পুরান ঢাকার নির্বাচিত আইনপ্রণেতা হলেও হাজী সেলিমের দখল সাম্রাজ্য রাজধানীর বাইরেও বিস্তৃত। ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জায়গা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমি, ভবন, মার্কেট- যেখানে যেভাবে পেরেছেন দখলের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় ছেলে ইরফান সেলিম গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ঢাকা-৭ আসনের দাপুটে এই সাংসদের ‘দখলকাহিনী’।
বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) হাজী সেলিম পরিবারের অবৈধ সম্পদের খোঁজে নেমেছে।
এলাকাবাসী মনে করছে, হাজী সেলিমের দখল করা সম্পদ-স্থাপনা উদ্ধারের এখনই উপযুক্ত সময়।
তবে যাদের বেহাত হয়েছে, তারা কেউই মুখ খুলতে চান না। তাদের শঙ্কা, পরিস্থিতি অনুকূলে এলে তারা হাজী সেলিম পরিবারের রোষানলে পড়তে পারেন।
হাজী সেলিমের দখল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের এই জায়গা।
বধিরদের জমিতে পেট্রোল পাম্প
শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের জন্য স্কুল ভবন ও বধির কমপ্লেক্স নির্মাণে ২০০৫ সালে লালবাগের কামালবাগ এলাকায় এক একর জমি বরাদ্দ দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। জমিটি সরকারের অকৃষি খাসজমি। শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য দেশের একমাত্র সরকারি এ উচ্চ বিদ্যালয়টি বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার প্রধান প্রকল্প।
বধির স্কুলের পক্ষে বরাদ্দের নথি থেকে জানা গেছে, ২০০৫ সালে পাঁচ লাখ টাকা প্রতীকী মূল্যে বরাদ্দ দেওয়া হয় জমিটি।
বধির স্কুল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বরাদ্দ পাওয়ার পর তিন বছর জমিটি তাদের দখলে ছিল। ২০০৮ সালে হাজী সেলিমের লোকজন জমির সীমানা খুঁটি উপড়ে ফেলে, লোকজনকে মেরে তাড়িয়ে দিয়ে জমির দখল নেয়। এখন সেখানে হাজী সেলিমের ফিলিং স্টেশন ।
জমি ফিরে পেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে। পালন করা হয়েছে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনের মতো কর্মসূচি। সবশেষ গত ২৭ অক্টোবর জমি উদ্ধারে সহযোগিতা চেয়ে র্যাবের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেছে বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা।
জায়গার মালিকানা দাবি করে হাজী সেলিম ২০০৯ সালে আদালতে মামলা করেছিলেন। মামলার রায় স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষে গেলেও হাজী সেলিমের দখল থেকে জমিটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার নির্বাহী অফিসার মজনু শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০০৫ সাল থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষ জমির খাজনা পরিশোধ করে আসছে। এ পর্যন্ত তিন দফায় জেলা প্রশাসন জায়গাটির দখল স্কুল কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়েছে।
“সারাদেশের বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, চিকিৎসা, পুনর্বাসনের জন্য জমিটি নেওয়া হয়েছিল। জমিটি দখল হয়ে যাওয়ায় এ কাজগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখন আমরা যেখানে কাজ করছি সেখানে জায়গা কম। এ কারণে সে সময় সরকারের কাছে আবেদন করে ওই জায়গাটি নেওয়া হয়েছিল।”
হাজী সেলিমের এই ‘গুলশান আরা সিটি মার্কেট’ জমিতে ছিল জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীদের তিব্বত হল।
শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য ঢাকার বিজয়নগরে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি ১৯৮৪ সালে জুনিয়র হাইস্কুল হিসেবে এমপিওভুক্ত হয়। মাধ্যমিক স্তরের স্বীকৃতি আসে এর ছয় বছর পর। সরকারিকরণ হয় ২০১৬ সালে।
বধির স্কুলের পক্ষে জমির বন্দোবস্তগ্রহীতা এবং জাতীয় বধির সংস্থার সাবেক সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, “হাজী সেলিমের ভয়ে কেউ কথা বলে না। আমরা অনেকবার অনেক সরকারি কর্মকর্তার কাছে বিষয়টি সুরাহার জন্য গেছি। সবাই আশ্বাস দেয়, কিন্তু হাজী সেলিমের কথা শুনলেই তাদের মুখ শুকিয়ে যায়।
“এ অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া ওই জমি উদ্ধার করা সম্ভব হবে না।”
এ প্রসঙ্গে হাজী সেলিমের আইনজীবী শ্রী প্রাণ নাথ বলেন, তৈমুর আলম খন্দকার ওই সময় (২০০৩) বিএনপির ক্ষমতাবলে জোর করে হাজি সেলিমের ক্রয়কৃত জমি দখল করতে এসেছিলেন। জমিটি নিয়ে মামলা চলছে বলেও তিনি জানান।
আরও দখল
সোয়ারীঘাট এলাকার এক বাসিন্দা জানান, কমিশনার থাকার হাজী সেলিম বিভিন্ন ঘাট ও বাজার ইজারার নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন। আর সংসদ সদস্য হওয়ার পর শুরু করেন দখল।
বধির স্কুলের জমি ছাড়াও পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে অগ্রণী ব্যাংকের জমি দখলে রেখেছিলেন তিনি। ছেলে ইরফান আটক হওয়ার পর ওই জমি নিজেদের দখলে নিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক।
হাজী সেলিমের দখলে আছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিব্বত হল।
কামরাঙ্গীরচরের ঝাউচরে বিআইডব্লিউটিএর এক একর জমি দখল করে স্থাপনা বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন হাজী সেলিম। সেসব স্থাপনা উচ্ছেদও করা হয়েছিল, কিন্তু ধরে রাখা যায়নি।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, “উদ্ধার করে আসার পরপরই ওই জমি দখলে নিয়েছেন হাজী সেলিম। উনি একই কাজ বারবার করছেন।”
চকবাজারের ছোট কাটরায় হাজী সেলিমের বাবার নামে করা চাঁন সরদার কোল্ড স্টোরেজের জায়গাটিও জোর করে দখলে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
হাজী সেলিমের দখল থেকে তিব্বত হল উদ্ধারের দাবিতে মানবববন্ধনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
চকবাজার এলাকার নলগোলা সর্দার হার্ডওয়্যার মার্কেটের মালিক হাজী সেলিম। সর্দার হার্ডওয়্যার যেখানে বানানো হয়েছে সেটি ভাওয়াল এস্টেটের সম্পত্তি। এই সম্পত্তি নিয়ে ভাওয়াল এস্টেটের সঙ্গে মামলা চলছে।
গত ঈদুল ফিতরের আগের রাতে চকবাজারের বশির মার্কেট ভেঙে ফেলেন হাজি সেলিম। রাতারাতি দখলে নিয়ে নেন এই মার্কেটটি।
চকবাজারের মদিনা আশিক টাওয়ারও হাজী সেলিম কৌশলে দখল করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আশিক টাওয়ারটি আগে ফেন্সি মার্কেটের অংশ ছিল। এলাকাবাসী বলছেন, প্রথমে ফেন্সি মার্কেটের কয়েকজন ব্যবসায়ীকে হাত করে তাদের দোকান কিনে নেন হাজী সেলিম। পরে অন্য দোকানদারকে চাপ দিয়ে আশিক টাওয়ার ভেঙ্গে নতুন বহুতল ভবন গড়ে তোলা হয়।
নতুন মার্কেটে পুরনো অনেককেই আর ঠিকভাবে দোকান বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। তাছাড়া আগের মার্কেটে জুতার দোকান থাকলেও নতুনটিতে জুতার দোকান থাকবে না জানানো হলে কয়েকজন ব্যবসায়ী বিপাকে পড়েন।
চকবাজারের জাহাজ বাড়ি ছিল ঢাকার প্রথম বাণিজ্যিক ভবন। এই ভবনটিও ভেঙে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে।
রাজধানীর গ্রিন রোডে এক বিঘা আয়তনের একটি সরকারি জায়গা দখল করে মদিনা গ্রুপের অফিস বানানো হয়েছে।
লালবাগ বেড়িবাঁধ এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় এক একর জমি দখল করে রড, সিমেন্টের মার্কেট এবং কালুনগরে ১০ শতাংশ জমি দখল করে ছয়তলা ভবন নির্মাণ করেছেন হাজী সেলিম। তবে এই মার্কেটের সামনের অংশ সম্প্রতি উচ্ছেদ করা হয়েছে।
তবে হাজী সেলিমের আইনজীবীর দাবি, মদিনা ট্যাংক ও টাইগার সিমেন্টের ব্যবসা করে সম্পদ গড়েছেন এই সাংসদ।
ছেলে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সোনারগাঁওয়ে হাজী সেলিমের দখলে থাকা জমি উদ্ধারে অভিযান শুরু হয়েছে।
আইনজীবী প্রাণ নাথ বলেন, “মানুষ এখন প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে এসব কথা বলছেন। হাজী সেলিম কখনও কোনো জমি জবরদখল করে কেনেননি। উনার প্রতিটি জমিই নামজারি করা এবং কোনো ভেজাল জমি কিনেননি।
নলগোলা ভাওয়াল এস্টেটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,৩৬ শতাংশ জমিসহ আরও জমি নিয়ে মামলা চলছে। ওই সম্পত্তি মালিকানা এবং হাজি মালিকদের কাছ থেকে কিনেছেন।
মামলা চলা অবস্থায় ভবন তৈরি করা হয়েছে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদালত থেকেতো এমন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি যে, কিছু নির্মাণ করা যাবে না।
দীর্ঘ ত্রিশ বছর হাজী সেলিমের আইনজীবী হিসেবে জড়িত পাননাথ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, উনার (হাজী সেলিম) শখ শুধু সম্পদ করা। অনেক সম্পদ আছে তার কিন্তু কোনো সম্পদই ভেজাল নয়।”
তবে এলাকাবাসীর দাবি, হাজী সেলিম সব সময় ভেজাল সম্পত্তিই বেশি ক্রয় করেন। এছাড়া ওয়াকফ, সরকারি জমির দিকে বেশি নজর তার।
এলাকাবাসীর কথার সত্যতাও পাওয়া গেছে সম্প্রতি। গত ১ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে হাজী সেলিমের মদিনা গ্রুপের দখলে থাকা ১৪ বিঘা খাস জমি উদ্ধার করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
সোনারগাঁও উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আল মামুন বলেছিলেন, মদিনা গ্রুপের যত অবৈধ স্থাপনা, সব চিহ্নিত করা হয়েছে।
সেখানে তার সিমেন্ট কারখানার দুইপাশে প্রায় ১৪ বিঘা জমি দখল করে রাখা হয়েছে।
সম্পূর্ণ জমিটি চিহ্নিত করা হয়েছে জানিয়ে আল মামুন বলেছিলেন, দখলে থাকা তিনটি স্থাপনা ভাঙা হয়েছে আরও একটি স্থাপনা খুবই শক্ত ও ভারি হওয়ায় ভেকুতে সমস্যা হয়েছে।
তবে ওই সব স্থানে লাল পতাকা টানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।