লিখেছেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল
বাংলা ভাষায় ধর্ষণ থেকে ভয়ঙ্কর কোনও শব্দ আছে কিনা আমার জানা নেই। একটা সময় ছিল যখন এই শব্দটি লিখতে আমার কলম সরতো না, ‘নির্যাতন’ বা এই ধরনের অন্য কোনও শব্দ ব্যবহার করে বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করতাম। আমি নিজের জন্য একটা খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলাম, নিজেকে বোঝাতাম, আমি সাধারণত বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য লিখি বলে তারা আমার নাম দেখলেই সেই লেখাটা পড়ে ফেলার চেষ্টা করে। এত বাচ্চা বয়সে তাদের এরকম ভয়ঙ্কর একটা বিষয় জানানো মনে হয় ঠিক হবে না। এখন সেই যুক্তিটি আর কাজে আসবে না—খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, আলাপ-আলোচনা, জনসভা, মানববন্ধন, আন্দোলন সব জায়গায় সবচেয়ে বেশিরভাগ সময়ে সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত শব্দটি হচ্ছে ‘ধর্ষণ’। শিশু থেকে বৃদ্ধ কারোরই এ শব্দটি শুনতে এবং এ বিষয়টি জানতে বাকি নেই।
কারও কারও ধারণা হতে পারে ধর্ষণ করার কাজটি কিছু বিকৃত মানসিকতার পাষণ্ডদের মাঝে সীমাবদ্ধ। যারা এটি নিয়ে গবেষণা করেন তারা বলেছেন, শতকরা ৭০ ভাগ ধর্ষণ করে থাকে পরিচিত মানুষ কিংবা আত্মীয়-স্বজন। ছোট বাচ্চাদের জন্য লেখালেখি করি বলে তাদের সঙ্গে আমার এক ধরনের যোগাযোগ আছে। আমি যে কতবার কত ছোট ছোট মেয়েদের চিঠি পেয়েছি, যেখানে মেয়েটি তার চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আমাকে চিঠি লিখে তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতাটি জানিয়েছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেয়েটিকে যৌন নির্যাতন করেছেন তাদের বৃহত্তর পরিবারের কোনও সম্মানিত গুরুজন, কোনও মামা, চাচা, খালু কিংবা ফুপা। আমি সেসব চিঠি পেয়ে কী করবো বুঝতে পারি না, আমার মতো করে সান্ত্বনা দিই, সাহস দিই—অনেক সময় সেটাও করতে পারি না। কারণ, বাচ্চা মেয়েটি চিঠিটা লিখে গোপনে, অন্য কারও হাতে এই চিঠি পড়ুক সেটিও সে চায় না। আশা করে থাকি আমাকে মনের কষ্ট জানিয়ে হয়তো তার দুঃখটা একটু লাঘব হয়েছিল।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা জানি, যারা ছাত্রীদের যৌন নির্যাতন করেছেন। হাইকোর্টের আদেশে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেল তৈরি করা হয়েছিল। আমি অন্তত একটি ঘটনার কথা জানি যেখানে সেই সেলের একটি রিপোর্ট কখনও খোলা হয়নি এবং সেই শিক্ষক বহাল তবিয়তে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়েছেন। যে ভাইস চ্যান্সেলর এভাবে যৌন নিপীড়নকারীদের সুরক্ষা দিয়েছিলেন আমি তাকে নিজের চোখে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতা দিতে দেখেছি। সেই একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আরেকজন প্রবীণ শিক্ষক মেয়েদের ধর্ষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শালীন পোশাক পরার উপদেশ দিয়েছিলেন। বক্তৃতা শেষ করা মাত্রই আমি সেই মঞ্চেই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম শালীন পোশাক পরা বলতে তিনি কী বোঝান? বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার মেয়ের ভিতর তিনি কখনও কোনও মেয়েকে অশালীন পোশাক পরতে দেখেছেন? আমার প্রশ্নের তার কোনও উত্তর ছিল না—তিনি দ্রুত মঞ্চ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন।
সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনা বা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনার পর আমরা সবাই জানি ধর্ষক কিংবা নির্যাতনকারীদের এক ধরনের দুঃসাহস থাকে। কারণ, তাদের সবার এক বা একাধিক গডফাদার থাকে এবং সেসব গডফাদার তাদের সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে। তাদের পুলিশ স্পর্শ করে না, সাধারণ মানুষ তাদের ভয়ে তটস্থ থাকে। কারও সাধ্যি নেই তারা কারও কাছে অভিযোগ করে। কারণ, যারা অভিযোগ করেন পুলিশ উল্টো তাদেরই অ্যারেস্ট করে শাস্তি দেয়। আজকাল পত্রপত্রিকায় সেই খবরগুলো ছাপা হয়।
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি, তখন সেখানেও হুবহু এই ঘটনাগুলো ঘটতে দেখেছি। একবার একজন ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, সেই খবরটি কীভাবে কীভাবে জানি জানাজানি হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা এই ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চায় কিন্তু কিছুতেই সাহস করতে পারছে না। পরদিন পহেলা বৈশাখ, পহেলা বৈশাখের র্যালির আয়োজন করা হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা গোপনে আমাদের অনুরোধ করেছে আমরা যেন সেই র্যালিতে থাকি, তারা পহেলা বৈশাখের র্যালিটিকে প্রতিবাদ র্যালিতে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করবে। আমরা—শিক্ষকেরা যদি থাকি তাহলে ছাত্রনেতারা হয়তো তাদের ওপর হামলা করার সাহস পাবে না। আমরা হাজির থাকলাম এবং ছাত্রনেতাদের সতর্ক পাহারায় ভিতরেই আনন্দ র্যালিটি হঠাৎ করে ধর্ষকবিরোধী র্যালিতে পাল্টে গেল এবং দেখতে দেখতে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর বিক্ষোভে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে উঠলো। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে, তাদের বিক্ষোভ সভায় ছাত্রছাত্রীরা আমাকে বক্তব্য দিতে অনুরোধ করেছে, আমি বক্তৃতা দিয়ে নেমে এসেছি, তখন আমাকে ছাত্রছাত্রীরা জানালো যে, যখন আমি বক্তব্য দিচ্ছি তখন আমার ঠিক পিছনে ধর্ষক স্বয়ং দাঁড়িয়েছিল! পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেল ধর্ষকবিরোধী আন্দোলনের মূল ভূমিকায় ধর্ষক স্বয়ং! এরপরে আরও অনেক কিছু হয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ধর্ষককে শাস্তি দেওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলররা সম্রাটের মতো, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছের পাতাটিও নড়ে না। তারা এসব দলীয় মানুষদের যত্ন করে রক্ষা করেন, তাদের অনেক কাজে লাগে।
আরেকদিন একজন ছাত্রী হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমার স্ত্রীর হাতে কয়েকটি ছবি তুলে দিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে একজন ছাত্রনেতার সঙ্গে মেয়েটির ছবি, ফটোশপের কল্যাণে ছবিতে মেয়েটির শরীরে কোনও কাপড় নেই এবং এই ছবিটি ইন্টারনেটে প্রচার করে দেওয়া হয়েছে। আমার স্ত্রী রাগে উন্মত্ত হয়ে তখনই সেই ছাত্রনেতাকে ডেকে পাঠিয়ে তাকে ধরে আমার অফিসে নিয়ে এলো। এই ধরনের একটি কাজ করার মতো দুঃসাহস সে কেমন করে পেয়েছে সেটি জানার জন্য যখন তীব্র ভাষায় তাকে চেপে ধরা হলো তখন সেই বিশাল প্রতাপশালী ছাত্রনেতা ছুটে গিয়ে আমার স্ত্রীর পা চেপে ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলো। ঘটনাক্রমে সেই দৃশ্যটিরও একটি ছবি তোলা হয়েছিল, তা না হলে কাউকে এটি বিশ্বাস করানো যেতো না! সব তথ্য প্রমাণসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করা হয়েছিল এবং অবাক হওয়ার কিছু নেই, তার বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভাইস চ্যান্সেলররা তাদের রক্ষা করেন, তাদের কারণে একটি দুটি মেয়ের অবমাননা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়।
কেউ যেন মনে না করে কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের শাসনকালে এগুলো ঘটে! রাজনৈতিক দলের ভেতরে নানা বিষয়ে মতপার্থক্য, কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের ভেতরে কোনও মতপার্থক্য নেই! এখানে দুই পক্ষেরই সমান অবদান। শুধু যে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা এগুলো করে তা নয়, শিক্ষকেরাও তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে এই অপকর্মগুলো করে, সাংস্কৃতিক সংগঠনের অত্যন্ত সংস্কৃতবান কর্মীরাও করে। কখনও কখনও মেয়েটি সাহস করে সামনে এগিয়ে এসেছে বলে কয়েকবার তাদের শাস্তিও দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে যে বিষয়টা আমি কখনোই বুঝতে পারি না, সেটি হচ্ছে যে অপরাধটি রাষ্ট্রীয় আইনে অপরাধ, ক্যাম্পাসের ভেতর সেটি ঘটলে কেন তাকে রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোলায়েম আইনে বিচার করা হবে?
যারা মনে করে ধর্ষণ হচ্ছে শুধু বিবেকহীন অমানুষ পাষণ্ডদের কাজ তাদের ধারণা ভুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সুন্দর জ্ঞান সাধনার জায়গায় নিয়মিতভাবে যেটি ঘটতে পারে সেটি দেশের যেকোনো জায়গায় ঘটতে পারে। শুধু যে ঘটতে পারে তা নয়, এটি ঘটছে। এমসি কলেজ বা বেগমগঞ্জের মতো ঘটনাগুলো যখন প্রকাশিত হয়ে যায় শুধু তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রকাশিত হয়নি এরকম ঘটনার সংখ্যা কত কেউ অনুমান করতে পারবে? এমসি কলেজ কিংবা বেগমগঞ্জে দুর্বৃত্তরা এর আগে কতবার এরকম ঘটনা ঘটিয়েছে সেটি কী আমরা জানি?
২.
আমি নিজে যেভাবে ধর্ষণ শব্দটি ব্যবহার করতে একসময় খুব অস্বস্তি অনুভব করতাম ঠিক একইভাবে অন্যরাও নিশ্চয়ই অস্বস্তি অনুভব করে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের নৃশংসতার কথা বলতে গিয়ে প্রায় সময়ই বলা হয় “তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা”। বিষয়টি যে খুব চিন্তা-ভাবনা করে বলা হয় তা নয় কিন্তু এভাবে বলার কারণে আমাদের অজান্তেই একজন পাষণ্ডের পাশবিক অপরাধ একজন নিরপরাধ মেয়ের দায় হিসেবে চলে আসে। একজন মানুষ তার কোনও অপকর্মের জন্য দশ জনের সামনে নিজের সম্মানটুকু হারাতে পারে কিন্তু একজন অপরাধী তার অপরাধ দিয়ে কেমন করে অন্য একজনের সম্মান হানি করবে?
এই বিষয়টি একবার আমাকে একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছিল। একবার আমি আর আমার স্ত্রী মিলে আরও একজনের সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ধর্ষিতা ছাত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছিলাম। তাকে কেবিনে ভর্তি করার সময় হঠাৎ আবিষ্কার করলাম সেই কেবিনে আগে থেকে অন্য একজন মহিলা আছেন—একেবারেই সাধারণ সাদাসিধা আমাদের দেশের গ্রামীণ একজন মহিলা। আমি মনে মনে অস্বস্তিবোধ করলাম, অনুমান করলাম এই মহিলা নিশ্চয়ই তার অপ্রয়োজনীয় কৌতূহল দিয়ে আমাদের ছাত্রীটিকে বিপর্যস্ত করে ফেলবেন।
মহিলাটি পুরো ঘটনাটি কীভাবে জানি আঁচ করে ফেললেন, তখন আমাদের ছাত্রীটিকে বললেন, “শোন মা, একজন রড দিয়ে বাড়ি দিয়ে কারও হাত ভেঙে দেয়, পা ভেঙে দেয়, মাথা ফাটিয়ে দেয়, শরীরের ক্ষতি করে। এইটাও সেই রকম, তোমার শরীরে আঘাত করেছে। সেই জন্য তুমি কেন লজ্জা পাবে? তোমার কেন অপমান হবে? দোষ করবে আরেকজন আর সেই জন্য লজ্জা পাবে তুমি, এটা কেন হবে?”
আমি সেই সাদাসিধা মহিলার কথা শুনে অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম। কত সহজ কথায় একটা স্পর্শকাতর জিনিস আমাদের বুঝিয়ে দিলেন!
৩.
সারা দেশ এখন ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে আছে। তরুণ-তরুণীরা এই করোনাকালেও পথে নেমে এসেছে। মেয়েরা দৃপ্ত পদক্ষেপে মধ্যরাতে শেকল ভাঙার পদযাত্রা করছে, তাদের দেখে আমি আবার নতুন করে আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মের ওপর ভরসা খুঁজে পেয়েছি। দেশের ক্রান্তিলগ্নে পথে নেমে আসতে তাদের কখনও ভুল হয় না। তাদের সুনির্দিষ্ট ১২টি দাবী রয়েছে, আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই দাবিগুলো পড়েছি, প্রত্যেকটি দাবি যৌক্তিক। যে বিষয়গুলো আমাদের চোখের আড়ালে থাকে সেগুলোও তারা আমাদের চোখের সামনে নিয়ে এসেছে।
তবে এসব ব্যাপারে সরকারের প্রতিক্রিয়া খানিকটা বিস্ময়কর, অনেক সময়েই একটি মানবিক এবং সামাজিক আন্দোলনকেও সরকার তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হিসেবে দেখে (তবে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় যেভাবে ছাত্রেরা বুকে ‘আমি রাজাকার’ লিখেছিল সেটি আমাকে অত্যন্ত আহত করেছিল, একটি জনপ্রিয় আন্দোলনকে যেভাবে একটি কুৎসিত রাজনীতির জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল সেটি আমি কখনো ভুলতে পারবো না)। এই মুহূর্তে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু উত্তপ্ত বক্তব্য দেওয়া হলেও সরকারকে সেটি সহ্য করতে হবে। কারণ, তাদের শাসনকালেই এই ঘটনাগুলো ঘটেছে। অনেক জায়গায় তাদের দলের মানুষেরাই এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি এর মাঝে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই তরুণ তরুণীরা আন্দোলন করে এই দাবিটি সামনে তুলে না আনলে সরকার কী এত দ্রুত ধর্ষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দিতো? (এটি ঢালাও শাস্তি নয়, সর্বোচ্চ শাস্তি, তারপরেও দেখছি বিজ্ঞ ‘বুদ্ধিজীবীরা’ এখন এর সমালোচনা শুরু করে দিয়েছেন!)।
তবে শুধু এই আন্দোলনের কারণে এবং মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে রাতারাতি সারা দেশ থেকে ধর্ষণ উঠে যাবে সেটি আশা করা ঠিক হবে না। আমরা এখনও প্রতিদিন সংবাদপত্রে ধর্ষণের খবর দেখছি। অপরাধের কারণে অপরাধীর কঠোর শাস্তি দিয়ে পৃথিবীর কোথাও একটি অপরাধকে নির্মূল করা যায়নি, তার ওপর আমাদের দেশে এই অপরাধের জন্য বিচার প্রক্রিয়াটি জটিল। একটা অপরাধ নির্মূল করতে চাইলে সেটিকে একেবারে গোড়া থেকে নির্মূল করতে হয়। সবার আগে এর কারণটি খুঁজে বের করতে হয়। এখন আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা অনেক বেশি ঘটছে। আমি সমাজবিজ্ঞানী নই, শুধু কমনসেন্স দিয়ে তার কারণ খুঁজে বের করতে পারবো না। বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে হবে, এটি নিয়ে গবেষণা করতে হবে, তারপর একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। তবে সমাজবিজ্ঞানী না হয়েও কিছু কিছু বিষয়ে অনুমান করতে পারি। আজকাল রাস্তাঘাটের সিনেমা হলের টানানো ছবিতে কিংবা পোস্টারে দেখি নায়ক হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার রক্তমাখা দা, কিরিচ বা রামদা থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। যার অর্থ দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা বীরোচিত নায়কের কাজ। শুনেছি প্রতিটি সিনেমায় নাকি ধর্ষণের দৃশ্য নাকি থাকতেই হয়, এটি এখন দর্শকের কাছে খুবই স্বাভাবিক বিনোদনের ঘটনা। সিনেমা হলে গিয়েই সিনেমা দেখে ধর্ষণের দৃশ্য দেখতে হবে সেটিও আর সত্যি নয়। আজকাল সবার হাতে স্মার্টফোন, সেটি দিয়েই যা ইচ্ছা সে যখন খুশি ঘরে বসে দেখতে পারে। একসময় দুর্বৃত্তরা ধর্ষণের ঘটনা ঘটাতো এককভাবে এখন সেটি করা হয় দলবদ্ধভাবে, মোটামুটিভাবে এটি এখন একটি সামাজিক ঘটনা। কী অবিশ্বাস্য একটি ব্যাপার!
কুৎসিত একটা বিষয় নিয়ে কুৎসিত কিছু কথা লিখে নিজেকে কেমন জানি অশুচি মনে হচ্ছে। আমি নতুন প্রজন্মের কথা ভেবে অনুপ্রাণিত হতে চাই, তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চাই। দেশের অর্ধেক হচ্ছে মেয়ে, সেই অর্ধেকই যদি স্বপ্নের অংশীদার না হয় তাহলে কেমন করে হবে? (সবাই কি লক্ষ করেছে, এই বছর সাহিত্য, রসায়ন এবং পদার্থ বিজ্ঞানের তিন জনের একজন নোবেল বিজয়ী হচ্ছে নারী?) আমাদের দেশে যখনই মেয়েদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে তারা অসাধারণ কাজ করে সবাইকে চমৎকৃত করেছে, সেই মেয়েরা যদি ধর্ষকদের ভয়ে ঘরে আটকা পড়ে যায় তাহলে কেমন করে হবে?