শান্তা মারিয়া
সমাজের একজন বা দুজন যখন দুর্নীতি করে, যখন একটি অফিসে একজন ঘুষখোর থাকে তখন তাদের শাস্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব কিন্তু যখন ঠগ বাছতে উজাড় হয়ে যায় গাঁ তখন সমস্যা পৌঁছে যায় দুর্যোগের স্তরে। আমরা বোধহয় এখন সেই স্তরে পৌঁছে গেছি।
করোনা মহামারির চেয়েও আমাদের আতংকিত হওয়া উচিত দুর্নীতির চলমান মহামারিতে। একদম তৃণমূল স্তর থেকে সমাজের উচ্চস্তর পর্যন্ত দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে ক্যান্সারের ভয়াবহতায়। যখন একজন গাড়িচালকের কোটি কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ মেলে, বাগানের মালী ইউ এনওর বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে তাকে মারাত্মকভাবে আহত করে, আবার সেই ইউএনওর বাড়িতে পাওয়া যায় তার আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বিপুল পরিমাণ সম্পদ তখন বুঝতে বাকি থাকে না দুর্নীতির বিস্তার কতখানি।
‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুধু সরকারি পর্যায়ে চললে হবে না। শুধু দুদক এটা করলে হবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করতে হবে ঘর থেকে। আপনার আমার থেকে। আপনি নিজের মনকে প্রশ্ন করে দেখুন তো আপনি দুর্নীতিবাজ কি না। আপনার ঘরে অবৈধ টাকা আসে কিনা। দুর্নীতিবাজ কোন আত্মীয় বন্ধুকে আপনি চেনেন কিনা। তাকে ঘৃণা করেন কিনা। তার অবৈধ রোজগারের অর্থে দামি হোটেলে খেতে আপনার আপত্তি আছে কি না।’
স্কুলের অস্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে টকশোতে আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত পাওয়া সাহেদের দুর্নীতির খবর মিডিয়ার কল্যাণে আমরা পেয়েছি। ভাবতে অবাক লাগে এই নগরীতে গাড়ি চালকদের সাহেদ কমিশন ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে রেখেছে মানুষকে গাড়িচাপা দিয়ে পঙ্গু করে ফেলার জন্য। যাতে তার হাসপাতালের ব্যবসা রমরমা হয়। কি ভয়ংকর প্রবণতা! সাধারণ মানুষের দুর্ঘটনাও ঘটাচ্ছে দুর্নীতিবাজ পিশাচরা। ডা. সাবরিনার মতো দুর্নীতিবাজ চিকিৎসকের খবরও মিলেছে। বাংলাদেশে এখন এমন কোনো পেশা নেই যা দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত। চিকিৎসা, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতার মতো মহান পেশা বলে পরিচিত ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্নীতি। যে কোন এক দুর্নীতিবাজ ধরা পড়লেই দেখা যায় তার সঙ্গে সমাজের সব বিশিষ্টজনদের ছবি, পাওয়া যায় অবৈধ শতকোটি টাকার খবর। পুলিশ, প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প, সংস্কৃতি কোন কিছুই আজ আর দুর্নীতিমুক্ত নয় বরং আকীর্ণ। যে কোন ক্ষেত্রে আগে দুর্নীতিবাজ থাকতো একজন দুজন আর এখন সাধুজন খুঁজে বের করতেই চিরুনি অভিযান চালাতে হয়।
কিন্তু কেন এই অবস্থা? সমাজ তো রাতারাতি এই অবস্থায় পৌঁছায়নি। অনেক বছর ধরে ধীরে ধীরে দুর্নীতির বিষ ছড়িয়ে গেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সমাজের শুভ মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। ব্রিটিশ আমলেও যে ঘুষ ছিল না এমন নয়। কিন্তু তখন সেটা ছিল নিন্দনীয়। সমাজের মূল্যবোধ এমন ছিল যে, ঘুষখোরের সঙ্গে কেউ আত্মীয়তা করতে চাইতো না। দুর্নীতিবাজের ঘরে কেউ ছেলে মেয়ে বিয়ে দিত না। এখন উল্টো। পাত্রের সকল যোগ্যতার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় তার উপরি রোজগারের ক্ষমতা।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ছে দুর্নীতি। বাবা-মা যখন অবৈধ রোজগারের ধান্ধায় মত্ত থাকে তখন সন্তান তো বিপথে যাবেই। তরুণ প্রজন্মকেও নানা ভাবে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে দুর্নীতিবাজ অভিভাবকরা। এই দায় আমাদের সকলের। এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করি। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের ঘটনা। আমি তখন একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। সেখানে একবার কেজি ক্লাসের এক শিশুর কাছে পাঁচশ টাকার নোট দেখে অবাক হলাম। ভাবলাম বাচ্চাটি হয়তো বাবা-মাকে না জানিয়ে টাকা নিয়ে এসেছে। ওর অভিভাবকদের ডেকে পাঠালাম। ব্যস্ততার কারণে বাবা আসতে পারলেন না, এলেন মা। ঘটনা শুনে তিনি বললেন, ‘আমরা ধনী মানুষ। আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে পাঁচশ’-এক হাজার টাকা তো থাকবেই।’ যতই তাকে বুঝাই যে এইটুকু শিশুর হাতে এত টাকা দেওয়া ঠিক নয়, তিনি সেটা বুঝতে চান না। উল্টো আমার উপর ক্ষিপ্ত হন। শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘আমাদের ঘরের বাচ্চাদের হাতে হাজার হাজার টাকা থাকবেই। আপনারা দেখবেন সেটা যেন কেউ চুরি না করে।’ বললাম, ‘আমি শিক্ষক, আপনার বাচ্চার দারোয়ান নই।’ পঁচিশ বছর পার হয়েছে। যদি কোনো দিন শুনতে পাই সে দিনের সেই ছোট্ট শিশুটি বড় হয়ে দুর্নীতিবাজ হয়েছে আমি তো তার বাবা-মাকেই দোষী সাব্যস্ত করবো তাকে অসংযমী করে গড়ে তোলার জন্য।
আমাদের তরুণ প্রজন্মের সামনে কি আদর্শ আমরা রাখতে পারছি? আমাদের সমাজের কিশোর তরুণরা তাদের চারপাশে দেখছে প্রশ্নফাঁসকারী, ধর্ষক শিক্ষক, ভণ্ড ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও ঘুষখোর পুলিশ, সুবিধাবাদী ও ধামাধরা বুদ্ধিজীবী, ফাঁকিবাজ ঘুষখোর আমলা, চিকিৎসক। তাহলে কার উপর তারা শ্রদ্ধা রাখবে, কার আদর্শে পথ চলবে? শুধু যে অসাধু ধনীর সন্তানরা বিপথে যাচ্ছে তা নয়, লোভী ও নীতিহীন দরিদ্রের সন্তানও একইভাবে বিপথু হচ্ছে। মূল্যবোধহীনতায় আক্রান্ত হয়েছে গোটা সমাজ। সন্তানদের আমরা না দিচ্ছি সুস্থ বিনোদনের খোঁজ, না দিচ্ছি সংযমের শিক্ষা। উপরন্তু তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি অবৈধ রোজগারের টাকা। তাহলে তারা বিপথে যাবে না তো কি করবে?
মনে পড়ছে স্কুল জীবনে দু’টাকার আইসক্রিম কিনে বান্ধবীর সঙ্গে ভাগ করে খেতাম। আমার বাবা ভালো বেতনে চাকরি করতেন, বান্ধবীর বাবা ছিলেন স্বচ্ছল ব্যবসায়ী। তাদের সামর্থ্য ছিল আমাদের হাতে কিছুটা টাকা পয়সা দেওয়ার। কিন্তু তারপরও সংযমের মধ্যে আমাদের বড় করেছেন এই আশায় যেন আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ হাতে পেয়ে তা বাজে খরচ না করি। তারা আমাদের হাতে বই তুলে দিতেন। কোনো কিছু চাইবার আগে আমাদের দশবার ভাবতে হতো সেটা আমরা পাব কি না কিংবা আমরা সেটা পাওয়ার যোগ্য কি না।
কিছু দিন আগে আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক তার স্কুলপড়ুয়া মেয়ে ও তার বন্ধুদের জন্য এক তিন তারকা হোটেলে পার্টির বন্দোবস্ত করতে মোটা অংকের টাকায় বুকিং দিলেন। বললেন, মেয়ে তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে সন্ধ্যায় খাবে। ভদ্রলোক পেশাজীবী এবং মাঝারি বেতনে চাকরি করেন। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হয়, এত টাকা তিনি পান কই। ভবিষ্যতে এই মেয়েটি যদি বখে যায় তাহলে আমি তার বাবাকেই দায়ী করবো। আমরা সন্তানদের ‘প্লেইন লিভিং হাই থিংকিং’য়ের শিক্ষা না দিয়ে ভোগবাদী বানাচ্ছি, নিজেরাও অসৎ নেশায় মত্ত হয়ে পড়ছি। ভাবছি এটাই আধুনিকতা।
দুর্নীতির জন্য দায়ী হল মাত্রাতিরিক্ত লোভ, নীতিহীনতা ও ভুল শিক্ষা। আমাদের লোভ বড্ড বেড়েছে। প্রত্যেকেরই দামী গাড়ি, বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট আর যত রাজ্যের বিলাস সামগ্রী চাই। সেটা যেভাবেই আসুক না কেন। যখন কোন ব্যক্তি অবৈধ টাকা বাড়িতে আনে তখন তার পরিবারের সকলে খুশি হয়ে ওঠে। ভাবে, ‘ছেলেটা/মেয়েটা এতদিনে চালাক হয়েছে’। তারা তো প্রশ্ন করে না, এত টাকা তুমি কোথায় পেলে? যখন সামান্য চাকরিজীবী স্ত্রী তার স্বামীকে গাড়ি উপহার দেয়, যখন সামান্য বেতনে চাকরি করা স্বামী তার স্ত্রীকে কোটি টাকার হীরার অলংকার কিনে দেয়, যখন অবৈধ রোজগারের টাকায় তারা দেশবিদেশে প্রমোদ ভ্রমণে যায় তখন তো তার স্বামী, স্ত্রী, পরিবারের সব সদস্য খুশি হয়ে ওঠে, কেউ একবারও প্রশ্ন করে না এত টাকা এলো কোন পথে? এই প্রশ্ন না করাটাই হলো দুর্নীতিকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়ার সবচেয়ে বড় ভিত্তি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুধু সরকারি পর্যায়ে চললে হবে না। শুধু দুদক এটা করলে হবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করতে হবে ঘর থেকে। আপনার আমার থেকে। আপনি নিজের মনকে প্রশ্ন করে দেখুন তো আপনি দুর্নীতিবাজ কি না। আপনার ঘরে অবৈধ টাকা আসে কিনা। দুর্নীতিবাজ কোন আত্মীয় বন্ধুকে আপনি চেনেন কিনা। তাকে ঘৃণা করেন কিনা। তার অবৈধ রোজগারের অর্থে দামি হোটেলে খেতে আপনার আপত্তি আছে কি না। যদি তার অবৈধ অর্থকে আপনি সাদরে উপভোগ করেন তাহলে একজন সাহেদ বা মালেক গড়ে ওঠার দায়ভার আপনিও এড়াতে পারেন না। প্রতিবাদ করার সাহস না থাকে, অন্তত ঘৃণা করা শুরু করুন। তাকে এড়িয়ে চলুন। সেটাই হবে দুর্নীতি দূর করার প্রথম ধাপ। আর রাষ্ট্রকেও দুর্নীতি প্রতিরোধে কঠোর আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। রুইকাতলাকে ছেড়ে দিয়ে চুনোপুঁটি ধরলে হবে না। রাষ্ট্র ও সমাজ যখন একসঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধে আন্তরিক হবে, যখন ব্যক্তি স্তর থেকে রাষ্ট্রীয় স্তর পর্যন্ত দুর্নীতি হবে ঘৃণিত, বর্জনীয়, যখন আমরা অবৈধ উপার্জনে বিদেশি কুইজিনের পরিবর্তে বৈধ আয়ে সামান্য শাকভাতকে অমৃতজ্ঞানে খেতে শিখব তখনি দুর্নীতি দূর হওয়া শুরু হবে। তার আগে নয়।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।