ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর তারা। এজন্য দালালকে দিয়েছেন লাখ লাখ টাকা আর রুট হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিপদসংকুল পথ। একের পর এক অবৈধভাবে এক দেশের সীমানা পেরিয়ে আরেক দেশে প্রবেশ করেছে। গন্তব্য তাদের স্পেন অথবা ইতালি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন ছুঁতে পারেননি তারা। বারবার সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ইউরোপের উত্তর-পূর্বাংশের দেশ বসনিয়ার একটি জঙ্গলে। সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। পর্যাপ্ত খাবার নেই, বাসস্থান নেই।
ভাগ্যবিড়ম্বিত এমন শতাধিক বাংলাদেশির খবর তুলে এনেছে জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে।
গতকাল দু’টি পৃথক প্রতিবেদনে এ খবর প্রকাশিত হয়। ডয়চে ভেলের ওই খবরে বলা হয়, ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে বসনিয়ার ভেলিকা ক্লাদুসার একটি জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন অনেক বাংলাদেশি৷ তাদের একজন মোহাম্মদ ইয়াসিন৷ দুই বছর আগে ওমান থেকে বসনিয়া এসেছেন তিনি। স্বপ্ন ইউরোপের কোন দেশে পাড়ি জমানো৷ তিনি এখন আটকে আছেন ক্রোয়েশিয়া-বসনিয়া সীমান্তের ভেলিকা ক্লাদুসার একটি পাহাড়ের ঢালে৷ সেখান থেকে গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ক্রোয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে পারেননি ইয়াসিন৷ বারবার দেশটির পুলিশের হাতে আটকা পড়েন৷ পুলিশ তার সর্বস্ব রেখে আবারো বসনিয়া ফেরত পাঠায় বলে জানান তিনি৷
ইয়াসিনের ভাষ্য, ওমান থেকে স্পিড বোটে করে ইরান এসে সেখান থেকে তুরস্ক হয়ে গ্রিসে আসি আমি৷ গ্রিস থেকে আসি বসনিয়াতে৷ গত চার মাস যাবৎ এ জঙ্গলটিতে আছি৷ সর্বশেষ গত তিনদিন আগে ক্রোয়েশিয়া প্রবেশের চেষ্টা করি৷ সে সময় কিছুটা (ক্রোয়েশিয়ার) ভেতরে ঢুকেছিলাম৷ কিন্তু পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাই৷ পুলিশ আমার সবকিছু কেড়ে নেয়৷ শুধু আন্ডারওয়্যার পরা অবস্থায় আমাকে এখানে ফেরত পাঠায়। সরজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশটির ক্রোয়েশিয়া সীমান্তবর্তী ভেলিকা ক্লাদুসা এলাকার একটি পাহাড়ের ঢালে প্রায় কয়েকশ’ বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। তীব্র শীত, খাবারের অভাব, পানির সংকটে অমানবিক জীবনযাপন করছেন তারা৷
লাখ টাকা খরচ আর বিপদসংকুল পথ
ভেলিকা ক্লাদুসায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে এসেছেন৷ পাড়ি দিয়েছেন দুর্গম পথ৷ সেখানে অবস্থানরতরা জানান, তারা দালালদের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা খরচ করে ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন৷ ১৮ থেকে ২০ লাখ খরচ করে এখানে এসেছি৷ বিভিন্ন দেশে দালালদেরকে এ টাকা দিতে হয়েছে আমাদের৷ এ মুহূর্তে দেশে গেলে নিঃস্ব হয়ে যাব আমরা- জানালেন সেখানে অবস্থানরতদের একজন৷
মানবেতর জীবন
গাছের সঙ্গে পলিথিন বেঁধে ভেলিকা ক্লাদুসার একটি পাহাড়ের ঢালে বানানো হয়েছে তাঁবু, যেখানে গাদাগাদি করে রাত কাটাচ্ছেন তারা৷ এমন বেশ কিছু তাঁবুতে অবস্থান কয়েকশো বাংলাদেশির৷ কর্দমাক্ত মাটিতে পাতলা পলিথিন বিছিয়ে নিজেদের থাকার আয়োজন করেছেন তারা৷ নেই পর্যাপ্ত খাবার কিংবা জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা৷ ভেলিকা ক্লাদুসায় একটি শরণার্থী ক্যাম্প থাকলেও সেখানে সবাইকে আশ্রয় দেয়া হচ্ছে নাবলে অভিযোগ করেছেন তারা৷ অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন পাশের একটি পরিত্যক্ত কারখানায়৷
‘নজর নেই’ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর
কয়েকশো মানুষ বসনিয়ার এ জঙ্গলে মানবেতর জীবনযাপন করলেও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে তাদের সহায়তায় তৎপর হতে দেখা যায়নি৷ এখানে অবস্থানরত বাংলাদশিরা জানান, মাঝে মাঝে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কেউ কেউ কিছু খাবার আর চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে আসলেও তা পর্যাপ্ত নয়৷
দেশে ফিরতে নারাজ
জাতিসংঘের অভিবাসী বিষয়ক সংস্থা আইওএম এর শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় না পেয়ে বসনিয়ার ভেলিকা ক্লাদুসায় একটি পরিত্যাক্ত কারখানা ভবনে আশ্রয় নেয়া শতাধিক বাংলাদেশি ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। এসব বাংলাদেশিরা মানবেতর পরিস্থিতিতে থাকলেও তারা দেশে ফিরতে চান না। সেখানে অবস্থান করা বাংলাদেশিরা জানান, অনেক টাকা খরচ করে এখানে এসেছি৷ আমাদের স্বপ্ন ইতালি, স্পেন যাওয়ার৷ আমরা কখনও দেশে ফেরত যাবো না।
জঙ্গলের ভেতরে ময়লা-আবর্জনা পরিবেষ্টিত ভবনটিতে গাদাগাদি করে অবস্থান করছেন তারা৷ ভাঙ্গা ছাদ আর দেয়ালবিহীন স্থাপনাটিতে শীত আর বৃষ্টিতে অবর্ণনীয় কষ্টের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন।
তারা জানান, অনেকেই ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের৷ কিন্তু পুলিশের বাধার মুখে ফেরত আসেন তাদের বেশির ভাগই৷ সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ৷
সরকার সহযোগিতা করলে দেশে ফেরত যাবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, তাদের স্বপ্ন ইতালি, স্পেন যাওয়ার৷ কোনভাবেই তারা এ স্বপ্ন ত্যাগ করবেন না৷