মাহমুদুর রহমান
দিন দশেক আগে আমার কন্যাসমা এক তরুণী মায়ের কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন ঝড় তুলেছিল যে তার রেশ এখনো যায় নাই। ছবিগুলোতে এক পর্দানশীন বাঙালি মুসলমান জননী তার নিতান্তই বালক ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছেন এবং পরম স্নেহে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আছেন। মাতৃস্নেহের এই অপরূপ প্রকাশে মানুষের মন দ্রবীভূত হয়ে ওঠে। প্রবীণত্বে পৌঁছালে এমনিতেই মন দুর্বল থাকে, কারণে অকারণে মানুষ ভাবপ্রবণ হয়ে পড়ে। ঢাকা থেকে এক মানবাধিকার কর্মীর পাঠানো সেই ছবিগুলো দেখে সাতষট্টি বছর বয়সে আমারও চোখের কোণে পানি জমেছিল। তাছাড়া আমার মনে হয়েছিল যে এই ছবিগুলো প্রমাণ করেছে পোশাকের সাথে নারী স্বাধীনতার কোন সম্পর্ক নেই। কোন নারী স্বাধীন হতে গেলে স্বল্পবসনা হওয়া আবশ্যক নয়। নারী স্বাধীনতা বলতে যারা জরায়ুর স্বাধীনতা অথবা নগ্নতার স্বাধীনতা বোঝেন তাদের এই মায়ের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।
ঝর্ণা আখতার তার বিবেচনায় ইসলাম ধর্মের নির্দেশ পালন এবং নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পর্দানশীন পোশাক নির্বাচন করেছেন। এবং সেই পোশাক পরেই তিনি ছেলেকে কেবল ক্রিকেট কোচিংয়ে পৌঁছেই দেননি, ছেলের সঙ্গে মাঠেও খেলতে নেমে পড়েছেন। নব্বই শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশে এমন ঘটনায় সবার খুশী হয়ে মা-ছেলেকে বাহবা দেয়ার কথা ছিল। নারী স্বাধীনতার সাথে শালিনতার এমন চমৎকার মিশ্রণে আপন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে গর্ব অনুভব করার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে উদ্ভূত ফ্যাসিবাদ কবলিত বাংলাদেশে এমনটি ঘটেনি।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের মোড়কে বাঙালি মুসলমানের উপর হিন্দুত্ববাদ চাপিয়ে দেওয়ার যে অপচেষ্টা অর্ধ শতক ধরে চলছে তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদের দালালগোষ্ঠী গেল গেল রবে আর্তনাদ করে উঠেছেন। এমন বাংলাদেশ নাকি তারা চাননি, বাংলাদেশ নাকি আফগানিস্তান হয়ে গেছে। সুপ্রীতি ধর নামের সম্ভবত একজন সংখ্যালঘু নারী লিখেছেন, “কষ্ট লাগে ভেবে যে কী দেশ আমরা চেয়েছিলাম একাত্তরে, আর কী দেশ হলো গত ৫০ বছরে।” জনৈক সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার বয়ানেও একই হাহাকার। কোন এক মেজবাহ কামাল তো পারলে হিজাবকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সুপ্রীতি ধর তার পোস্টে আর এক জায়গায় লিখেছেন, “এই যে বসুন্ধরা মার্কেটে একটা পুরো ফ্লোরই মেয়েদের নানা ডিজাইনের হিজাব বা বোরকা বিক্রি করে, সেটা কি একদিনে হয়েছে, এত বড় মার্কেটে একটাও বইয়ের দোকান নেই, অথচ প্রবেশ পথেই এক কোণায় দেখবেন ইসলামী নানা কিতাব বিক্রি হতে।”
তাহলে বোঝা যাচ্ছে মেজবাহ, ইশতিয়াক এবং সুপ্রীতিদের বিশেষ চাওয়াটা অন্য রকম ছিল। এদের চাওয়ার সঙ্গে ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনার চাওয়ার কোন তফাৎ নাই। তারা চেয়েছিলেন মঙ্গল প্রদীপ এবং মূর্তি পূজার সংস্কৃতির আগ্রাসনে বাঙালি মুসলমানের হাজার বছরের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবসান ঘটাতে। এই উদ্দেশ্য পূরণেই শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে শাহবাগের ইসলামোফোবিক ফ্যাসিবাদী আন্দোলনকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ নামে অভিহিত করেছিলেন। ভারতীয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব দিল্লি থেকে উড়ে এসেছিলেন ইসলাম বিদ্বেষীদের বাহবা দিতে।
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নেহরু-প্যাটেলের পাকিস্তান ভাঙ্গার স্বপ্ন পূর্ণ হলেও বাঙালি মুসলমানের ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে নিঃশেষ করা সম্ভব হয় নাই। বাংলাদেশের মিডিয়ায় ব্রাহ্মণ্যবাদের দালালগোষ্ঠীর একচেটিয়া অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বাঙালি মুসলমানের মগজ ধোলাইয়ের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও আজও ইসলামের মর্মবাণী একেবারে ভুলিয়ে দেয়া যায় নাই। একাত্তরের সেই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতেই তাই প্রণব-হাসিনা গং শাহবাগে তাদের ভাষায় দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ফ্রন্ট খুলেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের আলেম এবং মাদ্রাসা ছাত্র সমাজ ঈমান-আকিদা রক্ষার লড়াইয়ে দেশের সকল প্রান্ত থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলে ইবলিসের দোসররা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। বিশ্বাসের অসমাপ্ত লড়াই এখনো চলমান রয়েছে।
গত বার বছরে শেখ হাসিনার সহায়তায় ব্রাহ্মণ্যবাদ বাংলাদেশকে একটু একটু করে গিলছে। মুজিবপূজা এবং নানান কিসিমের তথাকথিত সর্বজনীন ‘বাঙালি উৎসব’ পালনের ছলে বাঙালি মুসলমানের মগজে ক্রমেই মূর্তিপূজার সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেই উদ্দেশ্য পূরণেই ব্রাহ্মণ্যবাদের এজেন্টদের হিজাব কিংবা বোরকায় এত গাত্রদাহ। সুপ্রীতি-ইশতিয়াক-মেজবাহ গংয়ের চাওয়া হল ঢাকার শপিং মলে হিজাব-বোরকার পরিবর্তে কেবল ইন্ডিয়ার চোলিজাতীয় অর্ধউলঙ্গ পোশাক থরে থরে সাজানো থাকবে। নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে দোকানে কোরআন, হাদিস, এবং ইসলামের ইতিহাস সংক্রান্ত বই-পুস্তকের [তাদের ভাষায় কিতাব] পরিবর্তে রামায়ণ-মহাভারতের হিন্দু পৌরাণিক দেবদেবীর গল্পের বই শোভা পাবে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করে বিচ্ছিন্ন করার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতভুক্ত করে ইন্ডিয়ার মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধির কোন ইচ্ছা ইন্দিরা গান্ধীর ছিল না। দিল্লির নীতিনির্ধারকরা ধরেই নিয়েছিলেন যে স্বাধীন বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ এমনভাবে ছড়িয়ে দেয়া হবে যে দেশটির জনগোষ্ঠী স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে।
এই কারণেই স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছিল শেখ মুজিব প্রশাসন। ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা জিন্নাহ এবং উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও দার্শনিক ইকবালকে বাংলাদেশে রাতারাতি ভিলেন বানানো হয়েছিল দেশটিকে পুরোপুরি ধর্মীয়ভাবে না হলেও অন্তত সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দুকরণের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই। অথচ জিন্নাহ ব্যক্তিজীবনে সম্পূর্ণ সেকুলার এবং রাজনৈতিক দর্শনে ব্রিটেনের ওয়েস্টমিন্সটার ধাঁচের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পুলিশের বর্বরতাতেও তার কোন ভূমিকা ছিল না কারণ ১৯৪৮ সালেই তিনি মারা গেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হলের নাম পরিবর্তন করে মুজিব হল রাখা হলে তখনকার বাস্তবতায় সেটা বেমানান হতো না। যেমন জিন্নাহ এভিনিউ হয়েছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। কিন্তু জিন্নাহ হলকে করা হলো সূর্য সেন হল।
সূর্য সেন অবশ্যই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে এক উজ্জ্বল নাম। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন কট্টর হিন্দু ছিলেন। তার অনুশীলন দলে যোগ দিতে হলে কালী মূর্তির সামনে বুক চিরে সেই রক্ত দিয়ে পূজা করা বাধ্যতামূলক ছিল। অর্থাৎ কোন বিশ্বাসী মুসলমানের সূর্য সেনের দলে যোগ দেয়ার কোন সুযোগ ছিল না। শুধু তাই নয়। সাম্প্রদায়িক আদর্শে গঠিত তার দলের লক্ষ্য ছিল একাধারে ব্রিটিশ এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। এই দলের লোকজন পরবর্তীতে ব্রিটিশ ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কাকে প্রশ্ন করব যে, কথিত সেকুলার বাংলাদেশে একজন সেকুলার সর্বভারতীয় মুসলমান নেতার নাম বদল করে সেখানে কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী আঞ্চলিক হিন্দু নেতার নাম প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল সেদিন কোন যুক্তিতে—শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মকাহিনীতেও তো আমরা জিন্নাহর প্রশংসাই দেখতে পাই। জিন্নাহ তো ভারতীয় মুসলমানদের জন্য স্বাধীন এবং পৃথক আবাসভূমি সৃষ্টি করে নিশ্চয়ই কোন অপরাধ করেন নাই। বরঞ্চ স্বাধীন পাকিস্তানের পথ বেয়েই তো স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে।
একই ভাবে শুধু নামে ব্রাহ্ম্য, জীবনাচারে কার্যত হিন্দু ব্রাহ্মণ রবীন্দ্রনাথ, যিনি বাঙালি মুসলমানদের প্রজার বাইরে কোন সম্মান সমস্ত জীবনে দেননি, তাকে পূজা করার বিনিময়ে একজন মুসলমান কবি এবং দার্শনিক ইকবালকে পঞ্চাশ বছর ধরে ঘৃণা করা শেখানো হয়েছে নব্বই শতাংশ মুসলমানের এই দেশে। পবিত্র কোরআন এবং মহানবী হযরত মোহাম্মদ [সাঃ] সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অশ্রদ্ধামূলক মন্তব্য করেছেন। ইকবাল শুধু ফার্সি এবং উর্দু ভাষার মহাকবিই ছিলেন না তিনিই সর্বপ্রথম ভারতীয় মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভূমির দাবী তুলেছিলেন ১৯২৯ সালে। অসাধারণ মেধাসম্পন্ন ইকবাল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দার্শনিক ছিলেন এবং ইউরোপের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। বিশ্বখ্যাত কেমব্রিজের স্নাতক ইকবাল একই সাথে দর্শন এবং সাহিত্যে পিএইচডি ও লিঙ্কন ইন্সের ব্যারিস্টার ছিলেন।
অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ কেবল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতাই করেন নাই, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যার অবদান সবচেয়ে অধিক সেই নবাব সলিমুল্লাহও বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের কাছে একজন ভিলেন মাত্র এবং তারই দান করা জায়গার উপর নির্মিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতদিন পূজা চলছে রবীন্দ্রনাথের যে কিনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছিলেন। নবাব সলিমুল্লাহ সেখানে একেবারেই অপাঙতেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তার প্রশংসার চেয়ে নিন্দাই বেশী করা হয়। এক্ষেত্রেও নবাব সলিমুল্লাহর একমাত্র অপরাধ যে তিনি একজন মুসলমান ধর্মাবলম্বী ছিলেন। সুবিধাবাদী বাঙালি মুসলমানের অবস্থা হলো নজরুলের কবিতার সেই বিখ্যাত পঙক্তির মতঃ
“দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা
শুধিতে হইবে ঋণ।”
বাংলাদেশ যে আজ ফ্যাসিবাদ কবলিত, দেশটির স্বাধীনতা যে দিল্লির ব্রাহ্মণ্যবাদিদের পদতলে বিলীন, এর প্রধান দায় তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমান শ্রেণির। পূর্ব বঙ্গে হাজার বছরের মুসলমান সংস্কৃতির বিরুদ্ধে চলমান ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই গোষ্ঠী ট্রয়ের ঘোড়ার ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের কথিত সুশীল সমাজ প্রধানত এই শ্রেণির ব্যক্তিদের নেতৃত্ব ও অংশীদারিত্বেই গঠিত। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং মিডিয়া জগতে এদেরই উদ্ধত পদচারণা। মীরজাফরের রক্ত হয়ত এদের ধমনীতে আজো বহমান। স্বল্পবিত্ত ঝর্ণা আক্তার আর তার পুত্ররাই পারে তাদের ঈমানের শক্তিতে এই অপসংস্কৃতিকে বিতাড়িত করে প্রকৃত বাঙালি মুসলমানের বিজয় কেতন ওড়াতে। আসুন, আমরা তাদেরকে স্যালুট জানাই।