লিখেছেন শাহ মোহাম্মদ মিনহাজুল আবেদিন
বিশ্বজুড়ে বহুল ব্যবহৃত একটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকের নাম ‘গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট’ সংক্ষেপে পরিচিত ‘জিডিপি’। পত্রিকার পাতায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির খবরে অনেকেই আশ্বস্ত হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন, কিন্তু অর্থনীতির মারপ্যাঁচে লুকিয়ে থাকে মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য, অর্থনৈতিক সক্ষমতা। দেশ বা বিশ্বের অর্থনীতিকে বোঝার জন্য জন্য ‘জিডিপি’ আসলে কেমন মানদণ্ড? আপনার দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি মানেই কি দেশের অর্থনীতি সঠিক পথে আছে?
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক সমুদ্রে একটি তেলের ট্যাংকার ডুবি হলো, বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হলো কিন্তু একইসাথে সেই তেল পরিষ্কার করার জন্য বিনিয়োগ শুরু হলো, বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান হলো একে কেন্দ্র করে, বীমার টাকার হাতবদল হলো। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো অর্থনীতির লেন্সে দেখলে তেলের ট্যাংকার ডুবির ঘটনা যে দেশের সাথে জড়িত, এই তেল পরিষ্কারে কর্মী নিয়োগ জড়িত, তার জিডিপি বাড়বে! কিন্তু বাস্তবতা আসলে কী?
আবার ধরা যাক উইকিপিডিয়ার কথা, বিনামূল্যে এটি জ্ঞান বা সেবা সরবরাহ করছে, সুতরাং এখানে খোলা চোখে অর্থের লেনদেন জড়িত না কোনোভাবেই, নেই কোনো সাবস্ক্রিপশন মডেল কিংবা বিজ্ঞাপন আয়। সুতরাং জিডিপিতে এর ভূমিকা শূন্য। আবার গৃহিণীদের কাজ যেমন, ঘর সামলানো কিংবা বাচ্চাদের লালন পালনও একই কাতারে পড়বে। জিডিপিতে এর ভূমিকাও শূন্য। তাহলে জিডিপি কী মাপছে, কেন মাপছে আর কীভাবে মাপছে?
আমেরিকার মহামন্দা ও অর্থনৈতিক সচেতনতা
১৯২৯ সাল থেকে আমেরিকার অর্থনীতির ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা মহামন্দার সময়ে অর্থনীতির স্বাস্থ্য বিশ্লেষণে বিভিন্ন সূচক নিয়ে কাজ শুরু হয়। গ্রেট ডিপ্রেশনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত তাকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা নিয়ে ভাবনা শুরু হয়, কারণ ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ একটি সিদ্ধান্তের পর শুধুই কতগুলো কাগজ হয়ে যেতে পারে। বাজারে বিনিময়যোগ্য পণ্য না থাকলে অর্থ বা মুদ্রা খানিকের মাঝেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে পারে। আমেরিকার গ্রেট ডিপ্রেশন, ইউরোপজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ছোট বড় আঞ্চলিক কিংবা জাতীয় মন্দায় এ ধরনের ঘটনা দেখে গেছে। তাই অর্থনীতিবিদ তো বটেই বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী সাধারণ মানুষ অর্থনীতির স্বাস্থ্যকে পর্যবেক্ষণ করতে চান। জানতে চান কী হচ্ছে, মন্দা আসছে কিনা?
তাই মন্দা আসছে কিনা, অর্থনীতির স্বাস্থ্য কেমন তা বুঝতে এবং সাধারণ মানুষকে ধারণা দিতে জিডিপির সূচনা হয় অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেটসের হাত ধরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ জন মেয়নার্ড কেইনসের হাতে এই ধারণা আরো পরিপক্ক হয়। জিডিপির সাধারণ ফর্মুলাটি হলো, একটি দেশের অর্থনীতিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সব বিনিয়োগ, সরকারের ব্যয়কৃত অর্থ, নিট রপ্তানি আয়, ভোক্তাদের চাহিদা ব্যয়কৃত অর্থের যোগফল এবং এই যোগফল থেকে নিট আমদানি ব্যয় বাদ দিয়ে এবং মুদ্রাস্ফীতিকে সমন্বয় করে জিডিপি নির্ধারণ করা হয়। এই জিডিপি মানের হিসেব করতে কোন খাতে সরকার ব্যয় করলো, সেটি কি হাসপাতাল-স্কুলের মতো জরুরী অবকাঠামো বানাতে নাকি নাকি অস্ত্র কিনতে তা হিসেব করার বালাই নেই।
ভোক্তারা কী কিনলো, সেটি কি বিলাসদ্রব্য নাকি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস, তা নিয়েও মাথা ঘামানো হয় না জিডিপিতে। বিনিয়োগে বন কেটে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে কিনা তারও কোনো পরিমাপ নেওয়া হয় না। অর্থাৎ, জিডিপির নির্ধারণে মানুষের ভালো-মন্দ, বিনিয়োগ টেকসই কিনা তার হিসেব করা হয় না। তাই জিডিপি ধারণার প্রবক্তা সাইমন কুজনেটস এবং অনেক খ্যাতিমান কেইনিসিয়ান অর্থনীতিবিদ জিডিপিকে শুধুই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতার সূচক হিসেবে দেখিয়েছেন। একে মানব উন্নয়ন কিংবা টেকসই উন্নয়নের কোনো মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষপাতি ছিলেন না তারা।
তবে এই সূচকটির ব্যাপক রাজনীতিকরণ করা হয়েছে! মানুষকে স্বল্প মেয়াদে আশা দেখানো আর প্রতিশ্রুতির বাণী শোনাতে জিডিপি ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু কেন?
জিডিপির হিসেবে সাধারণ মানুষের গুরুত্বই নেই
জিডিপিকে প্রকাশ করা হয়ে থাকে বেশ কয়েকভাবে, একটি হচ্ছে জিডিপির সাংখ্যিক মান, আর একটি মাথাপিছু জিডিপি, অন্য একটি হলো জিডিপি প্রবৃদ্ধি। তিন নাম্বারটিকে রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ হিসাবটি বিগত বছরের সাথে তুলনা করে অথবা এক কোয়ার্টার (তিন মাস) সময় নিয়ে তুলনা করে প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
আবার মাথাপিছু জিডিপি দিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতা বা ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা করা হলে একজন কোটিপতি ভোক্তা, বিনিয়োগকারীর কারণে সাধারণ মানুষ সহজেই হিসেবের বাইরে চলে যান। অর্থাৎ, এই গড়ের তুলনা দিয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কিংবা বিনিয়োগের ক্ষমতার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না কোনোভাবেই।
অর্থাৎ ধনী দরিদ্রের মাঝে সম্পদের যত বৈষম্য বাড়বে, ধনীদের অর্থনৈতিক কাজের কারণে গরীব বা মধ্যবিত্তের কাজ ততই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে দ্রুত অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে গিয়ে, জিডিপি বাড়াতে গিয়ে বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়ছে। যেহেতু এই ঋণের বেশিরভাগ যতটা না লিখিতভাবে ঋণ হিসেবে ঢুকছে তারচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আকারে স্বল্পোন্নত দেশে ঢুকছে। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঁধে চড়ে বসছে ঋণের বোঝা, ঋণে ক্লান্ত হয়ে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তার বাজেট সংকোচন হচ্ছে।
কারণ এই সামাজিক নিরাপত্তায় টাকা ব্যয়কে রাখা হয়ে থাকে অনুৎপাদনশীল খাতের তালিকায়। তাই বিশেষ করে বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী যারা ‘ইনফরমাল ইকোনমি’র সাথে যুক্ত থাকেন বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো পেনশন পাওয়ার অধিকারী নয়, তাদের কর্ম থেকে অবসরের জন্য পরিবারের অন্য সদস্যের আয়ের উপর নির্ভর করতে হয়। বাংলাদেশ কিংবা পৃথিবীর অনেক দেশে এই ব্যাপারটি দীর্ঘদিন ধরেই হয়ে আসছে, একজন প্রবীণ দরিদ্র নাগরিক যে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সামাজিক সুরক্ষার দাবিদার এই চিন্তাও এখানে অনেকটাই অস্বাভাবিক।
জিডিপিতে টেকসই উন্নয়নের গুরুত্ব নেই
টেকসই উন্নয়ন বলতে সহজে মূলত বোঝানো হয়ে থাকে, যে উন্নয়নের ফলে ভবিষ্যৎ পৃথিবী নতুন কোনো সংকটের মুখে পড়বে না। ধরা যাক তৈরি পোশাক শিল্পের কথা, এই শিল্প বিশ্বের অন্যতম পানিগ্রাসী শিল্প। বাংলাদেশে এই শিল্পের গড়ে উঠার ফলে ভুগর্ভস্থ পানির উপর চাপ বাড়ছে, সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করতে গিয়ে বর্জ্যকে ব্যবস্থাপনা করে নদীতে ফেলার কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে অনাগত প্রজন্মের জন্য একদিকে ভুগর্ভস্থ পানি কমে আসছে পাশাপাশি নদীতে কিংবা খালে এসে মিশছে রং, ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান, ভারী ধাতু, যা খাদ্য শৃঙ্খলে ঢুকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে পুরো সমাজকে।
একইভাবে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের কথাও ধরা যেতে পারে, উন্নত দেশের দীর্ঘদিন ব্যবহৃত জাহাজ এসে পড়ছে স্বল্পোন্নত দেশের ইয়ার্ডে, কর্মসংস্থান এবং বিনিয়োগের দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে এই দেশগুলো এই শিল্পকে আত্মীকরণ করছে। কিন্তু পরিবেশ রক্ষার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। আর জিডিপির হিসেবে যদি দেখা যায়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতে বিনিয়োগ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মনযোগ নেই। বরং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যদি ব্যয়বহুল হয় তাহলে কোম্পানির মুনাফায় টান পড়বে। জনগণকে জিডিপির মারপ্যাঁচে দৃশ্যমান উন্নয়নকে বুঝানো সহজ হচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের পরিবেশ, মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যকে আমরা ঠেলে দিচ্ছি বাঘের খাঁচায়।
ইনফরমাল ইকোনমির গুরুত্ব নেই
বিশ্বজুড়ে বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষ জড়িত ইনফরমাল ইকোনমির সাথে, অর্থাৎ এ ধরনের কাজের মূল্যায়ন আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত নয়। এদের মাঝে কারো কাজ শ্রমঘন্টায় হিসেব করা সম্ভব নয়। যেমন, গৃহিণীদের ঘর সংসারের কাজ কিংবা শিশু লালন পালন। এছাড়াও আছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো। যেমন, উইকিপিডিয়ার কথা ধরা যাক, এই প্রতিষ্ঠানটির নিট কোনো মুনাফা নেই, অর্থাৎ কোনো দেশের জিডিপিতেই এর কোনো ভূমিকা নেই! বিশ্বজুড়ে এমন শত সহস্র অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আছে, যারা আমাদের আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিকে বিভিন্ন দিক থেকে সহায়তা করেন, অথচ তাদের মুনাফা শূন্য।
এই ইনফরমাল ইকোনমির বিভিন্ন প্রান্তে আছেন বিভিন্ন রকম মানুষ, যাদের শ্রম অহরহ অবমূল্যায়িত হয়। এই মানুষরা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কাজের কোনো বিনিময়ও দাবি করেন না, তবে সামাজিক অর্থনৈতিকভাবে অবমূল্যায়নের শিকার যাতে না হয়ে থাকেন তাই অনেকেই জিডিপির বিকল্প ভাবার কথা বলছে।
গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলো মুনাফাকেন্দ্রিক জিডিপির ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। কারণ ধনীদের হাতে আছে বিশাল পুঞ্জীভূত সম্পদ, এই বৈষম্য মাথাপিছু জিডিপির ধারণায় গোলমাল করে দিতে বাধ্য। আবার উন্নয়নের আড়ালে যদি তা ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে দেয় তাকেও টেকসই উন্নয়ন বলতে রাজি নন অর্থনীতিবদরা।
ভুটান দীর্ঘদিন ধরেই জিডিপির বদলে মানদণ্ড ধরেছে ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস (GNH)’কে। যেখানে জিএনএইচের চারটি মূল বিবেচ্য বিষয় আছে, টেকসই এবং সমতাভিত্তিক উন্নয়ন, পরিবেশের সুরক্ষা, সংস্কৃতির রক্ষা ও প্রচার এবং সুশাসন। অর্থনীতিবিদরা এই জিএনএইচের ধারণাকে শুরুতে খুব একটা গুরুত্বের নিয়েছেন বলে প্রমাণ নেই, হিমালয়ের পাদদেশে থাকা ভুটানের এই মডেলকে এখন গুরুত্বের সাথে দেখা শুরু করেছেন বিশ্বের অর্থনীতিবিদরা। অনেকেই জোর দিচ্ছেন জিডিপিকে সংশোধন করে মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য, প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্রয় সক্ষমতা, টেকসই উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্ত করে গ্রীন-জিডিপি মাপার জন্য।
ভিডিও: ভুটানের গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেসের ধারণা।
আমাদের রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জিডিপি লম্বা শিকড় গেড়ে বসেছে, মানুষের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যের হিসেব করতে গিয়ে রাজনীতিবিদরা এর মূলোৎপাটন সহসাই করছেন না। সমতাভিত্তিক উন্নয়নের প্রশ্ন আসলে, টেকসই উন্নয়নের কথা আসলে সমাজের ধনী শ্রেণির উপর চাপ বাড়বে। বিশেষ করে অনাগত প্রজন্মের উপর চাপ বাড়িয়ে যারা বন ধ্বংস করছে, বিলাস দ্রব্য উৎপাদনে বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে আরো গতিশীল করে দিচ্ছে কিংবা অস্ত্র কেনাবেচার মুনাফা যাদের পকেটে যাচ্ছে তাদের দিকে আঙ্গুল উঠবে! তাই পৃথিবীর সাধারণ মানুষকে এই প্রশ্ন তুলতে হবে জিডিপির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে।