পুরান ঢাকার মানুষের কাছে এক আতঙ্কের নাম হলো হাজী সেলিম ও তার পুত্র ইরফান সেলিম। বাপবেটা ওই এধলাকার ত্রাস হিসেবে খ্যাত। দীর্ঘ দিন ধরেই তারা ক্ষমতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টি করে বাসা-বাড়ি, মার্কেট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল করে আসছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করেনি।
আর শুধু পুরান ঢাকাই নয়, পুরো ঢাকা শহরেই হাজী সেলিম একজন সন্ত্রাসীদের গডফাদার হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরেই পুরান ঢাকার মানুষ জিম্মি অবস্থায় বসবাস করে আসছে। সেলিম বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করা ছাড়া মানুষের আর কোনো উপায় ছিল না।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে হাজী সেলিম সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকেই ব্যাপকভাবে দখল বাণিজ্য শুরু করে। তার আসনের আওতাধীন প্রতিটি ওয়ার্ডেই তিনি গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। সোয়ারিঘাট, চকবাজার এলাকার প্রতিটি মার্কেট থেকে মাসোহারা আদায়ে রয়েছে হাজী সেলিমের পৃথক একটি গ্রুপ। ট্রাকে ও লরিতে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রেও দৈনিক ভিত্তিতে টাকা গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের।
১৯৯৬ সালের পর লালবাগ ও চকবাজার এলাকার মধ্যে যেখানেই খালি জমি পেয়েছেন, সেখানেই হাত পড়েছে হাজী সেলিমের। এ নিয়ে মুখ খুলতেও সাহস পায়নি কেউ। পুরান ঢাকার অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার হাজী সেলিমের নির্যাতনে পিষ্ট, যারা তাদের সম্মান নষ্ট হওয়ার ভয়ে ওই এলাকাই ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
কেবল সাধারণ মানুষের জমি, ওয়াকফ সম্পত্তি আর বধিরদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গাই নয়, ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিব্বত হলও দখল করে নিয়েছেন হাজী সেলিম। সেখানে গড়ে তুলেছেন তার স্ত্রীর নামে একটি মার্কেট, গুলশান আরা সিটি।
গত দুইদিন আগে নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের পর গ্রেপ্তার হয় হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম। তার বাসায় অভিযানে গিয়ে মাদক-অস্ত্রসহ আরও অবৈধ জিনিসপত্র উদ্ধার করে র্যাব। এমনকি তার বাসায় টর্চার সেলও রয়েছে। যেখানে সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। এখন আস্তে আস্তে হাজী সেলিম ও তার ছেলের অপকর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি বেরিয়ে আসছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই হাজী সেলিম এক সময় শেখ হাসিনার দুই নয়নের মনি ছিল। বিরোধীদলকে দমনের জন্য হাজী সেলিম ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী ছিল শেখ হাসিনার রিজার্ভ ফোর্স। এক কথায় বললে-হাজী সেলিম ছিল শেখ হাসিনার পাহারাদার। তার আশ্রয়েই হাজী সেলিমরা দীর্ঘদিন ধরে অপরাধ কর্মকান্ড করে আসছে। সূত্র বলছে, হাজী সেলিম এর মত বাহিনী পরিচালনা করকো শেখ রেহানা। শুধু টর্চার সেল নয় বাংলাদেশে গুমের নেপথ্যেও রয়েছে সেলিম পরিবার।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতা হাজী সেলিম থেকে মাসে মাসে বখশিস নিতো। হাজী সেলিমের সব কিছু জেনেও তারা চুপ ছিলেন।
এদিকে সেলিমপুত্রের টর্চার সেলে হ্যান্ডকাপ পাওয়া যাওয়া জনমনে দেখা দিয়েছে নতুন প্রশ্ন। আইশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ভাষ্য সাধারণত কারও কাছে হ্যান্ডকাপ রাখার অনুমতি নেই। তাহলে কি ক্ষমতাসীনদের সহয়াতায় গুম বাহীনিকি এই সেলিম পরিবার দ্বারা পরিচালিত হতো?
দেখা গেছে, গত ১৪ বছরে ছয় শতাধিক মানুষ বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গিয়েছে। এদের বেশিরভাগেরই কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা যায় ২০০৯ সালে ৩ জন, ২০১০ সালে ১৮ জন, ২০১১ সালে ৩১ জন, ২০১২ সালে ২৬ জন, ২০১৩ সালে ৫৪ জন, ২০১৪ সালে ৮৮ জন, ২০১৫ সালে ৬৬ জন, ২০১৬ সালে ৯৭ জন, ২০১৭ সালে ৮৬ জন, ২০১৮ সালে, ৫৫ জন এবং ২০১৯ ও ২০২০ সালে প্রায় শতাধিক মানুষ গুম হয়েছে। এর মধ্যে র্যাব ১৫২ জনকে, পুলিশ, ৫১ জনকে, ডিবি পুলিশ ১৫৫ জনকে, র্যাব-ডিবি পুলিশ যৌথভাবে ১২ জনকে, অন্যান্য সংস্থা ৯৮ জনকে এবং বাকীদের বিষয়টা নির্দিষ্ট করা যায়নি।
এছাড়া অনেক গুমের কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শিকারও করিনি সেসব গুম এই সেলিম বাহিনীর দ্বারা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু সেলিম পরিবার নয় আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ে সব নেতাদের বাড়ি অভিযান চালালে শুধু টর্চার সেল নয় এরকম গুম বাহিনীরও সন্ধান পওয়া যাবে।