রফিক–উল হকের মৃত্যু কিছু শূন্যতা তৈরি করেছে। সেটা কি বিচারাঙ্গনে? রাজনীতিতে কি করেননি? তিনি কি বিচারাঙ্গন থেকে রাজনীতির অঙ্গনের অভিভাবক হয়ে ওঠেননি? তিনি কি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বেলাভূমিতে কিছুক্ষণের জন্য আসেননি? তিনি দুই নেত্রীর আইনজীবী ছিলেন। এটুকুই তার পরিচয়?
বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে যারা ভাবেন, তারা মনে করেন, একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কিছু নিরপেক্ষ মানুষ থাকতে হয়। যাদেরকে দল নিরপেক্ষ ভাবা যায়। রফিক–উল হক কত মামলা লড়েছেন। কত মামলায় হেরেছেন। কত বড় তিনি মানবদরদি ছিলেন, সেই হিসাবটা পরিষ্কার। সবাই এটা লিখেছেন।
বলেছেন। বহুদিন পরে বাংলাদেশে জনপ্রিয় একজন মারা গেলেন। যিনি জীবন সায়াহ্নে ক্ষমতাসীন দলের সমালোচক ছিলেন। সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপের নিন্দা করেছেন। অথচ তার মৃত্যুতে সেই কারণে কোনো মহলই মুখ ভার করে থাকেনি। শোকবাণীতে সবাই তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
কিন্তু অনেক পর্যবেক্ষক বলেছেন, রফিক –উল হকের মৃত্যুতে কোনো দলই এটা বলেনি যে, এই সমাজ বা রাষ্ট্র একজন অভিভাবক হারালো। বিশ্লেষকরা বলেছেন, এই উপাদানটা বাংলাদেশ সমাজে অনুপস্থিত। তারা মনে করে, অরাজনীতিক কেউ রাজনীতিকদের মুরুব্বী হতে পারেন না। কারণ তাদের সেটা দরকার নেই। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ এবং প্রফেসর বদরুদ্দোজা চৌধুরী দুজনেই বেঁচে আছেন। কিন্তু সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন কারণে হলেও কারো কাছে তাদের কদর নেই। কারণ শেষ বিচারে তারা দুজনেই সিভিল সোসাইটির সদস্য। আর সুশীল সমাজ মানেই একটা দলনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে তারা কোনো না কোনো পর্যায়ে সচেষ্ট হন। আর এটাই কোনো দল দেখতে পারে না। উভয় দলই প্রশ্নাতীত আনুগত্য দেখতে চান। সেকারণে তারা সিভিল সোসাইটির লিডারদের চূড়ান্ত বিচারে বিশ্বাস করেন না। আস্থা রাখতে পারেন না।
ব্যারিস্টার রফিক–উল হকের রাজকপাল। বাংলাদেশের মিডিয়াকে তিনি একটা শ্বাস ফেলার অবকাশ দিয়েছেন। করোনায় বহু প্রবীণ মারা গেছেন। তারা বিভিন্ন পেশার ছিলেন। তিনি করোনার মধ্যে পরোলোকগতদের মধ্য বিরাট ব্যতিক্রম। লাশ কোথায় কিভাবে দাফন করা হবে, তা নিয়ে বিতর্ক হয়নি।
কিন্তু কেন এই ব্যতিক্রম। একজন মানুষ জনপ্রিয়, সব পত্রিকা দল নির্বিশেষে বাতিঘর বলছে, অথচ তাকে নিয়ে বিতর্ক নেই। এটা কেমন কথা। এটা তো বাংলাদেশের অধুনা চেনা কালচার নয়। অচেনা কালচার।
তার মৃত্যু চিন্তা–ভাবনার একটা স্থায়ী ক্ষেত্র তৈরি করে রেখে গেছে।
২০০৭ সালের ১/১১–র পর ফখরুদ্দিন আহমেদ ও সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনা সহ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধেই মামলা করে তৎকালীন সরকার। সেসময় রফিক-উল হক শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়ের স্বপক্ষের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেছেন, কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় না থাকার কারণেই দুই দলের নেত্রীর পক্ষে আইনজীবী হতে পেরেছিলেন তিনি। আর সেসময় রাজনৈতিক পরিচয় থাকা অনেক আইনজীবীই বিভিন্ন কারণে ঐ দুইজনকে আইনি সহায়তা দেয়া থেকে বিরত ছিলেন।”
প্রশ্ন হলো, এই যে, তার এতবড় ভূমিকা, সেজন্য রাষ্ট্র তাকে কি দিয়েছে? এটাই কোটি টাকা দামের প্রশ্ন। গত এক দশকে রাষ্ট্র কত মানুষকে কতকিছু দিয়েছে। এটা প্রতিষ্ঠিত যে, তিনি তাঁর উপার্জনের অর্থে দানবীর হতে পেরেছিলেন। তিনি মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। শাহদীন মালিক দাবি করেছেন, তিনি মানুষকে নগদ ১ কোটি টাকার বেশি দান করেছেন। কেউ মনে করেন, তিনি অনধিক ১শ কোটি টাকা দান করেছেন। সুতরাং দল নিরপেক্ষ আইনজীবীর পরিচয় ছাড়াও তার বড় পরিচয় তিনি সমাজসেবী। হাজি মোহাম্মদ মোহসীন মানুষের হৃদয়ে আজও শ্রদ্ধার আসনে। রফিক–উল হকও তাই থাকবেন।
কিন্তু প্রশ্ন একটাই, কী এমন কারণ ছিল যে, এই রাষ্ট্র তাকে সমাজসেবা বা আইনজ্ঞ হিসেবে সম্মান দিতে পারল না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক ইত্যাদি তুলে দেয়া হয়েছে এমন অনেকের হাতে, যাদের হাতের চেয়ে রফিক–উল হকের হাত অনেক বেশি উপযুক্ত ছিল। কিন্তু তার কাছে ঋণী থাকা এক বিষয়। স্বীকার করাও এক বিষয়। কিন্তু তাই বলে বিনিময়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু দেয়াটা সহজ নয়।
এখানেও একটা রাজনীতি আছে। রফিক–উল হককে শ্রদ্ধা জানানো যায়। কিন্তু রাষ্ট্র তাকে বরণ করতে পারে না। অনেকের মতে, এখানে হয়তো শর্তহীন আনুগত্য দরকার, যেখানে তিনি পিছিয়ে ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু সরকারের রাষ্ট্রীয়করণ আইন তার হাতে তৈরি। বঙ্গববন্ধুকে তিনি কলকতার বেকার হোস্টেল থেকেই জানতেন। তারা সেখানে পাশাপাশি রুমে থেকেছেন।
জিয়াউর রহমানের আমলে করা বিরাষ্ট্রীয়করণ তার হাতে। জেনারেল এরশাদের তো তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের একমাত্র এক টাকার অ্যাটর্নি জেনারেল। চরম বৈরী পরিবেশে দুই নেত্রীর আইনজীবী। এর কোনো কিছুই তাকে একটি রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার পেতে দেয়নি। অথচ কোনো সন্দেহ নেই, সমাজসবোয় তার একটি পুরষ্কার প্রাপ্য ছিল। অনেকের মতে, এটা মরণোত্তরকালে তিনি পেতে পারেন। এর তিনি হকদার। পাবেন কিনা, সেটা কেবল ভবিষ্যৎ বলতে পারে। ছাত্রজীবনে ক্রিমিনাল ল’তে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন।
সব সময়ই তিনি দুই নেত্রীর মধ্যে বৈরি সম্পর্কের অবসান দেখতে চেয়েছেন। সেটা ঘটেনি। তবে একটা ভবিষ্যতদ্বাণী করে গেছেন। সেটাই দেখার বিষয়: দুই বদলের নেতৃত্ব দুই পরিবার থেকেই আসবে। শেখ হাসিনার পরে সজিব ওয়াজেদ জয়। বেগম খালেদা জিয়ার পরে ডা. জোবায়দা রহমান।