মুহাম্মদ রবিউল হক
আল্লামা সাইয়্যিদ সুলায়মান নদবী (রহ.)। বিশ্ববাসীর কাছে যিনি বিশিষ্ট সীরাত গবেষক ও বিশেষজ্ঞ এবং সীরাতুন্নবীর লেখক হিসেবে পরিচিত।
তিনি একজন উচ্চ মর্যাদাবান আলেমে দ্বীন, একজন বিখ্যাত সীরাত বিশেষজ্ঞ, একজন বিদগ্ধ ঐতিহাসিক, একজন উঁচু মাপের গবেষক এবং একজন দুর্লভ সমালোচক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন রুচিশীল সাহিত্যিক এবং কবি ছিলেন।
দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার প্রতিষ্ঠাতাগণ এবং আল্লামা শিবলী নুমানী এই স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, নদওয়া থেকে ব্যতিক্রম কিছু আলেম তৈরি হবেন।
যারা শুধু প্রাচীন ও নতুন জ্ঞানের সঙ্গমস্থল হবে না বরং প্রাচ্যবিদদের চিন্তা-চেতনার ওপর এমন বজ্র হয়ে পড়বে যে, তার ঝলকে তাদের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে এবং তাদের অমূলক দাবি ও অপবাদ ধুলোয় মিশে যাবে।
আর এই কাজ আল্লামা সাইয়্যিদ সুলায়মান নদবী করে দেখিয়েছেন। আল্লামা শিবলী একবার বলেন, ‘লোকে জিগ্যেস করে নদওয়া কী করেছে? সুলায়মানকে জন্ম দিয়েছে আর এটাই যথেষ্ট।’
নিঃসন্দেহে আল্লামা সাইয়্যিদ সুলায়মান নদবী ফুলবাগানের এমন ফুটন্ত গোলাপ যাকে সব দল-উপদল এবং মতাদর্শের আলেমরা নিজেদের মতাদর্শের আলেম হিসেবে গর্ববোধ করত।
আল্লামা সাইয়্যিদ সুলায়মান নদবী বিহারের এক গ্রামে ১৮৮৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৫ সাল পর্যন্ত তিনি হিন্দুস্তানের প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় শিক্ষাগ্রহণ করেন।
নদওয়ায় তখন আল্লামা শিবলী তার নতুন শিক্ষা পদ্ধতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। সুতরাং আল্লামা শিবলীর তালিম ও তরবিয়াত সাইয়্যিদ সুলায়মান নদবীর ব্যক্তিত্ব তৈরি ও বিকাশে এক বিশেষ অবদান রাখে।
১৯০৬ সালে নদওয়া থেকে শিক্ষা সমাপনীর পর সাইয়্যিদ সুলায়মান নদবী কিছুদিন নদওয়াতেই শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকেন এবং নদওয়ার ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন ও লাখনৌয়ে অবস্থান করেন।
১৯১৩ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার ‘আল হেলাল’ পত্রিকার সহযোগিতার জন্য তাকে কলকাতা ডেকে নেন।
সেখানে তিনি প্রায় ছয় মাস অবস্থান করেন এবং আল হেলাল পত্রিকায় প্রবন্ধ নিবন্ধ লেখার মাধ্যমে নিজের নিজস্ব পরিচিতি তুলে ধরেন।
অতঃপর ১৯১৩ সালে পুনে কলেজে আরবি ও ফারসির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় যখন আল্লামা শিবলী নুমানীর শারিরিক অবস্থার অবনতি হয়ে পড়ে তখন তিনি তার প্রিয়তম শিষ্য সাইয়্যিদ সুলায়মান নদবীকে ডেকে পাঠান এবং তার প্রিয় রচনা ‘সীরাতুন্নবী স.’ সম্পন্ন করা এবং তার স্বপ্ন ‘দারুল মুসান্নিফ’ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব সাইয়্যিদ সুলায়মান নদবীর ওপর ন্যস্ত করেন।
তখন তিনি পুনে থেকে আজমগড় চলে আসেন এবং পরবর্তী ৩০ বছর তার শ্রদ্ধেয় উসতাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন।
১৯২০ সালে মাওলানা আলী জাওহারের নেতৃত্বে ‘মজলিসে খেলাফত’-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে তিনি ইংল্যান্ড সফর করেন। সেখানে অবস্থানকালে ইংরেজি জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্বারা উপকৃত হোন।
১৯২৪ সালে সুলতান আব্দুল আজীজ ইবন আলে সৌদ শরীফ হুসাইনকে পরাজিত করে হেযায জয় করেন, তখন উভয়ে হিন্দুস্তানের খেলাফত আন্দোলনের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ান। তখন আল্লামা সুলায়মান নদবীর নেতৃত্বে হেযাযে একটি প্রতিনিধি রওনা হোন।
আল্লামা উভয়ের মাঝে সন্ধি স্থাপনের সর্বাত্মক চেষ্টা চালান কিন্তু ব্যর্থ হোন। আল্লামা ১৯৩৩ সালে কাবুলের বাদশাহ নাদির শাহের আমন্ত্রণে ডক্টর ইকবার,সাবরাজ মাসউদের সাথে আফগানিস্তানে শিক্ষা সফর করেন।
১৯৪০ সাল পর্যন্ত তার প্রসিদ্ধ সীরাতুন্নবী সা. এর সকল খণ্ড সমাপ্ত হয় এবং দারুল মুসান্নিফীনের প্রসিদ্ধি চারিদিককে ছড়িয়ে পড়ে।
তার জ্ঞান-গবেষণা (ইলমি তাহকিকাত) এবং মা’আরিফ পত্রিকা তাকে মুসলিম বিশ্বে বিশেষ খ্যাতিই এনে দেয়নি বরং তার জ্ঞান গরিমা সমসাময়িক সবার মধ্যে যেমন ইকবাল,মাওলানা আজাদ এবং আলী জওহর সকলে এক বাক্যে মেনে নেন।
১৯৪৩ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। তিনি ১৯২৩ সালে নদওয়ার শিক্ষা সচিব মনোনীত হোন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন।
১৯৪৯ সালে পরিবার-পরিজনের সাথে আলে সউদের বিশেষ মেহমান হিসেবে হজব্রত পালন করেন।
সাইয়্যিদ সুলায়মান নদবী আশরাফ আলী থানবি (রহ.) থেকে আধ্যাত্মিক দিক্ষা লাভ করেন এবং ইযাযতপ্রাপ্ত হোন। ১৯৫০ সালে সংকটময় সময়ে তিনি পাকিস্তান হিজরত করে চলে যান এবং পাকিস্তানের শরিয়া আইন বাস্তবায়ন কমিটির নেতৃত্ব প্রদান করেন।
আল্লামা সুলায়মান নদবীর ইলমি তাহকিকাত এবং রচনাবলী তার জ্ঞানের গভিরতা,পাণ্ডিত্য, কুরআন ও হাদীসে গভীর দক্ষতা, ইসলামী ইতিহাসের ওপর সূক্ষ্ম নজর এবং ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় অগাধ পাণ্ডিত্যের সাক্ষর বহন করে।
যে গ্রন্থগুলো তাকে প্রসিদ্ধি এনে দিয়েছে তা হল- সীরাতুন্নবী (সা.),খুতবাতে মাদরাছ, সীরাতে আয়শা (রা.) এবং আরদুল কুরআন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদবী রহ. বলেন, ‘এই অধমকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে খুতবাতে মাদরাছ। এই এক রচনাই তাকে অমরত্ব দান করতে পারে। আর যদি মকবুল হয় তবে এটিই তার নাজাতের জন্য যথেষ্ট।’ (মেরে ইলমি আওর মুতালা’আতী যেন্দেগী)
সীরাতুন্নবীর (সা.) যে চার খণ্ড তিনি রচনা করেছেন, তা তার জীবনের সবচেয়ে বড় ইলমি অবদান হিসেবে মান্য করা হয়।
তিনি তার মহান শিক্ষকের গবেষণার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সীরাতুন্নবী সা. রচনা করেননি বরং তিনি সীরাত চর্চায় এমন কিছু মূলনীতি তৈরি করেন, যা পুরো ইসলামী ইতিহাসে পাওয়া দুষ্কর।
সীরাতুন্নবী সা. শুধু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের ঘটনাবলীর সমষ্টি নয় বরং তা রাসূল (সা.)-এর আগমনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্যের পয়গাম ও মুখপাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তা উর্দু সাহিত্য ও রচনাবলীর এমন এক শাহকার নমুনা, যার উদাহরণ ইসলামী ইতিহাসে মেলা ভার।
২২ নভেম্বর ১৯৫৩ সালে ৭১ বছর বয়সে ইসলামী বিশ্বের এই মহান মনীষী ইন্তিকাল করেন।
তথ্যসূত্র: ক. উইকিপিডিয়া, খ. নকী আহমদ নদবী, বায়োগ্রাফি অব সাইয়্যিদ সুলায়মান নদবী