ডাক বিভাগের প্রায় ৫৪১ কোটি টাকার ‘পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ নামের প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির মহোৎসব হয়েছে। সরকারের অগ্রাধিকারের ৫৪১ কোটি টাকার এ প্রকল্প থেকেই ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র অন্তত একশ কোটি টাকা লোপাট করেছেন।
দেশের বিভিন্ন উপজেলায় ই-পোস্ট অফিস স্থাপনের নামে তিনি এই অর্থ আত্মসাতের পর বিদেশে পাচার করেন। ডিজি সুধাংশু শেখরকে আজ থেকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হচ্ছে।
জালজালিয়াতি বন্ধে ডাকঘরকে ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এর অংশ হিসেবে ‘পোস্ট-ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ নামে প্রকল্প নেয়া হয়। এর ব্যয় ধরা হয় ৫৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬০ কোটি টাকার কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। জালিয়াতি বন্ধের প্রকল্পেই বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে প্রাথমিক প্রমাণও পাওয়া গেছে।
মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিভাগীয় তদন্ত, অডিট রিপোর্ট, দুদক ও সংসদীয় কমিটির তদন্তে ডাক বিভাগের আরও যেসব দুর্নীতি সামনে এসেছে-নোয়াখালীর পোস্টাল অপারেটর স্থানীয় ডাকঘর থেকে প্রায় ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা; ঢাকা পোস্ট অফিসের ফরেন শাখা থেকেও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা এবং রংপুর ডাকঘর থেকে সঞ্চয়ের প্রায় ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ।
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, ডাক বিভাগের একটি অনুসন্ধান জোরালোভাবে চলছে। এই বিভাগের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে কমিশনের কাছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে দেশের বাইরে অর্থ পাচারের অভিযোগের সত্যতা পেলে এ বিষয়ে আলাদা পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান তিনি। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আফজাল হোসেন বলেন, দুর্নীতির তদন্তে যাতে কোনোভাবেই প্রভাববিস্তার করতে না পারে, সেজন্য ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্রকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কাগজপত্রে যেসব জায়গায় ই-পোস্ট অফিস দেখানো হয়েছে, বাস্তবে সেখানে কোথাও জঙ্গল, কোথাও খেলার মাঠ। কোথাও পুরনো ভাঙাচোরা পোস্ট অফিস ঘর।
অথচ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার ল্যাবসহ ডিজিটাল পোস্ট অফিস স্থাপনের নামে ভদ্র এই দুর্নীতি করেন। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে এসব দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসছে। এরই মধ্যে ভদ্রসহ তার সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজনকে অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। তবে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এক সুধাংশু ডাক বিভাগকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে তিনি হাত দেননি। এমন কোনো খাত নেই, যে খাত থেকে তিনি অর্থ পকেটে ভরেননি। তিনি একা নন। ডাক দফতরে তার অনুগত কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়ে সিন্ডিকেট করে তিনি লোপট করেছেন। তারা সবাই এখন দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তের জালে।
মঙ্গলবার ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ডাক অধিদফতরের ডিজিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এসএম তারিকের স্বাক্ষর করা এক প্রজ্ঞাপনে এ আদেশ জারি করা হয়। এতে বলা হয়, ‘সুধাংশু শেখর ভদ্র, মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব), ডাক অধিদফতর, ঢাকাকে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের প্রাথমিক তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৩ মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের স্বার্থে বিধি-১২-এর বিধান অনুসারে আগামী ১১/১১/২০২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ছুটিতে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হল।’
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তদন্তেও তার দুর্নীতি ধরা পড়েছে। ওই কমিটি ভদ্রকে ডেকে চার ঘণ্টা জেরা করেছে বলে জানা যায়। তিনি কোনো উত্তর দিতে না পারায় তাকে অফিসে যোগদান না করে বাসায় থাকতে বলা হয়। সেই থেকে প্রায় দুই মাস তিনি অফিসও করেননি। মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্তে ভদ্রের দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এর আগে করোনা পজিটিভ হওয়া সত্ত্বেও তিনি তা গোপন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমালোচনার মুখে পড়েন।
ভদ্রের বিরুদ্ধে দুর্নীতির খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, ‘পোস্ট ই-সেন্টার’ প্রকল্পের জন্য কম্পিউটার ও যন্ত্রপাতি কেনায় টেশিসের সঙ্গে পারস্পরিক যোগসাজশ ও সমঝোতা করে তিনি কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের সুযোগ নেন। দুদকের টেবিলে থাকা অভিযোগ থেকে জানা যায়, তার দুর্নীতির প্রক্রিয়াও অভিনব। প্রথমে তিনি তার পছন্দে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান থেকে অত্যন্ত নিুমানের কম্পিউটার ও যন্ত্রপাতি বাজারমূল্য থেকে বেশি দামে ক্রয় করেন। এরপর টেশিস তার লাভ যোগ করে ডাক বিভাগের কাছে বিক্রি করে।
টেশিস যে বিল পরিশোধ করে তা কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই ভদ্র তাদের বিল পরিশোধ করে কমিশন নেন। যেসব যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে তার বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ভদ্রকে এসব কাজে কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সহায়তা করেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের সম্পৃক্ততা দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
জানা গেছে, ই-পোস্টাল প্রকল্পের মতো একই প্রক্রিয়ায় প্রকল্পের জন্য বন শিল্প থেকে অত্যন্ত নিুমানের আসবাবপত্র কেনা হয়। তিনজন কর্মকর্তা এসব আসবাবপত্র গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাদের ওপর চড়াও হন ভদ্র। তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নিুমানের আসবাবপত্রগ্রহণ ও প্রত্যয়নপত্র দিতে বাধ্য করেন তিনি।
অনুসন্ধান সূত্র থেকে জানা যায়, এই প্রকল্পের আওতায় পোস্ট অফিসের জন্য সোলার প্যানেল ধরা ছিল। কিন্তু এই খাতেও পুকুরচুরি হয়। সোলার প্যানেল বাজারমূল্যের চেয়ে চার গুণ বেশি দামে কেনা হয়। এই খাতের জন্য সার্ভার, সিপিইউ, ইউপিএস’সহ কিছু টেকনিক্যাল সামগ্রী আলাদা করে বরাদ্দ থাকলেও পুরো টাকাই মেরে দেয় ভদ্র ও তার সিন্ডিকেট। বিষয়টি জানাজানি হলে পরিকল্পনা কমিশন ও অডিট বিভাগ থেকে তদন্ত করা হয়। তখন তিনি তড়িঘড়ি করে পেছনের তারিখ দিয়ে বরাদ্দের কিছু মালামাল সরবরাহ দেখান, যা কিছুদিন পরই নষ্ট হয়ে যায়।
এই প্রকল্পের আওতায় আরেকটি বড় দুর্নীতি হয়েছে ভবন নির্মাণ ও মেরামতে। ভদ্র এই কাজে তার অনুগত একাধিক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন। এ পর্যায়ে পরস্পর বোঝাপড়ার মাধ্যমে কারসাজির টেন্ডারে সিন্ডিকেটকে কাজ দেয়া হয়।
এই কাজ থেকে ভদ্র এবং তার পছন্দের কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়ে নেন ঠিকাদারের কাছ থেকে। চট্টগ্রাম ও খুলনা সার্কেলে এখনও ভবন নির্মাণ না হলেও টাকা তুলে নিয়ে গেছেন তারা। ডাক বিভাগের সদর দফতর নির্মাণ ও সংস্কারে ৯৯ কোটি টাকার কাজ এবং কর্মচারীদের জন্য ৪০০ কোটি টাকার ৮টি বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ বর্তমানে চলমান।
ভদ্রের কারসাজিতে একটি প্রতিষ্ঠানই দুটি কাজ পেয়েছে। ২০ ভাগ কমিশন নিয়ে কার্যাদেশ দিয়েছেন বলে প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা জানান। দুদকের অনুসন্ধানেও এমনই তথ্য বেরিয়ে আসছে।
চক্রটি নোট কাউন্টিং মেশিন ও ফ্রাংকিং মেশিন টেশিসের কাছ থেকে ক্রয় দেখায়। অথচ টেশিস এসব মেশিন তৈরিই করে না। অথচ এক লাখ টাকার মেশিনের বিল ধরা হয় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
পোস্টাল ক্যাশ কার্ড প্রকল্প থেকেও চক্রটি কয়েক কোটি টাকা মেরে দেয়। এই প্রকল্পের আওতায় প্রথমে সব ডাকঘরসহ উপজেলা ও সাব পোস্ট অফিসে ‘পিওএস’ মেশিন সাপ্লাই দেয়া হয়। বাস্তবে এই ক্যাশ কার্ড দিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো লেনদেন কোথাও হয়নি। জনগণও জানে না এমন একটি প্রকল্পের সেবার কথা। অর্থ পকেটে তোলার জন্যই ৯ হাজার ৫০০ ‘পিওএস’ মেশিন কেনা হয়। এসব মেশিন ২/৩ বছর পোস্টাল ডিভিশনে বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে।
এই সার্ভিসটির সঙ্গে ডাক বিভাগের পার্টনার আইটিসিএল নামক একটি প্রতিষ্ঠান। যোগসাজশ করে ভদ্র প্রথমে ক্যাশ কার্ডে ভুয়া জমা দেখান। এই খাতে জিপিও থেকে ঠিকাদারের নিয়োজিত প্রতিনিধির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উঠিয়ে নেয়া হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে অস্বাভাবিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, যে পরিমাণ অর্থ কার্ডে জমা হয়েছে, তার চেয়ে ২০ কোটি টাকারও বেশি অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে।
দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি টিম সুধাংশুর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আছে অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধানে অভিযোগের বিষয়ে সত্যতাও মিলেছে বলে জানা যায়। সুধাংশু ছাড়াও প্রকল্প ও ডাক বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। টিমের একজন কর্মকর্তা জানান, পোস্ট ই-সেন্টার প্রকল্পে অনিয়ম সবচেয়ে বেশি হয়েছে। কোটি কোটি টাকা তছরুপ করেছেন ভদ্র ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
এছাড়া ডাক অধিদফতরের সদর দফতর নির্মাণে দুর্নীতি, টেশিসের সঙ্গে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, সোলার প্যানেল ক্রয়প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং পোস্টাল ক্যাশ কার্ড বাস্তবায়নে আইটিসিএল ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে চুক্তি ও ক্রয়প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। এর বাইরে ডাক বিভাগে অন্তত ৩০০ লোক নিয়োগে ভদ্রের বিরুদ্ধে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগও অনুসন্ধানে রয়েছে।
সূত্র জানায়, ডাক বিভাগের কর্মীদের একটি অংশ নামে-বেনামে হিসাব খুলে একটি পাস বই নেন। এতে তারা টাকা জমা না করেই বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ এন্ট্রি করেন। পরে তারাই সেগুলো লেজারে যুক্ত করেন।
এই প্রক্রিয়ায় মেয়াদ শেষে বা মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই টাকা তুলে নেন। এভাবে অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ডাক বিভাগের যে কোনো অফিসে কোনো জালিয়াতি বা অর্থ আত্মসাতের ঘটনা উদ্ঘাটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে জানানোর বিধান রয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনা তারা তাৎক্ষণিকভাবে মন্ত্রণালয়কে জানাচ্ছে না। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক এসকে মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন, সুধাংশু ভদ্র এই বিভাগকে ডুবিয়েছে। এমন কোনো দুর্নীতি নেই, যা তাকে দিয়ে হয়নি। আমি নিজে তার এসব ঘটনা জানিয়ে দুদকে ডিও লেটার দিয়েছি। ওখানে কী হয়েছে জানি না।