অর্থ পাচারকারীদের তথ্য চেয়েছেন হাইকোর্ট কানাডায় ‘বেগম পল্লী’ মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’ ‘পানামা পেপারস’ কেলেঙ্কারী ও সিংগাপুরে ‘শীর্ষ ধনীর তালিকা’ এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু’
কানাডার বেগম পল্লী বাড়ির মালিকসহ দেশ থেকে অবৈধভাবে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের যাবতীয় তথ্য চেয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ওই দিন এ নিয়ে পরবর্তী শুনানি হবে। গতকাল রোববার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ এ আদেশ দেন। বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের নিয়ে গত কয়েকদিন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে এ আদেশ দেন হাইকোর্ট।
বিদেশে টাকা পাচারকারীদের তথ্য চেয়ে হাইকোর্ট রুল জারির পর ২০১৬ সালে ‘পানামা পেপারস’ কেলেঙ্কারী, কানাডার টরেনেটার ‘বেগম পল্লী’ মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’ এবং সিংগাপুরে ‘শীর্ষ ধনীর তালিকা’সহ বিভিন্ন সময় বিদেশে টাকা পাচারের ইস্যুগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা-বিতির্ক শুরু হয়ে গেছে। তবে গত শনিবার দুদকের ষোড়শ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেছিলেন, ‘কানাডার বেগম পল্লীতে কাদের বাড়ি রয়েছে সে সম্পর্কে দুদকের কাছে সুনিদৃষ্ট কোনো তথ্য নেই’।
এর আগে গত বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদেরা নন, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকুরেরা।’ এ নিয়েই দেশের প্রায় সবগুলো পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
হাইকোটে দুই বিচারপতির দেয়া রুলের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক।
ডিআরইউ’র মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে কানাডার টরেন্টোতে অবস্থিত ‘বেগম পল্লী’ বিষয়ে গোপনে খোঁজ-খবর নেওয়া হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে, কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়, সেটিতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘আমার কাছে ২৮টি কেস এসেছে এবং এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন ৪ জন। এ ছাড়া তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ীরা কিছু রয়েছেন। আমরা আরো তথ্য সংগ্রহ করছি। পাচারে শুধু কানাডা নয়, মালয়েশিয়াতেও একই অবস্থা। তবে তথ্য পাওয়া খুব কঠিন। বিভিন্ন মিডিয়ায় যে তথ্য বের হয়, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, আসলে সংখ্যাটি তত নয়।’
পাচারের দায় বিদেশি সরকারও এড়াতে পারে না উল্লেখ করে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘যেমন সুইজারল্যান্ডে কে ব্যাংকে টাকা রাখলেন, সেই তথ্য আমাদের দেয় না। তারা ট্রান্সপারেন্সির কথা বলে। কিন্তু যদি বলি কার কার টাকা আছে, সেই তথ্য দাও, তখন তারা দেয় না। এটি একটি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।’
বিদেশে টাকা পাচার বিষয়ে আদালত অন্তবর্তীকালীন আদেশসহ রুল জারি করেন। রুলে টাকা পাচারকারী সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
চার সপ্তাহের মধ্যে দুদক চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিনানসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট, এনবিআর চেয়ারম্যান এবং ঢাকা জেলা প্রশাসককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এ রুল বিবেচনায় থাকা অবস্থায় বিদেশে টাকা পাচারকারীদের নাম ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য (মামলাসহ, কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা) প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে দুদক চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিনানসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট, এনবিআর চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হাইকোটের দেয়া রুলের পর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বোত্রই ‘বিদেশে টাকা পাচার’ ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিশেষ করে পররাষ্ট্রন্ত্রীর মুখে ‘বিদেশে টাকা পাচারের তালিকায় সরকারি কর্মকর্তাদের সংখ্যা বেশি’ উচ্চারিত হওয়ার পর কোন কোন আমলা বিদেশে বিশেষ করে কানাডার বেগম পল্লীতে বাড়ি করেছেন তার খোঁজ খবর শুরু হয়ে গেছে।
দুদক কমিশনার যা বললেন : গত শনিবার দুদকের এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেছেন, স্বামী বাংলাদেশে বউ কানাডায়। স্বামীরা দেশ থেকে অবৈধভাবে টাকা উপার্জন করে পাঠায় বউয়ের কাছে। সে কারণে কানাডার টরেন্টোর একটি লোকালয়ের নাম হয়েছে ‘বেগম পল্লী’। কথিত আছে, কোটি কোটি টাকা পাচার করে অনেকে বাংলাদেশি বেগম পল্লীতে স্থায়ী হয়েছেন। সেখানে বসতি গড়েছেন ৩৬শ’ কোটি টাকা পাচার করে পলাতক আলোচিত পি কে হালদারও।
দুদক কমিশনার জানান, সেখানে কত বাংলাদেশির বাড়ি আছে তার কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে, তবে এ বিষয়ে তদন্ত করবে দুদক।
কোটি কোটি টাকা পাচার করে মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ ও কানাডার ‘বেগম পল্লী’ অনেক বাংলাদেশি স্থায়ী হওয়ার ঘটনা এখন অপেন সিক্রেট। বেগমপল্লীর বউরা আয়েশি জীবনযাপন করেন। আর তাদের কাছে অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা পাঠান বাংলাদেশে থাকা স্বামীরা। টাকা উপার্জনে ক্লান্তি আসলে অবসর কাটাতে কানাডায় বেগমদের কাছে যান সাহেবেরা। এ কারণে স্থানটির নাম দেয়া হয়েছে বেগম পল্লী।
দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান জানান, কানাডার বেগম পল্লীর রহস্যের কথা তারাও দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছেন। যদিও সেখানে কত বাংলাদেশির বাড়ি আছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই তাদের হাতে। তবে তদন্ত করার কথা জানিয়েছেন দুদকের এই কমিশনার। তিনি বলেন, বেগম পল্লীতে কি পরিমাণ বাংলাদেশীর বাড়ি আছে এটা এখনও মিথ। এটার সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছেই নেই। তবে আমাদের কাছে এই ধরণের অভিযোগ আছে। যখন তদন্ত করে এসব উদঘাটন হবে তখন আমরা এই সংখ্যা নিয়ে কথা বলতে পারবো।
অভিযোগ আছে, ৩৬শ’ কোটি টাকা পাচার করে পলাতক আলোচিত পি কে হালদারও বেগম পাড়ায় স্থায়ী হয়েছেন। পুলিশের হাতে আটক মানির হোসেনের (গোল্ডেন মনির) নামও ওই টাকা পাচারকারীদের তালিকায় রয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে।
পানামা কেলেঙ্কারী : ২০১৬ সালে ‘পানামা পেপারস’ কেলেঙ্কারির খবরে বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচারের ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে আসে। সেখানে অন্তত ৪৩ জন বাংলাদেশির নাম প্রকাশ করা হয়। এদের মধ্যে ৩৯ জন ব্যক্তি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হিসাব চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে বেনামি প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রমাণ মিলেছে। বিদেশে অর্থ পাচারে যেসব ব্যক্তির নাম এসেছে তাদের মধ্যে ৩৭ জন করদাতা বলে তথ্য প্রকাশ করে এনবিআর।
টাকা পাচার কেলেঙ্কারীর খবরটি প্রকাশের পর পানামা পেপারস-এ নাম থাকা বাংলাদেশিদের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে একযোগে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সে সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফইইউ-এর মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ জানান, পানামা পেপারস যাচাই-বাছাইয়ের পর ৪৩ জনের (বাংলাদেশি) নাম পাওয়া গেছে। বিএফআইএইউ-এর অভ্যন্তরীণ ডাটাবেইজ অনুসন্ধানে এর মধ্যে ৩৯ জন ব্যক্তি এবং তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হিসাব প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পানামা পেপারর্সে প্রকাশিত তালিকায় যেসব ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন, কফিল এইচএস মুইদ, রুডি বেঞ্জামিন, ইউসুফ রাইহান রেজা, ইশরাক আহমেদ, নভেরা চৌধুরী, ফরহাদ গনি মোহাম্মদ, মেহবুব চৌধুরী, বিলকিস ফাতিমা জেসমিন, রজার বার্ব, মো. আবুল বাশার, জাইন ওমর, বেনজির আহমেদ, আফজালুর রহমান, মুল্লিক সুধীর, সরকার জীবন কুমার, নিজাম এম সেলিম, মোহাম্মদ মোকসেদুল ইসলাম, মোতাজ্জারুল ইসলাম, এম সেলিমুজ্জামান, আফজালুর রহমান, সৈয়দ সিরাজুল হক, এফ এম জুবাইদুল হক, মোহাম্মদ আমিনুল হক, নাজিম একরামুল হক, ক্যাপ্টেন এম এ জাউল, কাজী রাইহান জাফর, মোহাম্মদ শাহেদ মাসুদ, সালমা হক, খাজা শাহদাত উল্লাহ, সৈয়দা, সামিনা মির্জা, দিলীপ কুমার মোদি, মোহাম্মদ ফয়সাল করিম খান, জাফরুল্লাহ কাজী এবং জাফরুল্লাহ নিলুফার, জুলফিকার হায়দার, উম্মে রুবানা, আজমত মঈন, মির্জা এম ইয়াহিয়া, মিস্টার নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, জাফের উম্মেদ খান, নিলুফার জাফরুল্লাহ, এ এম জুবায়দুল হক এবং আসমা মঈন, এএফএম রহমতুল বারী, এএসএম মুহিউদ্দিন মোনেম, মাহতাবুদ্দিন চৌধুরী। এর মধ্যে রুডি বেঞ্জামিন ও রজার বার্ব নামে দুজন বিদেশির নামও বাংলাদেশের নামের তালিকায় রয়েছে। এ ছাড়া তালিকায় থাকা বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দ্য বেয়ারার, পেসিনা স্টেফানে ও বাংলা ট্রাক লিমিটেড নামে তিনটি কোম্পানির নাম জানা গেছে।
সিঙ্গাপুরের ধনীর তালিকা : ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকা প্রকাশ করে। এই তালিকায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ খান ও তার পরিবারের নাম রয়েছে। ফোর্বসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সামিটের এই চেয়ারম্যান সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় ৩৪ নম্বরে রয়েছেন। পরিবার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি, স্টক এক্সচেঞ্জ, বিশ্লেষক ও অন্যান্য সূত্র থেকে শেয়ারহোল্ডিং ও আর্থিক তথ্য নিয়ে এ তালিকা করেছে ফোর্বস।