স্বাস্থ্য অধিফতরের আবজাল-মালেকের পর এবার বিস্ফোরক পরিদফতরের পরিদর্শক মো. আবদুর রবের বিপুল পরিমাণ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’। দুর্নীতির মাধ্যমে বিস্ফোরক আমদানি ও পরিবহনের লাইসেন্স দেয়াসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এমনকি অনুসন্ধান পর্যায়ে অবৈধ সম্পদের হদিস পাওয়ায় রাজধানীতে পরিদর্শক রবের ৮তলা ভবনসহ ৫২ স্থানের জমি ক্রোক (অ্যাটাচমেন্ট) এবং ব্যাংক হিসাবে থাকা সাড়ে ৩৫ লাখ টাকা ফ্রিজের (অবরুদ্ধ) আবেদন করেছে সংস্থাটি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওইসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও ফ্রিজের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
জনতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই তদন্তকারী কর্মকর্তারা অভিযুক্তের অবৈধ সম্পদগুলো ক্রোকের উদ্যোগ নেন। যাতে তারা ওইসব সম্পদ বেহাত করতে না পারেন। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযোগের অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। হয়তো তার (আবদুর রব) অনুসন্ধানটিও শেষ হয়েছে। শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা শেষে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুর্নীতি করলে কেউই রক্ষা পাবে না। দুর্নীতিবাজ কাউকেই কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার প্রশ্নই উঠে না।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এটা একটা আশার কথা যে তার (আবদুর রব) অবৈধ সম্পদগুলো ক্রোক করা হয়েছে। তিনি যে দুর্নীতির মাধ্যমে এত সম্পদের মালিক হয়েছেন, তা কোনো অবস্থায়ই এককভাবে হননি। তার সঙ্গে তার অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত আছেন। তা না হলে তার পক্ষে দুর্নীতি করা সম্ভব হতো না। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা এ অনুসন্ধানের কতটুকু গভীরে যেতে পেরেছেন বা পারবেন, দেশবাসী তা জানতে চাইবে। শুধু চুনোপুঁটি নিয়ে টানাহেঁচড়া করে যদি রুই-কাতলা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, তাহলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর যুগান্তরকে বলেন, অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিশ্চিত হয়েই অভিযুক্তের সম্পদগুলো ক্রোকের জন্য আদালতে আবেদন করেছেন। এসব অবৈধ সম্পদ ক্রোক হওয়া থাকলে দুর্র্নীতিবাজদের ক্ষমতার দাপটও অনেকটা কমে যায়। এছাড়া বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে অবৈধ সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করাও অনেকটা সহজ হয়।
দুদক ও আদালত সূত্র জানায়, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বিস্ফোরক পরিদর্শক আবদুর রবের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর দুদকের উপপরিচালক মো. আবুবকর সিদ্দিককে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। আবদুর রবের বিরুদ্ধে দুদকে দেয়া অভিযোগে বলা হয়, ঘুষ গ্রহণ করে বিস্ফোরক আমদানি ও পরিবহনের লাইসেন্স দেয়া এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে মাসোহারা আদায় করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি।
রবের অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি : দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি দুই দফায় আবদুর রবের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও ফ্রিজের আদেশ দেন আদালত। আদালতে করা দুদকের আবেদনে বলা হয়, আবদুর রব এসব সম্পত্তি ও ব্যাংকে জমানো টাকা ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন। তার এসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত। আবদুর রবের এসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও ফ্রিজ করা না হলে অনুসন্ধান শেষের আগেই হস্তান্তর বা বেহাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং বিচারকাজে এসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হবে না।
প্রথম ধাপে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড প্রণীত নকশায় কল্যাণপুর ২নং প্রজেক্টের প্লট নং বি-১৬’র সাড়ে ৩ কাঠা জামির ওপর নির্মিত আটতলা ভবন ক্রোকের আদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের সেগুনবাগিচা শাখার ব্যাংক হিসাবে (হিসাব নম্বর ৪৪৩২১৩৪০৪১১৪৫) থাকা ৩৫ লাখ ৫৩ হাজার ১৬৮ টাকা ফ্রিজেরও আদেশ দেয়া হয়। দ্বিতীয় ধাপে আবদুর রবের নিজ নামে থাকা রাজবাড়ী জেলার সদর, পাংশা ও বালিয়াকান্দি থানা এলাকায় ৫১ স্থানে থাকা সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেন আদালত। এগুলো হল- রাজবাড়ীতে রেজিস্ট্রিকৃত সাফ কবলা দলিলে পুরান শিকজান মৌজায় ৬ শতক, ১১ শতক, ২১ শতক, ১৭ শতক, ৬৯ শতক, ৯ শতক, ২৫ শতক, ২৯ শতক, ২৮ শতক, ৫৬ শতক, ১০ শতক, ২২ শতক, ৪০ শতক, ৮৪ শতক, ১২ শতক, ২২ শতক, ১১ শতক, ১৭ শতক, ২৮ শতক ও ২০ শতক। বসুন্দিয়া মৌজায় ১৮ শতক, ৩৪ শতক, ২২ শতক, ৯ শতক, ৫ শতক, ১১ শতক, ১০ শতক, ২৪ দশমিক ৫০ শতক, ৩ দশমিক ৫০ শতক ও ১ দশমিক ২২ একর। বিলনৌছি মৌজায় ৮০ শতক ও ৩৩ শতক। নিয়ামতপুর মৌজায় ১৪ শতক। ভবানীপুর মৌজায় ৫ শতক, ৯ দশমিক ৮৬ শতক, ৬ শতক, ৮৯ শতক, ৬ দশমিক ৬২ শতক, ৪৮ শতক, ৩ দশমিক ৫৬ শতক ও ৪ দশমিক ৫০ শতক। রাইনগর মৌজায় ১৮০ শতক, ৮ শতক, ১২৪ দশমিক ৬৬ শতক, ৯ দশমিক ৫০ শতক, ১১ শতক, ৮ দশমিক ৫০ শতক, ১১ শতক, ২৪ দশমিক ৩৪ শতক ও ২৩ শতক এবং সোনাপুর মৌজায় ৩ দশমিক ২৫ শতক সম্পত্তি।
জানতে চাইলে বিস্ফোরক পরিদর্শক আবদুর রব যুগান্তরকে বলেন, দুদক যেসব সম্পত্তি ক্রোক করেছে, তা আইনানুগ হয়নি। এসব সম্পত্তি আমার বৈধ সম্পদ। আমার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। এছাড়া যে ব্যাংক হিসাবটি ফ্রিজ করা হয়েছে- সেটি আমার স্যালারি (বেতন) অ্যাকাউন্ট। ‘স্যালারি অ্যাকাউন্টে সাড়ে ৩৫ লাখ টাকা রয়েছে। আপনি কি বেতনের কোনো টাকাই অদ্যাবধি উত্তোলন করেননি? আপনার নিজের ও পারিবারিক খরচ মিটিয়েছেন কীভাবে?’- যুগান্তরের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
প্রসঙ্গত, ইতোমধ্যে দেশজুড়ে আলোচিত অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়া দুই ব্যক্তি হলেন- স্বাস্থ্য অধিফতরের গাড়িচালক আবদুল মালেক এবং মেডিকেল এডুকেশন শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা (সাময়িক বরখাস্ত) মো. আবজাল হোসেন। এদের মধ্যে মালেককে ২০ সেপ্টেম্বর ভোরে রাজধানীর তুরাগ থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। ওই সময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ টাকার জাল নোট, একটি ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় র্যাব-১-এর পুলিশ পরিদর্শক আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে দুটি মামলা করেন। ২১ সেপ্টেম্বর দুই মামলায় আদালত মালেকের ১৪ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন। বর্তমানে তিনি রিমান্ডে রয়েছেন। এছাড়া আবজাল হোসেনের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৭ জুন অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা করে দুদক। দুই মামলায় আদালত তার ১৪ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন। এক মামলায় সাতদিনের রিমান্ড শেষে বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। অপর মামলায় তার সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর আছে। শিগগিরই ওই মামলায় রিমান্ডে নেবে দুদক।