ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হাসান মাহমুদ স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) রুহুল আমিন মাদানীর ছেলে। চাকরি দেওয়ার কথা বলে লোকজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আত্মসাৎ, মাদক কারবারসহ নানা অপকর্মের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ও কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে বিভিন্নজনের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সম্প্রতি এমন একটি ঘটনায় বিপদ বুঝে ঘুষের ১৪ লাখ টাকা তিনি ফেরত দিয়েছেন।
কয়েক দিন আগে হাসানের সঙ্গে ঘুষ লেনদেন বিষয়ে মোবাইল ফোনে কথোপকথনের একটি রেকর্ড ফাঁস হয়। এরপর টাকা দিয়ে চাকরি না পাওয়া একজন প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর আবেদন করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত শনিবার ওই ব্যক্তিকে টাকা ফেরত দেওয়া হয়। টাকা ফিরে পাওয়া ওই ব্যক্তির নাম আবুল কালাম শেখ। পুলিশের কনস্টেবল পদে তাঁর ছেলের চাকরির জন্য তিনি এমপিপুত্রকে ওই টাকা দিয়েছিলেন।
আবুল কালাম শেখ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছেলের চাকরির জন্য আমি এমপির বাসার কর্মচারী তাজুর (তোফাজ্জল হোসেন) মাধ্যমে টাকাটা দিয়েছিলাম। শনিবার তাঁর মাধ্যমেই টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন আর তাঁদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। টাকা যেহেতু ফেরত পেয়েছি, আমি অভিযোগও প্রত্যাহার করে নেব।’
সংসদ সদস্য রুহুল আমিন মাদানী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই অভিযোগ সত্য নয়। অভিযোগকারী নিজেই এফিডেভিট করে তাঁর অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর স্বাক্ষর জাল করে ওই অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।’
গত ২৯ অক্টোবর আইজিপির কমপ্লেইন মনিটরিং সেলে লিখিত অভিযোগ করেন কালাম শেখ, যার নম্বর ১৫৩৬ (২৯-১০-২০)। তিনি ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনের সংসদ সদস্য রুহুল আমিন মাদানী, তাঁর ছেলে হাসান মাহমুদ ও হোসাইন প্রিন্স, তাঁদের বাসার কর্মচারী তোফাজ্জল হোসেনের বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার কথা বলে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, তোফাজ্জল হোসেন গত বছর পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল পদে তাঁর ছেলেকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেন। তোফাজ্জল তাঁকে বলেছেন, সংসদ সদস্য ডিও লেটারের (আধাসরকারি পত্র) মাধ্যমে পুলিশ কনস্টেবল পদে ৫০-৬০ জনকে নিয়োগ দেবেন। এমপি ও তাঁর দুই ছেলের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে কালাম বলেছেন, হাসান মাহমুদ তোফাজ্জলের কাছে ১৪ লাখ টাকা জমা দিতে বলেন। তিনি পৈতৃক জমি বিক্রি করে এবং সুদের ওপর ধারদেনা করে ১৪ লাখ টাকা শরিফুল ইসলামের উপস্থিতিতে তোফাজ্জলকে দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টাকা লেনদেনের সময় সাক্ষী হিসেবে থাকা যে শরিফুল ইসলামের কথা বলা হয়েছে তিনি ত্রিশাল পৌর এলাকার নওধারের বাসিন্দা। পুলিশের এসআই পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাঁর কাছ থেকেও হাসান মাহমুদ ২২ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন আবুল কালাম শেখ। তিনি জানান, চাকরি না হওয়ার পর টাকা ফেরত চাইতে গেলে নানা হুমকি-ধমকির মুখে পড়েন। এ জন্য তিনি গত ১১ জুলাই ত্রিশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন, যার নম্বর ৬১৪।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবুল কালাম শেখের কাছ থেকে নেওয়া ১৪ লাখ টাকার মধ্যে ১২ লাখ টাকা এমপি পরিবারের হাতে তুলে দেন তোফাজ্জল। দুই লাখ টাকা রাখেন নিজে। চাকরি দিতে না পারায় পাঁচ লাখ টাকা তোফাজ্জলকে ফেরত দেয় এমপির পরিবার। বাকি টাকা এত দিন ধরে আটকে রেখেছিলেন তাঁরা।
সম্প্রতি হাসান মাহমুদের সঙ্গে শরিফুল ও তোফাজ্জলের মোবাইল ফোনে কথোপকথনের রেকর্ড ফাঁস হয়। শরিফুল বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ঘুষের টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করছিলেন। সেই ফোন কল রেকর্ড থেকে পুলিশে চাকরি দেওয়ার কথা বলে এমপি রুহুল আমিন মাদানী ও হাসান মাহমুদের টাকা নেওয়ার সত্যতা প্রকাশ পায়। ফোন কলের রেকর্ড অনুযায়ী, হাসানের সঙ্গে প্রথমে শরিফুল কথা বলেন। পরে কথা বলেন তোফাজ্জল। ঘুষের ১২ লাখ টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হাসানকে অনুরোধ করতে শোনা যায় তোফাজ্জলকে। ফোন কলের ওই রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় বেকায়দায় পড়ে এমপি পরিবার। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুদক ও আইজিপির কাছে অভিযোগ দেওয়ার ফলে আবুল কালাম শেখকে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বিষয়টি সুরাহা করেন হাসান মাহমুদ। গত রবিবার আবুল কালামকে দিয়ে একটি এফিডেভিটেও স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়। সেখানে এমপির পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই বলে ঘোষণা দেন আবুল কালাম।
আট বছর ধরে ত্রিশাল ছাত্রলীগের সভাপতি হাসান : হাসান মাহমুদ ২০১২ সালে ত্রিশাল উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হন। এক বছর মেয়াদি ওই কমিটির আট বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো একই পদে বহাল তিনি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর বাবা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় দাপট আরো বেড়ে গেছে। নিয়ম অনুযায়ী, বিবাহিতরা ছাত্রলীগের নেতা হতে পারেন না, কিন্তু দুই সন্তানের জনক হয়েও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পদে আছেন হাসান।
মাদক কারবারের অভিযোগও আছে হাসানের বিরুদ্ধে : মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে হাসান মাহমুদের বিরুদ্ধে। গত সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘ময়মনসিংহ সচেতন মহল’ ব্যানারে শতাধিক নারী-পুরুষ মানববন্ধন করেন। সেখানে হাসানের বিরুদ্ধে ইয়াবা কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের দাবি জানানো হয়।
সূত্রগুলো জানায়, চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি হাসান মাহমুদ তাঁর দলবল নিয়ে কক্সবাজার বেড়িয়ে ফেরার পথে রাজধানীর হাতিরঝিল থানা এলাকায় তাঁদের গাড়িবহর আটকায় পুলিশ। হাসানের সহযোগী ত্রিশালের মঠবাড়ী ইউনিয়ন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মনিরুল ইসলাম রুবেলকে ইয়াবা ট্যাবলেটসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
হাসানের বক্তব্য : এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও এসএমএস দিয়ে হাসান ও তোফাজ্জলকে পাওয়া যায়নি। গত সোমবার ত্রিশালে সংবাদ সম্মেলন করেন হাসান মাহমুদ। লিখিত বক্তব্যে তিনি দাবি করেন যে তাঁর বাবা ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একটি কুচক্রী মহল ষড়যন্ত্র করছে। তারাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুদক ও আইজিপির কাছে অভিযোগ দিয়েছে। ফোন কলের রেকর্ড ফাঁস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আমার নাম করে একটি অডিও ক্লিপ প্রকাশিত হয়, যা আমার বোধগম্য নয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আমাকে ও আমার পরিবারকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।’