কেবল অক্টোবরেই রাজধানীর কয়েকটি ফুটপাত ও ঝোপঝাড় থেকে চার নবজাতককে উদ্ধার করে পুলিশ। এদের মধ্যে দুটি জীবিত এবং দুটি শিশু ছিল মৃত। ডাস্টবিন, ফুটপাত, ঝোপ ও শৌচাগার; এসবই যেন অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুগুলোর ঠিকানা হয়ে উঠছে ক্রমে। সকরুণ কান্নার শব্দে আঁতকে ওঠা লোকজন দ্রুত উদ্ধার করে কাউকে নিয়ে যায় হাসপাতালে, তুলে দেয় প্রশাসনের জিম্মায়। সেখান থেকে পরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে একটা সত্যিকারের আশ্রয়ের সন্ধান পায় হতভাগা শিশুটি। আর মৃত উদ্ধার হলে স্থান হয় মর্গে। এরপর পুলিশ দায়ের করে হত্যা মামলা। কিন্তু আসামি কে? কেউ ধরা পড়েছে এ পর্যন্ত? উত্তর হলো ‘না’।
নবজাতকের সঙ্গে এমন পাষণ্ড মা কিংবা বাবার একটা বড় সূত্র কিন্তু থেকেই যায়। তা হলো ডিএনএ। ওটার সূত্র ধরেও এ পর্যন্ত এমন কাউকে ধরা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা নবজাতকের পরিচয় ও খুনি শনাক্তে তাদের তদন্তের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমাদের ডিএনএ ব্যাংক নেই। কেবল নবজাতকের ডিএনএ রাখলে তো হবে না। সকল নাগরিকের ডিএনএ থাকলে ম্যাচিং করতে পারতো। কিন্তু কেবল নবজাতকের ডিএনএ সংরক্ষণ করে লাভ নেই। আমাদের দেশের পরিচয়হীন বয়স্ক তো দাফন করা হয় অজ্ঞাত হিসেবে। অনেক সময় বছর ধরে ফ্রিজে রাখা হয় পরিচয় না পেয়ে। এমন লাশও আছে ডিএমসিতে। বয়স্কদের আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র খোঁজা হয়। কিন্তু নবজাতকদের সেই পদ্ধতিও থাকে না।
তিনি আরও বলেন, নবজাতক ফেলে দেওয়া বা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো পরিবারের মাধ্যমেই ঘটে। তাই কখনও কেউ অভিযোগ নিয়েও আসে না। পুরো বিষয়টি থাকে সূত্রহীন। ব্যাগে, বস্তায়, কার্টন, বালতিসহ বিভিন্ন কায়দায় গোপনে এসব কাজ করে। যা তদন্ত খুবই চ্যালেঞ্জিং।
সূত্র না মিললে আগায় না তদন্ত। নিহত নবজাতকদের ক্ষেত্রে হত্যা মামলা হলেও বছরের পর বছর সেই মামলার কোনও অগ্রগতি হয় না। তবে পুলিশ জানিয়েছে, প্রতিটি ঘটনারই তদন্ত হয়।
গত ১৪ অক্টোবর বিকেলে খিলক্ষেতের একটি সড়কের ফুটপাতে পড়ে থাকা কাপড়ের শপিং ব্যাগ থেকে এক নবজাতক দেখতে পান সমরেশ মণ্ডল নামে এক ট্রাফিক সার্জেন্ট। খিলক্ষেত থানায় জানালে, নবজাতককে উদ্ধার করে খিলক্ষেত থানা পুলিশ।
উদ্ধারের পর ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে সমাজ সেবা অধিদফতরের পরিচালিত আজিমপুরের ছোটনিবাসে পাঠানো হয় শিশুটিকে। শিশুটি এখন সেখানেই আছে। নবজাতক পুলিশের সহায়তায় জীবন পেলেও পুলিশ তার এই পরিণতির জন্য দায়ীদের গত ১৫ দিনেও আটক করতে পারেনি।
খিলক্ষেত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বোরহান উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা নবজাতককে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। এরপর কী হয়েছে আর জানি না। তবে জানতে পেরেছি শিশুটি সুস্থ আছে।’
নবজাতককে কারা কীভাবে এখানে রেখে গেলো, কোনও ক্লু আছে কিনা জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘কাউকে আটক করা হয়নি। জানা যায়নি নবজাতকটি কীভাবে ওখানে এলো।’
খিলক্ষেতের এই ঘটনার ছয়দিন পর গত ২০ অক্টোবর সকালে রাজধানীর হাজারীবাগ থানার ৫৩ এনায়েতগঞ্জ লেনের একটি ময়লার বালতি থেকে একটি কন্যাশিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজিদুর রহমান সাজিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশুটিকে এলাকার কেউ চিনতে পারছে না। একটি ডাস্টবিনের কাছে ময়লার বালতিতে লাশ ফেলে রাখা হয়েছে। আমরা ধারণা করছি, শিশুটিকে অন্য কোথাও মেরে এখানে ফেলে রাখা হয়েছে। শিশুটির বয়স এক থেকে দেড় বছর হবে।’
ঘটনার পর হাজারীবাগ থানা পুলিশ অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেছে। তবে এই মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই। ওসি জানান, ‘আমরা লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করিয়েছি। নবজাতককে এলাকার কেউ চেনে না। ঘটনার পর ওই সড়কের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধার করেছি, কিন্তু নবজাতককে রাতে রেখে যাওয়ায় ফুটেজও অন্ধকার। কাউকে চিহ্নিত করা যায়নি। তদন্ত চলছে।’
পরিত্যক্ত অবস্থায় নবজাতকের মৃতদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ প্রতিটি ঘটনাতেই হত্যা মামলা করে। এসব মামলা তদন্তে দীর্ঘ সময় লাগে। অভিযোগপত্রও হয় নগণ্য।
খিলক্ষেত্র ও হাজারীবাগের এই ঘটনার পর গত ২৮ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাস থেকে নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জানা যায়নি, কীভাবে নবজাতকের লাশ দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে এলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খুবই অমানবিক একটি কাজ হয়েছে। কে বা কারা শিশুটিকে ফেলে গেছে জানা যায়নি।’
গত মাসে কেরানীগঞ্জ উপজেলার কালিন্দী ইউনিয়নের ব্রাহ্মণকিত্তা এলাকার বাজার রোড থেকে এক নবজাতক, ধামরাইয়ের ফুটপাত থেকে এক নবজাতক উদ্ধার হয়েছে। কোনোটির ক্ষেত্রেই অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
ঢাকার রাস্তায় প্রতিবছর এমন কত নবজাতক পাওয়া যায়, তার পরিসংখ্যান নেই কোনও সংস্থা বা মানবাধিকার সংগঠনের কাছে। জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত এই সংশ্লিষ্ট খবর থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেছে, গড়ে প্রতি মাসে অন্তত একটি নবজাতক পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জন্মের পর একটি নবজাতকের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটে, যা সকল নিষ্ঠুরতাকে হার মানায়। জন্মের পরই সে নির্মমতার শিকার হয়। এটা কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গুরুতর অপরাধ।’