গোলাম মাওলা রনি
ঘটনাটি হুজুরের পাক সা:-এর জমানার। প্রায় সব হাদিস বর্ণনাকারী অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে মশহুর সেই ঘটনাটিকে হাদিস আকারে লিপিবদ্ধ করে গেছেন বিশ্ববাসীর জন্য। বর্ণনাকারীদের মতে- আল্লাহর রাসূল সা:-এর কাছে একদিন জনৈক উম্মি বেদুইন এলেন ইসলাম গ্রহণের জন্য। তার পোশাক পরিচ্ছদ অভিব্যক্তি এবং কথাবার্তা ছিল কৌতূহলোদ্দীপক। ফলে মহানবী সা:-এর মজলিসে উপস্থিত সবাই তার ইসলাম গ্রহণের সুতীব্র আকাক্সক্ষা, উত্তেজনা এবং তার বিগত জীবনের জন্য আলোচনার নেপথ্য কারণ জানার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। তাজেদারে মদিনা সা: তার সাহাবিদের মনোভাব বুঝতে পেরে বেদুইনকে লক্ষ করে বললেন, ‘কেন তুমি ইসলাম গ্রহণ করতে চাও?’
উত্তরে আরব বেদুইন একটি ছোটখাটো ভাঙা মূর্তি অত্যন্ত তাচ্ছিল্যভরে মাটির ওপর রাখলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা: এটা কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত ছিল আমার খোদা। আমি আমার মকসুদ পূরণের জন্য, বিপদ আপদ থেকে রক্ষার জন্য এবং প্রতিপক্ষের ওপর বিজয়ী হওয়ার মানসে সারাক্ষণ এই তথাকথিত খোদাকে সাথে রাখতাম। আজো ওটিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হই। পথিমধ্যে আমার হঠাৎ করে প্রাকৃতিক কর্মের তাকিদ চেপে বসে। আমি ওটিকে রাস্তার পাশে সযতনে রেখে প্রাকৃতিক কর্ম করতে যাই এ কারণে যে- আমার কাছে মনে হলো, মলত্যাগের মতো নোংরা কর্মের সময় ‘খোদা’র মূর্তি সাথে রাখা বিপজ্জনক ও অসম্মানজনক।
মলত্যাগ শেষে যখন মূর্তির কাছে এলাম তখন লক্ষ করলাম, মূর্তিটির সর্বাঙ্গ ভেজা। আমার মনে হলো- কোনো রহমতের পানি হয়তো খোদার শরীরে পড়েছে। ভক্তির আতিশয্যে খোদার শরীরের পানি চাটতে লাগলাম। কিন্তু উৎকট গন্ধ এবং লবণের বিস্বাদ আমার চিন্তার জগৎকে খুলে দিলো। আমি ভাবলাম- রহমতের পানি তো সুগন্ধিযুক্ত ও সুমিষ্ট হবে। ফলে খোদার পুতলির অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে আমার জীবনে প্রথমবারের মতো সন্দেহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হলো। সন্দেহভরা চোখ নিয়ে আশপাশের চার দিকে তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে ঘৃণা-রাগ-অভিমানে আমার শরীরের কম্পন শুরু হলো। আমি দেখলাম, অদূরে একটি কুকুর দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং কুকুরটির জলবিয়োগের স্থানটি তখনো সিক্ত ছিল।
খুব সহজেই বুঝতে পারলাম, এতক্ষণে রহমতের পানি মনে করে আমি আসলে কী লেহন করেছি। পুতলিটির প্রতি সব বিশ্বাস-ভালোবাসা এবং ভক্তি কর্পূরের মতো উড়ে গেল। আমি ভাবলাম, যে মূর্তি কুকুরের পেশাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, সে আমাকে কিভাবে রক্ষা করবে? ফলে আমি আর রাগ সামলাতে পারলাম না। খুব জোরে মূর্তিটিকে আছাড় দিয়ে এর হাত-পা-নাক ভেঙে দিলাম। আল্লাহর রাসূল সা: বেদুইন আরবের কথা শুনে অনেকক্ষণ হাসলেন। হাদিস শরিফে এসেছে- এই প্রথমবার রাসূলে করিম সা: হাসলেন যখন তার দন্ত মোবারক বের হয়ে দৃশ্যমান হয়েছিল।
মূর্তি নিয়ে এ কাহিনী ইসলামের ইতিহাসের একটি অনন্য দলিল। কারণ ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাহেলি যুগের শত-সহস্র, বিভিন্ন আকার আকৃতি ও নাম-উপনামের ধ্বংসযজ্ঞের ওপর। কাজেই ইসলাম এবং মূর্তিপূজা যে একসাথে হয় না তা বুঝার জন্য জাহেলি যুগের পৌত্তলিকতার নেপথ্য কারণ এবং ইসলামের লা শারিক আল্লাহ শব্দের যথার্থতা অনুধাবন দরকার। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মের মূর্তিপূজা এবং জাহেলি যুগের জাজিরাতুল আরবের মূর্তিপূজা এক নয়। অন্য দিকে প্রাচীন সুমেরীয়, মিসরীয় ও পারসিক সভ্যতার যুগে বিভিন্ন দেব-দেবীর ভাস্কর্য তৈরি করে যে পূজা অর্চনা হতো সেগুলোর সাথে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার কথিত দেব-দেবীর বা ভাস্কর্যবিহীন কোনো সুবিখ্যাত মন্দিরের প্রসঙ্গ যদি আলোচনা করি তবে প্রাচীন গ্রিসের ডেলফির মন্দিরের নাম সবার আগে চলে আসবে যার সাথে পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মমতের উপাসনা গৃহের ন্যূনতম মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মূর্তি তথা ভাস্কর্য এবং মন্দির তথা উপাসনালয় নিয়ে যদি আমরা বিস্তারিত আলোচনা করতে যাই তবে তা শেষ করা যাবে না। তাই সম্মানিত পাঠকদের কাছে আজকের বিষয়বস্তু সহজবোধ্য করার জন্য আইয়ামে জাহেলিয়াতের মূর্তিপূজা এবং সেই মূর্তিপূজার নেপথ্যের ব্যবসায়-বাণিজ্য, রাজনীতি, ধান্ধা এবং ক্ষমতার লড়াই নিয়ে আলোচনা করব। দ্বিতীয়ত, আইয়ামে জাহেলিয়াতের পতন ঘটিয়ে যেহেতু ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল- সেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত ইসলামের প্রধান শত্রু জাহেলিয়াত বা অজ্ঞানতা তথা একত্ববাদী ধর্মমতের প্রতিকূলে মূর্তিপূজা। এই কারণে গত চৌদ্দ শ’ বছর ধরে তামাম দুনিয়ার মুসলমানরা একসাথে সিংহের মতো গর্জন করে ওঠেন যখন তারা দেখেন, ইসলাম এবং মুসলমানিত্বের বেশ ধরে সুকৌশলে মহলবিশেষ মূর্তিপূজাকে পুঁজি করে সেই আবু জেহেলের বংশবদদের মতো অপচেষ্টা চালায়।
আল্লাহর রাসূল সা: যখন নবুয়ত পেলেন ঠিক সেই সময়ে কাবাঘরের অভ্যন্তরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। সেগুলোর মধ্যে তিনটি মূর্তির নাম ছিল- লাত, মানত ও ওজ্জা। ধরে নেয়া হতো যে, ৩৬০টি মূর্তির নেতা হলো এরা। এর বাইরে আরো একটি নেতাগোছের মূর্তি ছিল যাকে বলা হতো হোবল দেবতা। আজকের মক্কা-তায়েফসহ সংশ্লিষ্ট এলাকা যা হিজাজরূপে পরিচিত ছিল সেখানে বসবাসরত লোকজনই মূলত প্রভাবশালী বলে গণ্য হতো। মক্কাতে যে বার্ষিক সম্মেলন হতো যার নাম ছিল ওকাজের মেলা, সেখানে সমগ্র আরব তো বটেই অন্যান্য এলাকা তথা চীন-পারস্য-রাশিয়া-আফগানিস্তান- এমনকি ভারত থেকেও লোকজন যেত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ যেত বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে- আবার কেউ কেউ যেত তৎকালীন রীতি অনুযায়ী কাবাকে কেন্দ্র করে ধর্মাচারে পুণ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে।
ওকাজের মেলায় আগত লোকজন আসতেন দলে দলে এবং বিভিন্ন গোত্র ও উপগোত্রে বিভক্ত হয়ে। প্রত্যেক গোত্রেরই আলাদা আলাদা মূর্তি থাকত। ফলে এ মেলায় দেবতারূপী বা খোদারূপী হাজার হাজার ছোট-বড় মূর্তির সমাবেশ ঘটত এবং সবাই চাইত তাদের মূর্তিটি কাবাঘরের মধ্যে স্থাপন করার জন্য। কাবার দায়িত্বে থাকা কুরাইশ দলপতিরা একত্র হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে, কেবল হেজাজ-নজদ ও ইয়েমেনের শীর্ষস্থানীয় গোত্রগুলোর দেবতারা কাবা অভ্যন্তরে স্থান পাবে। নেতারা যেভাবে গোত্র এবং গোত্রের দেবতাদের শ্রেণিবিন্যাস করেছিলেন সেই হিসাবে ৩৬০টি মূর্তি কাবার অভ্যন্তরে স্থান পায় যেগুলোর পূজারির সংখ্যা ছিল হয়তো কয়েক হাজার।
জাহেলি যুগের মূর্তিপূজা নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের মতে, কেবল স্বার্থসিদ্ধি এবং ধান্দাবাজির জন্য গোত্রগুলো মনগড়া মূর্তি উদ্ভাবন করত। মূর্তিকে কেন্দ্র করে নানা অলৌকিক গল্প ফাঁদা হতো এবং ভেলকিবাজি করে কিছু চালাক লোক যারা গোত্রপতিদের খয়ের খাঁ ছিল তারা সাধারণ মানুষকে বেকুব বানাত। মূর্তির মাথা থেকে ক্ষণে ক্ষণে আগুন বের হওয়া অথবা গভীর রাতে মূর্তির নড়াচড়া বা উড়ে বেড়ানোর মতো জাদুর কৌশল জানা লোকজনকে ভাড়া করে এনে গোত্রপতিরা সাধারণ মানুষকে প্রথমে মূর্তি সম্পর্কে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলত এবং বলত, মূর্তিকে খোদা মেনে পূজা না করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। অশিক্ষিত বেদুইনরা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই গোত্রপতিদের ফাঁদে ধরা পড়ত এবং নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ-সম্পত্তির বিরাট অংশ মূর্তিপূজায় ব্যয় করত যা অলক্ষ্যে গোত্রপতিদের পকেটেই চলে যেত।
মহাকালের মূর্তিসংক্রান্ত ধান্ধাবাজি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেশকাল, সমাজকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরে এবং সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার নির্যাসের একটি বিরাট অংশ শুষে নেয়। রাজনীতি-অর্থনীতি, প্রেম-ভালোবাসা, যৌনতা থেকে শুরু করে যুদ্ধ-বিগ্রহ এমনকি আনন্দ-উল্লাসেও ধান্দাবাজরা মূর্তিপূজাকে ঢুকিয়ে দেয়। সমাজবিজ্ঞানীরা মূতিপূজার কার্যকারণ নিয়ে গবেষণা করে যা পেয়েছেন তা রীতিমতো বিস্ময়কর। মানুষ তার সহজাত লালসার দ্বারা তাড়িত হয়ে অতিন্দ্রীয় বিষয় ভোগ-বিলাসের জন্য কামনা করে এবং আপন মানবসত্তাকে ওসব প্রাপ্তির জন্য বাধা মনে করে, তখনই সে মূর্তি বা পুতলির আশ্রয় নেয়।
প্রাচীন মিসরের রাজনীতিতে যখন কোনো ধড়িবাজ ফেরাউনের অভ্যুদয় হতো, তিনি নিজের জন্য একটি নতুন খোদা বানিয়ে নিতেন। আগের ফেরাউনরা যেসব মূর্তিকে খোদা বানাতেন সেসব মূর্তিকেন্দ্রিক মন্ত্র, আইন-কানুন পূজা-অর্চনা এবং ধান্দাবাজি যদি নতুন ফেরাউনের মনোপুত না হতো তখন তিনি তার সাঙ্গপাঙ্গদের সহযোগিতা নিয়ে নতুন মূর্তি বানাতেন এবং সেটিকে খোদা বলে প্রচার করতেন। এ ক্ষেত্রে মূর্তির মুখ দিয়ে কৌশলে নানান কথা বের করে ফেরাউনরা প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে নির্মূল এবং দেবতার দোহাই দিয়ে জনগণের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেন। ফেরাউনরা সব ক্ষেত্রে যে সফল হতেন- তা কিন্তু নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পূর্বতন ফেরাউনের মূর্তিগুলো জনপ্রিয়তা পেয়ে যেত এবং নতুন ‘খোদা’ বনাম পুরান ‘খোদার’ অনুসারীরা যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়তেন।
প্রাচীন মিসরে কোনো কোনো ফেরাউন নিজেকে কথিত খোদার অবতার অথবা পুত্র বলে প্রচার করতেন। কেউবা নিজেকে সরাসরি খোদা বলে প্রচার করতেন এবং নানান ভেলকিবাজি দেখিয়ে জনগণের একাংশকে বিভ্রান্ত করতেন। তারা সারা দেশে নিজেদের মূর্তি বানিয়ে সেগুলোতে পূজা দেয়ার জন্য পেটোয়া বাহিনীর মাধ্যমে নিরীহ জনগণকে বাধ্য করতেন।
সারা দুনিয়ায় সেই অতীতকাল থেকে আজ অবধি মূর্তি নিয়ে যত আদিখ্যেতা এবং অনাসৃষ্টি হয়েছে তা অন্য কিছু নিয়ে হয়নি। মূর্তির জন্য যত যুদ্ধ হয়েছে অথবা মূর্তির জন্য যত মানুষ মরেছে তা কোনো সাধারণ যুদ্ধ কিংবা কোনো ভয়ঙ্কর মহামারী-রোগবালাই অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হয়নি। মূর্তিকে কেন্দ্র করে যত অপরাজনীতি, যত অপসংস্কৃতি এবং যত রকম-অবৈধ লেনদেন হয়েছে তা অন্য কোনো পাপাচারের সাথে তুলনীয় নয়। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি অনেকের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। সাম্প্রতিককালে মহানবী সা:-এর একটি ব্যঙ্গচিত্রকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাসে ফ্রান্সের যে ক্ষতি হয়েছে তা ‘ওয়াটার লু’র যুদ্ধের ক্ষতির চেয়েও বেশি বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।
এ কারণে সর্বকালের সেরা ধর্ম ইসলাম যেকোনো মূর্তির বিষয়েই অত্যন্ত কঠোর। এই ধর্মের অনুসারীরা যখন দেখেন যে, কোথাও আশরাফুল মাখলুকাতরূপী জীবন্ত মানুষের পরিবর্তে মাটি-পাথর বা কোনো ধাতুর তৈরি পুতলিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, পুতলির কাছে মাথা নত করা হয়, পুতলির গলায় মালা পরিয়ে সেই দানব জড়পদার্থের চতুর্দিকে কিছু ধড়িবাজ মানুষ ধান্ধা হাসিলের উদ্দেশ্যে নাচন-কুর্দন করে এবং জাহেলি যুগের মতো বিশ্বজাহানের মালিকের ঐশী নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় তখন তারা আপন ধর্মের লোকদেরকে সতর্ক করার জন্য বলে ওঠে হুঁশিয়ার! সাবধান! শিরক করো না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য