লিজিং কোম্পানির অর্থ লোপাটকারী প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) কানাডার টরেন্টোতে বিলাসী জীবনযাবন করছেন। সেখানে তিনি পাচার করা অর্থ দিয়ে বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। ওই দেশ থেকে তিনি মাঝেমধ্যে দুবাই ও ভারতে আসেন।
এখন তিনি দেশ দুটির কোনো একটিতে অবস্থান করছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।
আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুসহ সিন্ডিকেটের সহায়তায় কয়েকটি লিজিং কোম্পানি থেকে অন্তত ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা সরিয়ে পিকে হালদার দেশ থেকে সটকে পড়েন। এ অর্থের বড় একটি অংশ কানাডা, ভারত ও সিঙ্গাপুর পাচার করেন।
২৫ অক্টোবর তার দেশে আসার কথা ছিল। কিন্তু দেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতারের জন্য হাইকোর্ট থেকে আদেশ জারির খবর পেয়ে তিনি পিছুটান দেন। জ্বর-সর্দির কথা বলে তিনি আর আসেননি।
দুদক তার বিরুদ্ধে ক্যাসোনো-কাণ্ডে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদের যে মামলাটি দায়ের করেছে, ওই মামলার তদন্ত এখন শেষ পর্যায়ে। মামলায় তিনি একজন পলাতক আসামি। এ পর্যায়ে তাকে গ্রেফতারে ইন্টারপোলের সহযোগিতাও নিতে চায় দুদক। পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে এ বিষয়ে অনুরোধ জানাবে সংস্থাটি। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান রোববার বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, স্বাভাবিক নিয়মেই পিকে হালদার দেশে এলে গ্রেফতার বা আদালতে জামিনের জন্য আত্মসমর্পণ করার কথা ছিল। এরই মধ্যে তিনি স্বেচ্ছায় দেশে এসে বিনিয়োগ খাতের অর্থ ফেরত ও উদ্ধারের চেষ্টা করবেন বলে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই অবস্থান থেকে সরে যাওয়ায় দুদক চাচ্ছে তার বিরুদ্ধে চলমান অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষ করে আনতে। তাকে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহায়তা ছাড়াও দেশের বাইরে তার পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে তিনটি দেশে এমএলএআর পাঠানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, পিকে হালদারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। এটি চলমান থাকবে। এর অংশ হিসেবে যা যা করণীয়, কর্মকর্তারা সেসব কাজ করবেন। দেশের বাইরে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
পিকে হালদার গোপনে দেশত্যাগ করায় তাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তারা। তদন্তে এমনও তথ্য বেরিয়ে আসছে, একটি কম্পিউটার ব্যবহার করে কাগুজে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে তা দিয়ে তিনি রাতারাতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নেন। এখন পর্যন্ত অন্তত চার হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছেন তারা।
এদিকে আর্থিক খাতে দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে পিকে হালদার সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার চিঠি থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। পিপলস লিজিংয়ের তৎকালীন চেয়ারম্যান (২০১৫-১৬) উজ্জ্বল কুমার নন্দী বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর বরাবর লিখিত এক চিঠিতে উল্লেখ করেন, তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের পর কোম্পানির আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনা করে দায় ও সম্পদের মধ্যে ৯৪৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঘাটতি দেখতে পান। আগের আর্থিক বিবরণীতে দায় ও সম্পদের পরিমাণ কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল।
তাই এত বড় অঙ্কের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি চিঠিতে আরও উল্লেখ করেন। এতে তিনি বলেন, কোম্পানির সাবেক উদ্যোক্তা পরিচালকরা নিয়মবহির্ভূতভাবে ২৫৭ কোটি টাকা ঋণ ও শেয়ার পোর্টফোলিও থেকে ২৩৭ কোটি ঋণ নেন। এগুলো অব্যবস্থাপনা। যদিও দুদকের অনুসন্ধানে পিকে হালদারের সঙ্গে উজ্জ্বল কুমার নন্দীর বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান চলছে। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক টিম।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা সরানো হয়। এছাড়া এফএএস ফাইন্যান্স, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পিপলস লিজিং থেকে একই কায়দায় আরও প্রায় ৭৫০০ কোটি টাকা ঋণের নামে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে পিকে হালদার ও তার সিন্ডিকেট।
সব মিলিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় ২২০০ কোটি টাকা, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ২৫০০ কোটি টাকা, পিপলস লিজিং থেকে প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেখিয়ে আত্মসাৎ ও পাচার করা হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ নেই বললেই চলে। ফলে ঋণ পরিশোধ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর এর প্রধান কারিগর পিকে হালদার।
অনুসন্ধানে পিকে হালদারের সিন্ডিকেটের অন্তত ২৫ জনের নাম চিহ্নিত হয়েছে বলে জানা গেছে। যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করে বহাল তবিয়তে আছেন। পিকে হালদারের বন্ধু মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালক একেএম শহীদ রেজার স্বার্থসংশ্লিষ্ট পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে ১০৪ কোটি টাকা, তার মালিকানাধীন ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পদ্মা ওয়েভিং লি., পদ্মা ব্লিচিং লি., ফ্যাশান প্লাস লিমিটেডের নামে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে পরিচালিত হিসাবে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের ৭টি ঋণ হিসাব থেকে ৩৩টি চেকের মাধ্যমে ওয়ান ব্যাংক লিমিটেডের স্টেশন রোড শাখার গ্রাহক ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরফান আহমেদ খানের জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে পরিচালিত একটি হিসাব থেকে ৭৪ কোটি টাকা সরিয়ে নেয়া হয়।
অপরদিকে পিকের আত্মীয় পূর্ণিমা রানী হালদার, স্বপন কুমার মিস্ত্রি ও সঞ্জীব কুমার হালদার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ৬০ কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাৎ করেন। ৯টি চেকের মাধ্যমে অলোক কুমার দাস, অনিতা দাসের মালিকানাধীন প্যারামাউন্ট অ্যাগ্রো লিমিটেড এবং তাদের পুত্র রঙ্গন দাসের হিসাবে ২০১৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ১৪ কোটি টাকা সরিয়ে মেঘনা ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় ৮টি এফডিআর খোলা হয়।
পিকে হালদারের ব্যক্তিগত হিসাবেই ১৫৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা ও সমপরিমাণ উত্তোলনের তথ্য পায় দুদক, যা একজন ব্যাংকারের পক্ষে স্বাভাবিক লেনদেন নয়। তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১৪টি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দুটি স্থানের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ৫৬, পুরানা পল্টন লেন, ঢাকা। কিন্তু এই ঠিকানায় রয়েছে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান। এই নামে দুর্নীতি, জালিয়াতি ও নানা ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ হিসাবের অনুকূলে ঋণের নামে লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ক্যাপিটাল মার্কেটে অর্থ সরিয়ে তা আত্মসাৎ করা হয়।
তার আত্মীয়দের নামে বিভিন্ন সময় ঋণের নামে কোটি কোটি টাকা বের করে দেন তিনি। এর মধ্যে কোলাসিন লিমিটেডের চেয়ারম্যান অতশী মৃধা, উত্তম কুমার মিস্ত্রি ও স্বপন কুমার মিস্ত্রির ক্যাপিটাল হিসাবে ৭৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজের (ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার ও তাদের মনোনীত ২ জন পরিচালক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদ সদস্য) নামে ২৫ লাখ ৯৭ কোটি টাকা রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। এভাবে ধাপে ধাপে তার সিন্ডিকেটের ২৫ জনের নামে-বেনামে নানা কায়দাকানুন করে লিজিং কোম্পানি থেকে ওই অর্থ সরানো হয়।
এদিকে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জানান, পিকে হালদার হল এদের সবার নাটের গুরু। তাকে যে কোনোভাবেই হোক দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতার করে আনতে আমরা আদালতে আবেদন করব। পিকে হালদার মৌখিকভাবে জানিয়েছেন তিনি অসুস্থ। শুধু মুখের কথায় এসব চলে না। তিনি অসুস্থতার কোনো কাগজপত্র দেখাননি।
এছাড়া পিকে হালদার বলেছেন, তিনি আদালতের আদেশ পাননি। এটা তিনি বলতে পারেন না। তিনি পলাতক, আদালত অবমাননা করেছেন। আমি বিষয়টি আদালতের নজরে আনব। আইজিপির কাছে অনুরোধ করব, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে গ্রেফতার করে আনা হোক। দুদকও তাদের টিম প্রস্তুত রেখেছে। পিকে হালদার দেশে ঢুকলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে, বলেন তিনি।
এদিকে দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগে পিকে হালদারসহ এ পর্যন্ত ৮৩ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বিএফআইইউ ও দুদক।
পিকে হালদার ২০০৮ সাল পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে উপব্যবস্থাপনা (ডিএমডি) পরিচালক ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন। দেশ থেকে টাকা জালিয়াতির পর ২০১৮ সালে দুই ভাই মিলে ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে কোম্পানি খোলেন। কলকাতার মহাজাতি সদনে তাদের কার্যালয়।
আর কানাডায় পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামে কোম্পানি খোলা হয় ২০১৪ সালে। যার পরিচালক পিকে হালদার, প্রিতিশ কুমার হালদার ও তার স্ত্রী সুস্মিতা সাহা।