বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সংকটাপন্ন রোগীদের কথা চিন্তা করে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারে টারবাইন বেইজড ওপেন সোর্স ভেন্টিলেটর তৈরি করেছেন সিলেটের চার তরুণ। এই চার তরুণের দু’জন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) এবং অপর দুজন সিলেট মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের (এমইউ) সাবেক শিক্ষার্থী। তাদের একটি টিম রয়েছে, যেটার নাম ‘ক্রাক্স’।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও ক্রাক্সের দলনেতা সৈয়দ রেজওয়ানুল হক নাবিলের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নতুন উদ্ভাবন নিয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন তিনি।
নাবিল বলেন, সরকারি সহায়তা পেলে অল্প সময়ের মধ্যে এগুলো বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও বিপণন করা সম্ভব। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সংকটাপন্ন রোগীদের কথা মাথায় রেখে বিগত প্রায় চার মাসে তারা এই ভেন্টিলেটর তৈরি করেছেন। তাদের তৈরি ভেন্টিলেটর সহজে বহনযোগ্য এবং এটা চালাতে কম বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। এ কারণে এটি অ্যাম্বুলেন্সেও ব্যবহার করা যাবে।
ভেন্টিলেটরটির শব্দ কম হওয়ায় রোগীদের কোনো অসুবিধা হবে না। এটিতে একটি অ্যাপস ব্যবহার করা হয়েছে। এই অ্যাপসের মাধ্যমে ভেন্টিলেটরকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং ভেন্টিলেটরের বিভিন্ন প্যারামিটার দেখা যায়।
নিজেদের উদ্ভাবন সম্পর্কে নাবিল আরও বলেন, আমরা যে মেডিকেল ভেন্টিলেটরটি তৈরি করেছি সেটি টারবাইন বেইজড। এর ভেতর একটি টারবাইন রয়েছে যা পজিটিভ প্রেসার তৈরি করে। এই ভেন্টিলেটরের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি। আমরা যতটুকু করেছি তা ওপেন সোর্স করে দিয়েছি। ফলে যে কেউ এর প্রযুক্তি দেখতে পারবে এবং এটি নিয়ে কাজ করতে পারবে।
তিনি বলেন, এই ভেন্টিলেটরটি PRVC, SIMV, PCV মুডগুলো সাপোর্ট করে। ডিভাইসটির GUI সফটওয়্যারটি তৈরি করা হয়েছে অ্যানড্রয়েড প্লাটফর্মে যেটি দিয়ে এর বিভিন্ন প্যারমিটার ইনপুট দেয় এবং দেখা যায়। এর স্ক্রিনটি ৮ ইঞ্চির। যার ফলে এতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডাটা যেমন প্রেসার, এয়ার ফ্লো, ভলিউম , BPM, Ti ইত্যাদি গ্রাফিকালি এবং নিউমেরিক্যালি দেখা যায়।
এর শব্দও সাধারণ যেকোনো ভেন্টিলেটর থেকে কম এবং পাওয়ার ইফিশিয়েন্ট। কারেন্ট চলে গেলেও এর ভেতরের ব্যাটারি ৫ ঘণ্টার উপর একে চালাতে পারবে। যার ফলে এই ভেন্টিলেটরটি পোর্টেবল ভেন্টিলেটর হিসেবে অ্যাম্বুলেন্সে ব্যাবহার করা যাবে। এর স্ক্রিন ফোল্ড করা যায়, ফলে পরিবহন করা সহজ।
এ উদ্ভাবন কতটুকু কার্যকর এবং এটি কিভাবে প্রমাণিত? এমন প্রশ্নের জবাবে নাবিল বলেন, আমরা যেসকল প্যারমিটার বর্তমানে দেখতে পেয়েছি Test Lung ব্যাবহার করে তাতে মনে হচ্ছে এটি বেশ কার্যকর। তবে এটি কোথাও বাস্তবে রোগীর উপর টেস্ট করা হয়নি। আসলে এর সবকিছু আমরা উন্মুক্ত করে দিয়েছি, যার ফলে যেকেউ এটি দেখতে পারবে।
তিনি বলেন, ভেন্টিলেটরটিকে প্রোডাক্ট হিসেবে তৈরি করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না, এটা আমাদের রিসার্চ প্রজেক্ট।
উদ্ভাবনের চিন্তাটা কিভাবে আসল? এমন প্রশ্নের জবাবে ক্রাক্স দলের এই প্রধান বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর আমরা লক্ষ্য করলাম দেশব্যাপী ভেন্টিলেটর প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু ভেন্টিলেটর অত্যন্ত জটিল প্রযুক্তি। তাছাড়া এ বিষয়ে সরাসরি আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।
এছাড়া অনেক টাকা পয়সা প্রয়োজন এগুলো বানাতে। তখন আমরা চিন্তা করলাম আমরা একটা রিসার্চ প্রজেক্ট করি যার উদ্দেশ্য একটি ওপেন সোর্স ভেন্টিলেটর বানানো। যা দেখে দেশ এবং বিদেশের ইঞ্জিনিয়াররা এটিকে আরো ভালো করতে পারবেন।
তারপর আমরা কাজে লেগে পড়ি। যদিও প্রফেশনাল কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে যথেষ্ট সময় দিতে পারিনি। এই সীমিত সময় এবং বাজেটে যতটুকু করতে পেরেছি তা আমরা করেছি। ১০০ ভাগ পূর্ণ না হলেও একটা বেসিক পর্যন্ত আমরা ঠিকই করতে পেরেছি। যা কোনো স্টার্টআপ কোম্পানি আগে বাংলাদেশে করেনি।
এরকম একটা প্রজেক্ট করার জন্য যেখানে আমেরিকার একটা টিম ৫০ লাখের উপর টাকা পায় আমরা মাত্র ১ লাখেরও কম টাকায় কাজটা করেছি। তাছাড়া বাংলাদেশি স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোর মধ্যে এটাই প্রথম যা টারবাইন বেইজড এবং ওপেন সোর্স।
একই রকম উদ্ভাবন অনেকগুলো থাকতে আপনারটা সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান কেন গ্রহণ করবে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কে গ্রহণ করবে আর কে করবে না এটি মাথায় রেখে এ প্রজেক্ট বানানো হয়নি। এটি গবেষণা এবং শিক্ষামূলক প্রজেক্ট। আমাদের কাজ ব্যাবহার করে বা দেখে মানুষ শিখুক সেটাই আসল কাজ। এর ছোট ছোট অংশ ব্যবহার করে আরো বিভিন্ন মেডিকেল ডিভাইস বানানো সম্ভব।
তবে যেহেতু এটি ওপেন সোর্স এবং নিজেদের প্রযুক্তি তাই সরকার বা অন্য প্রতিষ্ঠান এটি ব্যবহার করলে নিজেদের কাছে সম্পূর্ণ কন্ট্রোল থাকবে। যার ফলে নিজেদের মতো করে ডিভাইস বানানো সম্ভব হবে। যা বিদেশ থেকে কিনে আনলে সম্ভব না।
নাবিল বলেন, সরকার এটাকে দেশব্যাপী ব্যাবহার করতে চাইলে প্রথমে এটিকে আরও উন্নত করতে হবে। সেজন্য ভালো একটা বাজেট প্রয়োজন। তারপর টেস্ট করে দেশব্যাপী হাসপাতালগুলোতে ব্যবহার করতে পারবে। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা বাঁচবে।
ভেন্টিলেটর উদ্ভাবন দলের অন্যতম সদস্য মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ফজলে রাব্বি শাফি বলেন, আমাদের স্টার্টআপ কোম্পানি ‘ক্রাক্স’ থেকেই আমরা এটা তৈরি করেছি। এটা তৈরি করতে প্রায় লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। প্রথমদিকে স্পন্সরের জন্য চেষ্টা করলেও পরে স্পন্সর না পেয়ে আমরা নিজেদের টাকায় তৈরি করেছি। আমাদের তৈরি ভেন্টিলেটরের সকল তথ্য উপাত্ত আমাদের ওয়েবসাইট www.cruxbd.com এ দিয়ে দিয়েছি। যেন যে কেউ এটা দেখে তাদের প্রয়োজনে তৈরি করে নিতে পারেন।
ক্রাক্স দলের অন্য সদস্যরা হলেন, শাবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মারুফ হোসেন রাহাত এবং সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেক্টনিক বিভাগের শিক্ষার্থী হাসান সোহাগ।
ক্রাক্স মূলত হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, রোবটিকস, IoT ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে। সেইসঙ্গে দলটি এই বিষয়ে বিভিন্ন কোম্পানি বা ব্যক্তিকে কনসালটেন্সি দিয়ে থাকে।