দানবরূপে ফিরেছে বাংলাদেশের পুলিশ

ছবি: পর্যায়ক্রমে, পুলিশের নির্যাতনে নিহত রায়হান, রায়হানের দুই মাস বয়সের সন্তান ও অভিযুক্ত পুলিশের এসআই। রায়হানের এই শিশুর কাছে কি জবাব দেবে রাষ্ট্র?

মেজর (অব.) সিনহা হত্যার ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই আবারো সহজাত দানবরূপে ফিরেছে বাংলাদেশের পুলিশ। গত ৩১ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফের একটি পুলিশ ফাঁড়িতে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে বিচারবহির্ভূতভাবে গুলি করে হত্যার পর দেশব্যাপি সমালোচনার ঝড়ে পুলিশের দানবীয় রূপ কিছুটা নমনীয় ছিল। সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন রাওয়া ক্লাবের (রিটায়ার্ড আর্ম ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ক্লাব) পক্ষ থেকে কঠোর ভাষায় প্রতিবাদের পর গ্রেফতার করা হয় সিনহা হত্যায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের। এই ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই গত রোববার ভোরে সিলেট শহরের একটি পুলিশ ফাড়িতে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পরিবারের দাবী অনুযায়ী, মাত্র ১০ হাজার টাকা চাঁদার দাবীতে নির্মমভাবে করা হয় এই যুবককে। দুইমাস বয়সের একটি সন্তানও রয়েছে তাঁর। আগামীমাসে তাঁর আমেরিকায় যাওয়ার প্রক্রিয়াও চুড়ান্ত হয়েছিল।

এই যুবককে নির্যাতনে হত্যা করেই শেষ নয়, এই ঘটনাকে পুলিশের সহজাত চরিত্র অনুযায়ী ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালানো হয়। ছিনতাইয়ের অভিযোগে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন বলে দায় এড়ানোর অপকৌশল নিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু পরিবার ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার পর চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত বাধ্য হয়েছে পুলিশ প্রশাসন। তবে শুধু বরখাস্ত নয়, হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবীতে বিক্ষোভে নেমেছেন সিলেটের জনগণ।

বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে পুলিশের এই দানবীয় রূপ নূতন কিছু নয়। গত ১২ বছর ধরে এভাবেই বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুম করে চলেছে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত খুনি বাহিনী। কোন ঘটনার পর মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দানাবেঁধে উঠলে কিছুদিন থেমে আবারো একই রূপে ফিরে এই পুলিশ বাহিনী। মানবাধিকার সংগঠন গুলোর প্রতিবেদনে এমন তথ্যই মিলেছে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই ৩ মাসে ৫৫জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে পুলিশ কতৃক বিচারবহির্র্ভুত হত্যার শিকার হন ৩২ জন।

সাদা পোশাকে উঠিয়ে নেয়ার পর গুম করার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। উঠয়ে নেয়ার পর প্রথমে অস্বীকার করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। পরবর্তীতে অনেকের খোঁজ আর মিলে না। আবার কিছুদিন গুম করে রাখার পর এই পুলিশকেই গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ডের আবেদন জানাতে দেখা যায়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৩ জনকে গুম করা হয়। পরবর্তীতে এদের মধ্যে ৬ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ৭ জনের কোন খোঁজ নেই। বাকীদের বিভিন্ন মেয়াদে গুম রাখার পর গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ।

উল্লেখ্য, চলমান ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ৩ নেতাকে গত সোমবার ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে উঠিয়ে নেয়া হয়। প্রথমে তাদের উঠিয়ে নেয়ার বিষয়টি পুলিশ যথারীতি অস্বীকারও করে। তাদের মধ্যে দুইজনকে একটি মামলায় আটক দেখিয়ে গতকাল আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়। ঢাবির এক ছাত্রীর করা কথিত ‘ধর্ষণের’ মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন সাধারণ অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সাইফুল ইসলাম ও সংগঠনটির ঢাবি শাখার সহ-সভাপতি মো. নাজমুল হুদা। রোববার (১১ অক্টোবর) ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাদেরকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। গুম হওয়া তৃতীয় ছাত্রের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।

ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে শনিবার হুমকি দিয়ে প্রেস রিলিজও দিয়েছে পুলিশ। এই আন্দোলনকে পরোক্ষভাবে “রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড” উল্লেখ করে প্রেস রিলিজে বলা হয়, নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে সরকার ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সদিচ্ছা থাকার পরও একটি স্বার্থান্বেষী মহল বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। দেশ ও জনগণের স্বার্থে যে কোনো মূল্যে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পুলিশ ‘বদ্ধপরিকর’। মূলত এই প্রেস রিলিজের মাধ্যমে জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের দাঁড় করিয়েছে পুলিশ।

সিনহা থেকে রায়হান:

গত ৩১ জুলাই টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। নির্মম সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এ ঘটনায় এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে।

সিনহাকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যার পর কিছুদিন চুপচাপ ছিলো পুলিশ। কিন্তু, সময় গড়ানোর সাথে সাথে ফের তারা নিজেদের দানবীয় চেহারা উন্মোচন করেছে।

রোববার (১১ অক্টোবর) রাতে সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ডেকে নিয়ে রায়হান উদ্দিন (৩৫) নামে এক যুবককে নির্যাতন করে হত্যা করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় ওই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্য তিনজন হলেন- বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল হারুন, তৌহিদ ও টিটু।

নিহত রায়হান সিলেট নগরের আখালিয়া নেহারিপাড়া এলাকার বাসিন্দা।

রায়হানকে খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ; সাধারণ মানুষকে ফাঁসাতে তাদের পুরোনো কূট কৌশলের আশ্রয় নেয়। রায়হানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে বাঁচতে উল্টো স্থানীয়দের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে পুলিশ। তাদের দাবি, ছিনতাইকালে নগরের কাস্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে মারা গেছেন রায়হান।

তবে, পুলিশের সেই মিথ্যা দাবি প্রত্যাখ্যান করে সোমবার সকালে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন সিলেটের মানুষ। রায়হানকে হত্যার প্রতিবাদে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের আখালিয়া এলাকায় স্থানীয়রা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

কী ঘটেছিলো সেই রাতে:

নিহতের পরিবারের অভিযোগ, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান উদ্দিনকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় এসএমপির কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, কে বা কারা রায়হানকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে হত্যা করেছে। এজাহারে রায়হান বন্দরবাজার ফাঁড়ি থেকে যে টেলিফোন নম্বর দিয়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, সেই নম্বরটিও উল্লেখ করা হয়েছে।

এজাহারে উল্লেখ করা হয়, শনিবার (১০ অক্টোবর) বিকেল ৩টার দিকে রায়হান আহমদ নিজ কর্মস্থল নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটের ডা. গোলাম কিবরিয়া ও ডা. শান্তা রানীর চেম্বারে যান। পরদিন রোববার (১১ অক্টোবর) ভোর ৪টা ৩৩ মিনিটে ০১৭৮৩৫৬১১১১ মোবাইল নম্বর থেকে রায়হানের মা সালমা বেগমের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে কল দিলে সেটি রিসিভ করেন রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ।

এ সময় রায়হান আর্তনাদ করে বলেন, তিনি বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাকে বাঁচাতে দ্রুত টাকা নিয়ে বন্দর ফাঁড়িতে যেতে বলেন রায়হান। এ কথা শুনে রায়হানের চাচা ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে রায়হান কোথায় জানতে চাইলে দায়িত্বরত একজন পুলিশ সদস্য বলেন, সে ঘুমিয়ে গেছে। আর যে পুলিশ সদস্য রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছেন তিনিও চলে গেছেন। এ সময় হাবিবুল্লাহকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসার কথা বলেন ওই পুলিশ সদস্য।

পুলিশের কথামতো হাবিুল্লাহ আবারও সকাল পৌনে ১০টার দিকে ফাঁড়িতে গেলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর রায়হানের চাচা ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা যান।

এ সময় হাবিবুল্লাহ পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনকে খবর দিলে তারা গিয়ে ওসমানীর মর্গে রায়হানের ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ দেখতে পান। তার হাত ভাঙ্গ ছিল এবং হাতের নখ গুলি উপড়ে ফেলা হয়েছিল। কোন ধর্ষকামী দল ছাড়া একজন মানুষের উপরে এ জাতীয় নির্যাতন করা সম্ভব নয়।

এজাহারে মামলার বাদী উল্লেখ করেন, আমার স্বামীকে কে বা কারা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে আমার স্বামী মৃত্যুবরণ করেন।

পুলিশকে দানব বানিয়েছে কে?

সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে প্রবল প্রতিবাদ এবং জনরোষ সামাল দিতে তড়িঘড়ি করে পুলিশের বিরুদ্ধে লোক দেখানো ব্যবস্থা নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু, সিনহা হত্যাকাণ্ডের মাত্র ৯দিন পরই জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষে সাফাই গেয়ে পুলিশকে ফের এমন অপকর্মে উৎসাহিত করেন তিনি।

সেই অধিবেশনে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম জিএম কাদেরের বক্তব্যে বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রসঙ্গ উঠে আসেন। এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “যারা কাজ করেন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখতে হবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কথামতোই কাজ করে যাচ্ছে”। অর্থাৎ সংসদে দাড়িয়ে শেখ হাসিনা স্বীকার করলেন যে, পুলিশ যত বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চালাচ্ছে কিংবা গুম করছে তার সবই শেখ হাসিনার নির্দেশ মতই করা হচ্ছে।

ক্ষমতায় যাওয়ার আগে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন শেখ হাসিনা। বিভিন্ন পর্যায়ে ওয়াদা করেছিলেন ক্ষমতায় গেলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জিরো টলারেন্স দেখাবেন।

কিন্তু, ক্ষমতায় আসার পর বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি বিরোধী দলের কর্মসূচিতে পুলিশ কতৃক গুলি করে খুন, বিরোধী নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে গুম করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ বাংলাদেশের ইতিহাসে সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ