ছাত্রাবাসে গতরাতে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনার পর এখন আলোচনায় মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সালেহ আহমেদ। আজ সকালে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
দ্য ডেইলি স্টার: কলেজের ছাত্রাবাসে যখন ধর্ষণের মতো একটি ঘটনা ঘটে, দায় প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে অধ্যক্ষের ওপর বর্তায়। গত রাতে আপনার কলেজে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
অধ্যাপক সালেহ আহমেদ: অধ্যক্ষ হিসেবে আমি কলেজের সব কিছুরই জিম্মাদার। দায় তো আর আমি এড়াতে পারি না। কিন্তু, কোনো ঘটনা ঘটার আগে তো আর বলা যায় না যে এমন কিছু হবে। আপনি সারা বাংলাদেশের অবস্থা দেখছেন, আমাদের সমাজের অবস্থা দেখছেন।
আমার কলেজের গেট বন্ধ ছিল। ছাত্রাবাসও বন্ধ। অনেক সময় ছাত্রাবাসের গেটে তালা দেওয়া থাকে, অনেক সময় থাকে না। কারণ, ওখানে অনেক শিক্ষক, কর্মচারী এবং তাদের পরিবার থাকেন। ঘটনার সময় হয়তো গেটটা তালা দেওয়া ছিল না। তারা ভেতরে ঢুকে গেছে। ওখানে আমার চার তলা ছাত্রাবাস আছে, পাঁচ তলার কাজ চলছে। ওই ছাত্রাবাসের শেষ মাথায় একটি টিলা আছে। ছাত্রাবাসের সামনের দিকে লাইট থাকলেও একদম পেছনের দিকে নেই। সেখানেই এই মেয়েটির সম্মানহানি করেছে তারা। এরা কলেজ থেকে পাশ করে বের হয়ে গেছে। এদের অধিকাংশই আমার শিক্ষার্থী না। সম্পৃক্ততার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে সেই ছয় জনের মধ্যে একজন বর্তমান শিক্ষার্থী, তিন জন পাশ করে বের হয়ে গেছে এবং দুই জন বহিরাগত ছিল।
স্টার: এটি কি সেই ছাত্রাবাস, যেটা ছাত্রলীগ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল?
অধ্যাপক সালেহ: হ্যাঁ।
স্টার: আপনি ধর্ষণের ঘটনা জানতে পারেন কখন?
অধ্যাপক সালেহ: আমার একজন কর্মচারী আমাকে ফোন দিয়ে ঘটনাটি জানায়। এটা রাত ৮টার দিকে। ঘটনাটি তো ঘটেছে সন্ধ্যার পরপরই। আমার কর্মচারী জানানোর পরে শাহ পরান থানার ওসি ফোন দিয়েছেন। তারা ছাত্রাবাসে ঢোকার অনুমতি চাইলে আমি তাদের বলি, আপনারা দ্রুত ভেতরে যান। আমার হোস্টেল সুপারেন্টেন্ড দুজন ছুটিতে আর দুজন সেখানে ছিলেন। তাৎক্ষনিকভাবে তাদের সেখানে পাঠাই। আমার শরীর একটু খারাপ ছিল। পুলিশ ভেতরে যাওয়ার একটু পরেই কলেজের একজন সহযোগী অধ্যাপক এবং শিক্ষক পরিষদের সম্পাদকে সেখানে পাঠিয়েছি। তারা আমাকে জানান, তদন্ত চলছে, আপনার এখনই আসার দরকার নেই। পরে আমাকে যখন যেতে বলেন, তখন আমি রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে যাই এবং ভোররাত ৩টা পর্যন্ত সেখানে ছিলাম।
স্টার: এ ধরনের ঘটনায় ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে। দেখা যায় শিক্ষক বা প্রশাসনের একটি অংশ তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন, আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন। এতে তারা অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
অধ্যাপক সালেহ: না। এটা হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজনীতি করেন। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে কোনো গ্রুপিং নেই। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে অভিন্ন সম্পর্ক। এ ধরনের কাজে তাদের প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমাদের কলেজটা টিলাগড়ে। এখানকার স্থানীয় রাজনীতিতে গ্রুপিং আছে। সেটার প্রভাব তো পরবেই। তাদের যারা প্রশ্রয় দেয় তারা কলেজের বাইরের, কলেজের ভেতরের না।
স্টার: এবারের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছেন?
অধ্যাপক সালেহ: আমি তদন্ত কমিটি করছি। সাবেক এই শিক্ষার্থীরা কোন বিভাগের ছিল, কবে পাশ করে বের হয়েছে তার বিস্তারিত তদন্ত কমিটি বের করতে পারবে। এ বিষয়ে তাদের একটা সুপারিশ তো অবশ্যই থাকবে। তাদের সুপারিশের প্রেক্ষিতে তাদের সনদ বাতিলের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে যথাযথ নিয়মে আবেদন করব।
স্টার: তদন্ত কমিটির ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় না, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এর উদাহরণ রয়েছে এমসি কলেজেই। কলেজের ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়ার ঘটনাও তার মধ্যে একটি।
অধ্যাপক সালেহ: এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ২০১২ সালের। তখন আমি বিভাগীয় প্রধান ছিলাম। এ ঘটনায় আমাদের তদন্ত প্রতিবেদন যথাসময়ে দেওয়া হয়েছে এবং তা প্রকাশ করা হয়েছে। ঘটনার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের জন্য সময় প্রয়োজন হয়, সেটা হয়তো নেওয়া হয়েছে। কিন্তু, শাস্তির বিষয়টি তো আমাদের হাতে নেই। এ বিষয়ে মামলা হয়েছে। সেটি বিচারাধীন।
স্টার: এ ঘটনায় শিক্ষার্থী যারা জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কলেজ কী ব্যবস্থা নিয়েছে?
অধ্যাপক সালেহ: এই ঘটনার সঙ্গেও যারা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল তারা চার থেকে পাঁচ বছর আগে পাশ করা শিক্ষার্থী।
স্টার: এ ঘটনায় তৎকালীন শিক্ষার্থীরাও তো জড়িত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল?
অধ্যাপক সালেহ: আমরা তো সংগঠনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় তাদের নামে অভিযোগ এলে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি বা বিভিন্ন পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কমিটি ব্যবস্থা নেয়।
স্টার: ১২৮ বছরের পুরনো ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার সময়ও সাবেক, সেই সময়ের শিক্ষার্থী এবং বহিরাগতরা জড়িত ছিল। সেখানে আপনারা আপনাদের সুপারিশ দিয়েছেন কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেননি। কেন নেননি?
অধ্যাপক সালেহ: এই পুরনো ছাত্রাবাস ছয় কোটি টাকা দিয়ে পুনর্নির্মাণ করা হলো (আগুন দিয়ে পুরিয়ে দেওয়া ছাত্রাবাসটি)। কিন্তু, দোষীদের শাস্তি দেওয়া হলো না। আপনার যে প্রশ্ন সেটা একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমারও প্রশ্ন। এ ধরেনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য একটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তখন দেওয়া দরকার ছিল। সেটা করা হলে এমন ঘটনা আবার কখনও ঘটানোর তারা সাহস পেত না।
স্টার: এ ঘটনায় আপনি বলছেন সুপারিশ করা হবে। কিন্তু, রাজনৈতিক কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তো ব্যবস্থা নেওয়া নাও হতে পারে। ঘটনা ঘটে যায়, আর অভিযুক্ত হতে থাকেন আপনারা।
অধ্যাপক সালেহ: আমরা কী করতে পারি বলেন। আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা। এগুলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিষয়, অনেক কিছু আছে যেগুলো বিচারিক আদালতের বিষয়, যেটা সরকারের বিষয়, সরকারি যে বিভিন্ন সংস্থা আছে তাদের বিষয়। অনেক কিছু তো আমাদের হাতে নেই। আমি কি বোঝাতে পারছি আপনাকে? আপনার প্রশ্ন আমি বুঝতে পারছি। আপনি আমার দিকটাও বেঝেন, আমার কী সীমাবদ্ধতা, আমি কতটা অসহায়। একটা কলেজের অধ্যক্ষকে ধরে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে আপনার মাধ্যমেই আমরা খবর পাই, টিভিতে দেখি। আমাদের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করেন।
স্টার: এখন আপনার প্রত্যাশা কী? অপরাধীদের শাস্তি হবে?
অধ্যাপক সালেহ: আমার প্রত্যাশা হলো- এদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। আমার পক্ষ থেকে যতটুকু করার আমি করছি। সকালে অনেক সাংবাদিক আমার কাছে এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একজন সিনিয়র সচিব আমাকে ফোন দিয়েছিলেন, তিনি আমার ঘনিষ্ঠজন। তিনি এই কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী। তাকে আমি বলেছি, আপনি তো একটি পর্যায়ে আছেন। এখানে জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আছেন। আমি এই কলেজে শিক্ষার্থী ছিলাম, এখন অধ্যক্ষ। এটা আপনারও কলেজ। আপনি আপনার অবস্থান থেকে কিছু করেন।
এই কলেজের অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন বড় বড় পর্যায়ে আছেন। তাদের অনেককে আমি ফোন করেছি। তারা তাদের পক্ষ থেকে যতটুকু করার করবেন বলে কথা দিয়েছেন। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বতোভাবে চেষ্টা করছেন এদেরকে প্রথমে গ্রেপ্তার করতে। তারপর যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং এদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক এটাই আমার প্রত্যাশা।
স্টার: আপনার কি শিক্ষা মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে?
অধ্যাপক সালেহ: না। এখনও কথা বলা সুযোগ হয়নি। আজ অফিসে বসার পর থেকে তো স্বাক্ষাৎকারই দিচ্ছি। আমি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের মিটিং করব, স্টাফ কাউন্সিলের মিটিং করব তারপর যোগাযোগ করব। আমি যদি এখন তাদের সঙ্গে কথা বলি তাহলে আমার কাছে জানতে চাইবেন, আমি কি কি ব্যবস্থা নিয়েছি। আমি আমার ব্যবস্থাগুলো আগে নিব।