অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, জার্মানির বন থেকে
একটি মধ্যম আয়ের দেশের হাজার হাজার নাগরিক দিন কাটাচ্ছেন সুদূর দেশের জঙ্গলে। বাংলাদেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ না, এমনও না যে এ দেশে মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। তাহলে ১৫-২০ লাখ টাকা খরচ করে, নির্যাতন সহ্য করে ইউরোপে ঢোকার এই পাগলামি কেন?
ডয়চে ভেলে বাংলার হয়ে সহকর্মী আরাফাতুল ইসলামের সঙ্গে যখন বসনিয়ার ভেলিকা ক্লাদুসায় যাচ্ছিলাম তখনই মনে একটা প্রশ্ন জাগছিল- কেন?
সেই কেন এর উত্তর খুঁজতেই কেটে গেল বেশিরভাগ সময়। বসনিয়ায় থাকা বাংলাদেশি অভিবাসীদের যাদের সঙ্গেই কথা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগের বাড়িই সিলেট অঞ্চলে। ফলে বাংলাদেশের লন্ডন বলে পরিচিতি পাওয়া এলাকাটির মানুষ এভাবে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টায় জঙ্গল-পরিত্যক্ত ভবন বা ক্যাম্পে বাস করছেন, ভেবে মনে জাগা কেনটা আরো জোরালো হয়ে ওঠে।
এর কোনো শতভাগ নিশ্চিত উত্তর না মিললেও সার্বিক একটা চিত্র দাঁড় করাতে পেরেছি। কারণগুলো মোটামুটি এমন- ১. সামাজিক স্ট্যাটাস ও উন্নত জীবন ২. যাত্রাপথের হয়রানি সম্পর্কে ভুল ধারণা ৪. রাজনৈতিক কারণ।
রহিম নামে এক অভিবাসী মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে কাজ করেছেন পাঁচ বছর। তার অনেক বন্ধু এবং স্বজন বাস করেন ইউরোপের নানা দেশে। তিনিই দুঃখ করে বলছিলেন, ছুটিতে যখন মাঝেমধ্যে দেশের বাড়ি যান ইউরোপ থেকে আসা তার বন্ধুরা যে সামাজিক মর্যাদা পান, তিনি ওমান থেকে গিয়ে সে মর্যাদাটা পান না। তার পরিবারের সদস্যরাও এ নিয়ে বেশ মানসিক যাতনায় ভোগেন। কী আশ্চর্য, তাই না? অথচ, ওমানে রহিম বৈধভাবে কাজ করলেও তার বন্ধুদের বেশিরভাগই এখনও ইউরোপে অবৈধ!
তবে রহিমের ধারণা ছিল তিনি ইউরোপে আসতে পারলেই তার স্ট্যাটাস বেড়ে যাবে এবং তিনি কাড়িকাড়ি টাকা দেশে পাঠিয়ে তার ও তার পরিবারের সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে পারবেন। কিন্তু প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে তিনি ওমান থেকে ইরান-তুরস্ক-গ্রিস-আলবেনিয়া-নর্থ মেসিডোনিয়া-সার্বিয়া হয়ে বসনিয়া এসেছেন। এখনও তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
বারবার চেষ্টা করেও হয়তো ইউরোপে ঢুকতে পারছেন না অনেক বাংলাদেশি। ইউরোপ সীমান্তের জঙ্গলে চলছে রান্নার আয়োজন।
মাঝপথে ‘গেইম মারতে’ গিয়ে (অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়াকে অভিবাসীরা নাম দিয়েছেন ‘গেইম’) একাধিকবার ক্রোয়েশিয়া পুলিশের নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন।
শফিক মিয়া নামের একজন এখন ক্যাম্পে আছেন চার মাস ধরে। তার ডান হাত প্রায় অকেজো। ‘গেইমে’ গিয়ে স্লোভেনিয়ার পুলিশের কুকুরের কামড় খেয়ে হাতে লেগেছে ১৪টি সেলাই। তারপরও সুস্থ হলে আবার গেইমে যেতে চান তিনি!
এমন একটা গেইমের প্রস্তুতি দেখার সৌভাগ্য (বা দুর্ভাগ্য) হয়েছিল আমাদের। শত শত শরণার্থীকে বাসে করে সীমান্তে নিয়ে যাবেন বুশি নামের এক দালাল। সেই দালাল নিজেও অবৈধভাবে বসনিয়ায় আছেন। তবে তিনি আর সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন না, বরং অন্যদের পাড়ি দেয়ার আয়োজন করে কামাচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। সেই টাকার একটা ভাগ সেই অঞ্চলের পুলিশও পায় বলে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। ফলে পুরো বিষয়টিই ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে।
সেই বুশির গেইমে সাইফুর রহমান নামে এক অভিবাসী দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাছে যেতেই নিজের সব দুঃখের কথা বলা শুরু করলেন। তিনিও ওমানে ছিলেন, একই রুটে এসেছেন বসনিয়ায়। তার দাবি তিনি ভুলেও ভাবেননি এভাবে কষ্ট করতে হবে, নির্যাতিত হতে হবে। তার চেয়ে ওমানে তিনি অনেক ভালো ছিলেন বলে জানালেন। এরই মধ্যে তার ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু কেউ যদি তাকে ১০ লাখ টাকাও দেয়, বাকি পাঁচ লাখ লস দিয়েও তিনি দেশে ফেরত যেতে চান।
যখন আমরা বসনিয়ায় কাজ করছিলাম তখনই বিভিন্ন দেশ থেকে এমন অনেক অভিবাসী নিজেদের দুঃখের কথা তুলে ধরতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সার্বিয়া, গ্রিসসহ ইউরোপের নানা দেশে যেমন অবৈধ বাংলাদেশিরা রয়েছেন, সাউথ আফ্রিকা, লিবিয়া এমনকি মরক্কোতেও অনেকে আটকা পড়েছেন।
ইউরোপ সীমান্তে অবৈধভাবে ঢুকতে গিয়ে ক্রোয়েশিয়া পুলিশের আঘাতে আহত এক বাংলাদেশি।
মরক্কোতেও নাদোর নামের একটি শহরের জঙ্গলে পলিথিনের তাঁবুতে রাত কাটাচ্ছেন কয়েকশ বাংলাদেশি। তারা যেতে চান স্পেনে।
এত টাকা দিয়ে কি দেশে কিছু করা যেত না? বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ, আন্তর্জাতিকভাবে ‘রাইজিং ইকোনোমিক টাইগার’ বলা হচ্ছে বাংলাদেশকে। অথচ সেই দেশের হাজার হাজার নাগরিক ঠিক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর মতো প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপের সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছেন!
মরক্কোর জঙ্গলে থাকা এক অভিবাসী জানিয়েছিলেন, স্পেনের পুলিশ ধরতে পারলে তাদের মরক্কো ফেরত পাঠায়, মরক্কো ফেরত পাঠায় আলজেরিয়ায়, আবার আলজেরিয়ার পুলিশ তাদের ফেরত পাঠায় নাইজারে। সেই নাইজার থেকে আবার মরক্কো আসতে তাদের কয়েক হাজার টাকা খরচ হয়, কয়েকদিন পায়ে হেঁটে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। এর সঙ্গে ধরা পড়লে নির্যাতন তো রয়েছেই।
তিনি বলছিলেন, এখন তার কাছে দালালের মাধ্যমে দেশ থেকে আনানো অল্প কিছু অর্থ বাকি রয়েছে। পরবর্তী ‘গেইমে’ ধরা পড়লে তাকে যদি নাইজারে যেতে হয়, আর ফেরত আসার টাকাও তার কাছে থাকবে না। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তখন কী করবেন?” উত্তর এসেছে, “কেবল আল্লাহই জানেন।”
দেশ থেকে অনেক দূরে, অনিশ্চিত ভবিষ্যত মাথায় নিয়ে ইউরোপ সীমান্তের জঙ্গলে চলছে রান্নার আয়োজন।
একবার চিন্তা করে দেখুন। বাংলাদেশের মানুষ ইউরোপ যাবেন বলে মাসের পর মাস রাত কাটাচ্ছেন আফ্রিকার জঙ্গলে পুলিশের মার খেয়ে। ভাবা যায়?
বসনিয়ার একটা পরিত্যক্ত ছাদ-দেয়ালবিহীন কারখানায় রাত কাটানো বাংলাদেশিদের একজনকে বলেছিলাম, “১৫-২০ লাখ টাকায় তো আপনি নিজেই একটা ফ্যাক্টরি দিতে পারতেন।”
তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “তা হয়তো পারতাম, তবে সেই কারখানা থেকে কোনও টাকা আমার পকেটে আসতো না।” ঘুস-দুর্নীতি, অনিয়ম, অন্যায়, সুশাসনের অভাব, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, ইত্যাদি নানা অভিযোগ উঠে এসেছে তাদের কথায়।
বাংলাদেশ সরকারও এ নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কেউই এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। এর একটা কারণ হতে পারে এমন- তারা তো জেনেশুনে নিজের ইচ্ছায় গেছে, আমাদের কী করার আছে? আর না বলা কারণটা হতে পারে এমন- যে কয়জন যেতে পারলো গেল, একবার ইউরোপ গেলে দেশে টাকা তো আসবে। অথচ, দালালদের যে বিশাল চক্র গড়ে উঠেছে সেটিকে ভেঙে দেওয়ার মূল দায়িত্বটি হওয়া উচিত ছিল সরকারেরই। তা তো হয়ইনি, বরং মানবপাচারের অভিযোগে কয়েক মাস ধরে কুয়েতের কারাগারে আছেন দেশের একজন সংসদ সদস্য! সত্যিই সেল্যুকাস।
জঙ্গলের পরিত্যক্ত ভবনে আপাত ঠাঁই করে নেওয়া বাংলাদেশিরা।
অন্যদিকে তথাকথিত ‘মানবিক’ ইউরোপে এসে সীমান্তে তাদের ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। কারো হাত-পা ভেঙে দেয়া হচ্ছে, কখনও কুকুর লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে, পিটিয়ে শরীরে জখম করা হচ্ছে। বসনিয়া সীমান্তে এ অভিযোগ ক্রোয়েশিয়া পুলিশের বিরুদ্ধে, অন্য সীমান্তে হাঙ্গেরি পুলিশ বা স্পেনের পুলিশের বিরুদ্ধেও রয়েছে এমন অভিযোগ।
এসব অভিযোগ সত্য হোক বা মিথ্যা, একথা নিশ্চিত যে বেশিরভাগ বাংলাদেশি অভিবাসীই দেশে এক ধরনের অনাস্থায় ভুগতেন। শ্রম বা মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন দেশে হবে না বলে তারা মনে করেন। সেই অনাস্থার জায়গাটা দূর করতে না পারলে দেশ হিসেবে মধ্যম বা উচ্চ আয়ের হলেও সমাজটা এমন পিছিয়েই থাকবে।
লেখক: সাংবাদিক, ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগ।