেন্ট স্থগিত অনেককেই স্বস্তি দিলেও ডিফারেল মেয়াদ শেষে সবাই খুশি হতে পারছেন না। এর নেপথ্যে রয়েছে ডিফারেল সুবিধার কিছু নেতিবাচক দিক, যা ব্যাংক আগে কখনোই সামনে আনেনি।
প্রথম কেসে এক মর্টগেজ ক্লায়েন্ট কোভিড-১৯ এর কবলে পড়ে অন্যান্য অনেক ভুক্তভোগীদের মত আয়ের এক বড় অংশ হারান। এমতাবস্থায় তার পক্ষে মর্টগেজ আদায় করা কঠিন হয়ে পড়ায় এক পর্যায়ে ডিফারেল সুবিধা গ্রহণ করেন।এদিকে ইন্টারেস্ট রেট নেমে আসাতে বাড়ীটি রিফাইনেন্স করে কম খরচে রেনোভেশনের পরিকল্পনা করেন।দুঃখজনকভাবে, তিনি জানতে পারেন যে ডিফারেল সুবিধা গ্রহণের পর তার অপরিশোধিত ইন্টারেস্ট ক্রমাগত মর্টগেজ ব্যালান্সের সাথে যোগ হয়েছে। ফলস্বরূপ কোন প্রকার রিফাইন্যান্সিংয়ের সুযোগ পাচ্ছেননা। যেখানে তিনি মাত্র ২% এর কম ইন্টারেস্টে পাঁচ বছর মেয়াদি ফিক্সড মর্টগেজ নিতে পারতেন, এখন প্রায় ১০% এর ও বেশি চড়া সুদে পার্সোনাল লোন নেওয়া ছাড়া তার হাতে অন্য কোনও উপায় নেই।
প্রায় একইরকম ভোগান্তির শিকার একজন হেয়ারড্রেসার। উক্ত হেয়ারড্রেসার কোভিড- মহামারির প্রাক্কালে বাধ্য হয়ে উনার পার্লারে তালা ঝুলান। জুনের শেষদিকে অবস্থার উন্নতি হলেও তিনি পুরো সামারজুড়ে পার্লার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। মর্টগেজ ডিফারেল এবং Canada Emergency Benefit-সুবিধা নিয়ে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন বলে শুরুতে খোশমেজাজে থাকলেও অচিরেই এই ভুল ভাঙে যখন ব্যাংক ভদ্রমহিলাকে রিফাইন্যান্সিং সুবিধা প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়।
মর্টগেজ ডিফারেলের এই হিডেন এফেক্ট শুরুতে সবাই অনুধাবন করতে পারেননি। এরকম হবে জানলে বেশিরভাগে সুবিধাভোগীই এই সুবিধা গ্রহণের আগে অনেক চিন্তাভাবনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতেন, যে আসলেই ট্রেন্ড ফলো করে ডিফারেল সুবিধা গ্রহণ লাভজনক হবে কি না। অনেকেই হয়তো খুব বেকায়দায় না পড়লে ডিফারেল সিস্টেমের ধারেকাছেও যেতেননা। দূরদৃষ্টির অভাবে অনেকেই ব্যাংকিংয়ের জটিল হিসাবনিকাশের জালে আটকা পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিশেষত নতুন লোন পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে।তবে এটাও উল্লেখ্য, যেসকল ডিফারেল সুবিধাভোগী কর্মক্ষেত্রে ফিরতে পেরেছেন এবং স্বাভাবিক উপার্জন ফিরে পেয়েছেন, তাদের জন্যে এটা যথার্থই আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
ঋণগ্রহীতাদের যাচাই-বাছাইয়ের লক্ষ্যে সলভেন্সি সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্যে ব্যাংকের আরো ক্রাইটেরিয়া রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে এমপ্লয়মেন্টের স্ট্যাবিলিটি, আয়ের পরিমাণ, ঋণের ধরণ ও হিস্ট্রি| সব মিলিয়েই ব্যাংক কোন আবেদনকারী ঋণ প্রদানের জন্যে যোগ্য কী না তা নিরীক্ষা করে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমানের বৈশ্বিক দুর্যোগ ঋণদাতাদের জন্যেও একটা ধাক্কা হয়ে এসেছে। ঋণ দেবার ক্ষেত্রে তারা এখন অনেক বেশি সতর্ক। লোকসান এড়াতে রিস্ক ম্যানেজমেন্টের নানাবিধ পদ্ধতি তারা অবলম্বন করছেন। ফলে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কনভিন্স করানোর জন্যে মর্টগেজ ব্রোকারদের এখন আগের চাইতে বেশি খাটতে হচ্ছে। ক্রেডিট ফাইলে ডিফারেল গ্রহণের কথা উল্লেখ থাকায় অনেক ঋণদাতারা ঋণ প্রদানে আরো বেশি খুঁতখুঁতে হয়ে উঠেছেন। এটা ঠিক, ডিফারেল সিস্টেম সুবিধাভোগীদের ক্রেডিট স্কোরের নেতিবাচক কোন পরিবর্তন করেনি, তবু বেশিরভাগ লেন্ডারই ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে শুধু ক্রেডিট স্কোর-ই ক্রাইটেরিয়াকে যথেষ্ট মনে করেন না।
সুতরাং এহেন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন যে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি অচিরেই Debt Consolidation-এর ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে। কনসলিডেশন হচ্ছে ঋণে জর্জরিত গ্রাহকদের জন্যে প্রযোজ্য এক বিশেষ সুবিধা, যা গ্রহণে তারা তাদের সবগুলো ঋণ একটা স্বল্প সুদবিশিষ্ট লোনের অধীনে নিয়ে আসার সুযোগ পান। ডিফারেল সুবিধা গ্রহণ করে নানাভাবে বিড়ম্বনায় পড়েছেন, এরকম ক্লায়েন্টের সংখ্যা বাড়ছেই। তার উপর কনসলিডেশনের দরজাও যদি তাদের জন্যে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক এবং অমানবিকই হবে।
লেখক : প্রকৌশলী শিহাব উদ্দিন,
রিয়েল এস্টেট ব্রোকার , (৫১৪) ৩৬৮ ৯০০০