হুমায়ূন আহমেদ বহু মানুষের প্রিয় লেখক। তিনি আমার কাছে বেশি প্রিয় তাঁর অসাধারণ বিজ্ঞান কল্পকাহিনিগুলোর জন্য। তাঁর এ রকম একটি উপন্যাস ইরিনা। তিনি সেখানে এক ডেস্টোপিয়ান পৃথিবীর কথা বলেন, যেখানে মানুষ নিয়ন্ত্রিত হয় সুপার কম্পিউটার আর অমরত্ব পাওয়া কিছু মানুষের দ্বারা। সেই রাজ্যে অধিকাংশ মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, প্রশ্ন করার অধিকার নেই, অধিকার নেই এমনকি কৌতূহলী হওয়ার। সেখানে তবু চিন্তা করার সুযোগ থাকে, জর্জ অরওয়েলের কালজয়ী উপন্যাস নাইনটি এইটি ফোর-এ এমনকি চিন্তাও করা যায় না স্বাধীনভাবে। চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সেখানে আছে থট-পুলিশ, আছে কঠোর শাস্তি!
আমরা সেই পর্যায়ে পৌঁছাইনি এখনো। তবে যেভাবে পৃথিবীর নানা দেশে এখন বাক্স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়, বিজ্ঞান তত দূর পর্যন্ত গেলে থট-পুলিশ ধরনের রোবটও মোতায়েন হবে, সন্দেহ নেই। সেপিয়ান্স আর হোমো ডিউস: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টুমোরোর মতো বেস্টসেলার লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন নতুন ধারার ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়াহ হারারি। মনে পড়ে বছরখানেক আগে সিএনএনে তাঁকে বলতে শুনেছি, এমন দিনও আসবে উত্তর কোরিয়ার মতো কোনো দেশে একনায়কের প্রতি মনে মনে ঘৃণা পোষণ করার জন্য কামানে করে উড়িয়ে দেওয়া হবে মানুষকে।
বাক্স্বাধীনতারুদ্ধ দেশগুলোতে অবশ্য প্রায় অনিবার্যভাবে থাকে একটি বিপরীত চিত্রও। অন্যরা কথা না বলতে পারলেও একধরনের মানুষ সেখানে ভোগ করেন সীমাহীন বাক্স্বাধীনতা। এঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা মানুষ বা তাঁদের সুবিধাভোগী (মার্ক্সীয় ভাষায় উচ্ছিষ্টভোগী)। ভিন্নমতের মানুষকে কোণঠাসা করতে তাঁরা তাঁদের প্রতি অবাধে মিথ্যাচার করেন, ঘৃণা ও বিদ্বেষ উসকে দেন এবং তাঁদের জন্য ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেন। এ জন্য সংবিধান-আইন-আদালত-পুলিশ কোনো কিছু বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বরং কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রশ্রয় বা সমর্থন থাকে তাঁদের পক্ষে।
সীমাহীন এমন স্বাধীনতা বাংলাদেশেও রয়েছে। কিছু কিছু মানুষ আর কিছু কিছু মহলের বিরুদ্ধে যা খুশি বলা বা লেখার স্বাধীনতা আছে এ দেশে। সেটি মিথ্যা, অশালীন, বিকৃত, বিদ্বেষমূলক যা হোক না কেন, এ জন্য কোনো সমস্যা হয় না। বরং নিষ্ঠার সঙ্গে মিথ্যাচার আর কুৎসা রটনা করে নানাভাবে লাভবান বা পুরস্কৃত হওয়া যায়।
মাসখানেক আগে লিখেছিলাম কী কী লেখা যায় না। কী কী বলা বা লেখা যায়, তার তালিকাও ছোট নয় এ দেশে।
২.
বাংলাদেশে কাদের বিরুদ্ধে ইচ্ছেমতো বলা যায়, আমলবিশেষে তা পরিবর্তিত হয়। যেমন সামরিক শাসনামলে যা খুশি বলা যেত এর বিরুদ্ধপক্ষের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে সামরিক ছায়াতলে না আসা যেকোনো রাজনীতিকের বিরুদ্ধে। গণতন্ত্রের আমলে এসে তা কমেনি বরং বিস্তৃত হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। যেমন বিএনপির শাসনামলে শুধু শেখ হাসিনা নয়, যা খুশি বলা যেত এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের স্থপতির বিরুদ্ধেও। তখন তবু সুষ্ঠু নির্বাচনের ভয় ছিল, ভয় ছিল ক্ষমতা হারানোর, ছিল শক্তিশালী বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ আর অনেকটা স্বাধীন সংবাদপত্র। এখন সেসব নেই। এখন যা খুশি বলা যায়, লেখা যায় শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দল বা নেতাদের বিরুদ্ধে নয়, ভিন্নমতাবলম্বী যেকোনো মানুষ বা মহলের বিরুদ্ধে।
এখন গরিবের ব্যাংকার হিসেবে পরিচিত ড. ইউনূসকে গরিব মানুষের ‘রক্তখেকো’ বলা যায়, বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান রচয়িতা ড. কামাল হোসেনকে স্বাধীনতাবিরোধী বলা যায়, মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে জামায়াতের এজেন্ট বলা যায়, দেশের সম্পদ রক্ষার্থে আপসহীন আনু মুহাম্মদকে বলা যায় দেশদ্রোহী। সরকারের সমালোচনা করার কারণে যত দিন বেঁচে ছিলেন, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আর এবিএম মূসা সম্পর্কেও রটনা করা যেত যেকোনো কুৎসা।
এখন সবচেয়ে বেশি বলা যায় প্রয়াত জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতাযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করেছিল। কিন্তু এখন তাঁকে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের এজেন্ট বলা যায়। তাঁকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী বলা যায়, চার নেতার হত্যাকারী বলা যায়, তাহের-খালেদ দুই বিরুদ্ধপক্ষের দুজনেরই হত্যাকারী বলা যায়। একমাত্র নিজের হত্যা ছাড়া আর যেকোনো হত্যাকাণ্ডে তাঁকে অভিযুক্ত করা যায়!
একই অবস্থা খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও। তাঁকে শুধু রাজনৈতিক অপবাদ নয়, ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও কুৎসিত অপবাদ দেওয়া যায়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তাঁর মতো আরও কেউ কেউ বন্দী ছিলেন। কিন্তু এটি নিয়ে অপবাদ দেওয়া যায় শুধু তাঁকে। শুধু তা-ই নয়, এই বৃদ্ধ বয়সেও ওনার ক্ষেত্রে অশ্লীল ও অশালীন ইঙ্গিত দেওয়া যায়। এসব করার জন্য কারও কোনো শাস্তি হয় না, কারও বিরুদ্ধে মামলা হয় না, কাউকে এমনকি সাংবাদিকের প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয় না।
যা খুশি বলা যায় সরকারের বিরোধিতাকারী যেকোনো রাজনৈতিক নেতা আর দলকে। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হককে বলা যায় সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, ধর্ষক। দেশদ্রোহী আর ষড়যন্ত্রকারী বলা যায় সরকারের সমালোচক যে কাউকে।
৩.
এঁদের তুলনায় আমি ক্ষুদ্র একজন ভিন্নমতাবলম্বী মানুষ। কাজেই আমার সম্পর্কেও যা ইচ্ছা বলা যায়, যা ইচ্ছা লেখা যায়। এমনকি বাংলাদেশের এক অজ পাড়াগাঁয়ে জন্ম নেওয়া আমার প্রয়াত বাবাকে নিয়েও যা ইচ্ছা মিথ্যাচার করা যায় এখন। বছরখানেক আগে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আমার বাবাকে রাজাকার বলেছেন, বলেছেন তিনি বিহারিও! তিনি কীভাবে রাজাকার বা বিহারি হলেন, এ জন্য তাঁকে কোনো রকম ব্যাখ্যা দিতে হয়নি!
আমি একজন নগণ্য মানুষ। আমার সাহস, আগ্রহ, সময় নেই অপবাদের উপযুক্ত জবাব দেওয়ার, এ জন্য মামলা করতে যাওয়ার। কিন্তু যাঁরা খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, এ দেশ বিনির্মাণে যাঁদের রয়েছে অসামান্য ভূমিকা, যাঁরা দেশকে এনে দিয়েছেন সাফল্য আর সম্মান, তাঁদের প্রতি অশালীন মিথ্যাচারে নিশ্চয় বুক ভেঙে যায় বহু মানুষের। তারপরও পেনাল কোড হোক, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে হোক, কোনো মামলা কেন করেন না তাঁদের পক্ষে কেউ? অন্যদিকে সরকারপক্ষের কারও সম্পর্কে সামান্য কিছু বলা হলে কেন চোখের পলকে হয় মামলা আর গ্রেপ্তার?
৪.
আমরা কি এসব প্রশ্নের উত্তর জানি না? সবাই জানি। শুধু ভাবি না কী ভয়ংকর একটা বৈষম্য আর অবিচারে অভ্যস্ত করা হয়েছে আমাদের সবাইকে। বাক্স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ খারাপ। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখ সেলাই করে দিয়ে মুষ্টিমেয়কে যা ইচ্ছা তা বলতে দেওয়া, যেভাবে খুশি অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ বর্ণনা করতে দেওয়া, যাঁকে খুশি তাঁর সম্পর্কে জঘন্য অপবাদ দিতে দেওয়া।
সমাজে ঘৃণা, বিভেদ, বৈষম্য আর চরম অবিচার এমন পরিস্থিতিতে বিকশিত হয়। এমন পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য শুধু বাক্স্বাধীনতার সমান প্রয়োগ নয়, বাক্সন্ত্রাসের সমান নিয়ন্ত্রণও প্রয়োজন। সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে আইনের শাসন প্রয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত আমাদের ১৯৭২ সালের সংবিধান সেটাই বলে।
আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক