পর্নোগ্রাফি নির্মাণের আন্তর্জাতিক চক্রে জড়িত বাংলাদেশের প্রায় চার হাজার সদস্যের পরিচয় খুঁজছে পুলিশ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দুই কিশোরীর অভিযোগ তদন্তে নেমে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ তিন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার বিভিন্ন আলামত পরীক্ষা ও জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি চক্রের ৪৫টি গ্রুপের সন্ধান পায় পুলিশ। এসব গ্রুপের প্রতিটির সদস্য ৮৫০-৯০০ জন। গ্রুপগুলোর রেজিস্টার্ড মেম্বার হিসেবে প্রায় চার হাজার বাংলাদেশির তথ্য নিয়ে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছেন বিভাগটির কর্মকর্তারা।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথমে মার্কিন তরুণীর অভিযোগ নিয়ে তদন্তে নেমে বেসরকারি ইউনিভার্সিটির তিন শিক্ষার্থী বোরহান উদ্দিন, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও অভিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাদের থেকে উদ্ধার বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস ডিভাইসে থাকা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তারা আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি চক্রের সদস্য। শুধু তা-ই নয়, এই তিনজনের মতো আরও প্রায় চার হাজার বাংলাদেশির আইডির সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা প্রত্যেকেই চক্রের সদস্য। এসব আইডির ব্যবহারকারী কারা, সে বিষয়ে তদন্ত চলছে।
সিটিটিসির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আ ফ ম আল কিবরিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মার্কিন কিশোরীর অভিযোগ তদন্তে নেমে আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি চক্রের কয়েক হাজার আইডির তথ্য পেয়েছি। সেগুলোর ব্যবহারকারীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার কাজ চলছে।’
তদন্তকারী আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘পর্নোগ্রাফি চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করার জন্য আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে উদ্ধার হওয়া ডিজিটাল ডিভাইস পরীক্ষার প্রক্রিয়া শুরুর পাশাপাশি ৪২ থেকে ৪৫টি গ্রুপের ওপর নজরদারি শুরু হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, এসব গ্রুপের প্রতিটির রেজিস্টার্ড সদস্যসংখ্যা ৮৫০ থেকে ৯০০; যাদের মধ্যে ১০ শতাংশ বাংলাদেশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে দুঃখজনক তথ্য হলো এসব গ্রুপের সদস্য হিসেবে বেশ কয়েকজন তরুণীর সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা স্বেচ্ছায় এই চক্রে জড়িয়ে পড়েছেন। চক্রের অনেকেই নিজের লৈঙ্গিক পরিচয় গোপন করে কখনো সমকামী আবার কখনো বিপরীত লিঙ্গের লোককে টার্গেট করে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তারপর একে অপরের নগ্ন ছবি শেয়ার করেন। এরপরই তা পর্নোচক্রের হাতে চলে যায়।’
সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের ডিজিটাল ফরেনসিক বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘এই চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুই মার্কিন তরুণী ছাড়াও আরও আট বাংলাদেশি তরুণীর অভিযোগ এসেছে আমাদের কাছে। সবগুলো অভিযোগই গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ১১ বছর বয়সী এক কিশোরীর সঙ্গে পাঁচ বছর আগে ইনস্টাগ্রামে পরিচয় হয়েছিল বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বোরহানের। পরে বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে কৌশলে বোরহান ওই কিশোরীর নগ্ন ছবি নেয়। এরপরই সে বুঝতে পারে, পর্নোগ্রাফি চক্রের পাল্লায় পড়েছে। বাবা-মাসহ স্বজনদের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করে। এরপর সে ফেইসবুকের মাধ্যমে বিষয়টি সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগকে জানায়। সেই অভিযোগের তদন্তে নেমে ১৫ অক্টোবর বোরহান ও তার দুই সহযোগী মাহমুদ ও অভিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
কর্মকর্তারা আরও জানান, বোরহানের ব্যবহৃত কম্পিউটারে অসংখ্য দেশি-বিদেশি কিশোরীর নগ্ন ছবি পাওয়া যায়। যার মধ্যে প্রায় চার হাজার ফাইল ছিল। তার কম্পিউটারে বিভিন্ন চাইল্ড পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইট লগইন অবস্থায় পাওয়া যায়। ডার্ক ওয়েব নিয়ন্ত্রণকারী আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পাওয়া গেছে। এখন তাদের সঙ্গে কোনো আর্থিক লেনদেন হয়েছে কি না, তাও খোঁজা হচ্ছে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, নজরদারিতে থাকা অনেক সদস্য ইনস্টাগ্রামভিত্তিক বিভিন্ন চাইল্ড পর্নোগ্রাফি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। ইনস্টাগ্রামে চাইল্ড পর্নো গ্রুপগুলো ‘শাটআউট’ নামে পরিচিত। এসব গ্রুপ থেকেই শিশু-কিশোরীদের মোটিভেটেড করে নগ্ন ছবি সংগ্রহ করে থাকে তারা। তারা মূলত ইনস্টাগ্রামে ফেক আইডি বানিয়ে নিজেকে লেসবিয়ান বা সমকামী নারী হিসেবে উপস্থাপন করে। পরে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে নগ্ন ভিডিও এবং ছবি সংগ্রহ করে তা পর্নো সাইটে আপলোড করে থাকে।