গাড়ি চালক মালেক কিংবা বিভিন্ন দপ্তরের অফিস সহায়ক বা নিম্নমান সহকারিগণ কোট কোটি টাকার মালিক বনে যান রাতারাতি, কীভাবে? যারা সরল অংক জানেন মনেও সরল বাংলাদেশের সে সব মানুষদের কাছে এটি একটি বিরাট গোলক ধাঁধাঁ ছাড়া আর কিছুই না। তাঁদের সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্ক কষ্টে হয়।
আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলন আছে তা হচ্ছে ‘বিপদ যখন আসে তখন চারিদিক দিয়েই আসে, একজোট হয়ে’। আরেকটি কথা হচ্ছে, ‘ভাগ্য যখন ভালো হয় তখন খড়কুটা ধরলেও সোনার মোহর হয়ে যায়’। ওসব কথা একদিনে জন্ম বা তৈরি হয়নি, হাজার বছরের অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ এসব কথা বলেছেন, বলে আসছেন।
কয়েকদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ার অনেকেই আক্ষেপ করে বলছেন, তাঁরা তাঁদের মেয়েকে গাড়ি চালকের সাথে কিংবা সরকারী অফিসের অফিস সহায়কের সাথে বিয়ে দেবেন। কারণ দেশে কয়েক শ’ বা কয়েক হাজার গাড়ি চালক বা অফিস সহায়ক বা নিম্নমান সহকারী রাতারাতি হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন, কেউ কেউ তো চাকরী ছেড়ে শিল্পপতি বনে গেছেন ৫/৭ বছরেই। তাই এটা নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন প্রাক্তন সিবিএ নেতার সাথে কথা বলে জানা গাছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।
স্বাস্থ্য দপ্তরের গাড়ি চালক মালেকরা বা তাঁদের মত বিভিন্ন দপ্তরের কর্তারা নিজেরা প্রথমে তাঁদের অবৈধ কাজে এদের শামিল করেন সহযোগী হিসেবে। তখন সহযোগী গাড়ি চালক বা অফিস সহকারী যখন সব অপকর্মের সাক্ষী হয়ে যায় তখন তাঁকে ধীরে ধীরে নানা অবৈধ সুবিধা দিতে থাকেন ঐসব কর্তা ব্যক্তিরা। অবৈধ টাকা যখন বানের পানির মত আসে তখন তাঁর সাথে আসে মদ, জুয়া আর নিত্য নতুন নারী আসক্তি যা আমাদের সমাজে ভালো চোখে দেখা হয় না। মদ, জুয়া আর নিত্য নতুন নারী আসক্তি এতোই প্রবল যে, এতে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান বা নীতি নৈতিকতার কোন বালাই থাকে। বেপরোয়া হয়ে উঠেন তাঁরা তাঁদের জীবনাচরণে। এসবের সাক্ষী হয়ে গেলেই গাড়ি চালক বা অফিস সহায়ক বা নিম্নমান সহকারীগন। গাড়ি চালক বা অফিস সহকারী বা নিম্নমান সহকারীগণ অনেক সময় তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই মদ, নারী সরবরাহ কাজে নেমে গিয়ে অভ্যস্ত হয়ে যান। এর ফলে ঐ নষ্ট অফিসার বা তাঁর গ্রুপ চালক বা অফিস সহকারী বা নিম্নমান সহকারীগণের কাছে, প্রায় সকল কাজে আত্মসমর্পণ করে বসেন। এই সুযোগ হাতছাড়া না করে কিছু চালক বা অফিস সহকারী বা নিম্নমান সহকারীগণ অনেকেই বিলাসী জীবনের স্বপ্ন দেখে নেমে যান অবৈধ আয়ের পথে।
‘টাকায় বাঘের চেখ মেলে’ বলে কথা প্রচলিত আছে। আমাদের দেশের প্রধান দুটি দলে মানে সরকারী দলের পদ বাণিজ্য হয় দেদারছে, তাঁর প্রমাণ ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে। সারা দেশে দেখা গেছে যে, বিএনপি, জাসদ, জাতীয় পার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, জামায়াত, ইত্যাদি দলের অনেক নেতাই তাঁর প্রাক্তন দল থেকে পদত্যাগ না করেই টাকার বিনিময়ে পদ কিনেছেন, সেখানে এখনো নিয়মিত চাঁদা দেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এদের অনেকে উপজেলা চেয়ারম্যান, এমন কি এমপি হয়েছেন সে খবর বেরিয়েছে মিডিয়ায়। একই ভাবে যারা কয়েকবছর আগে ছিলেন বিভিন্ন সরকারী বেসরকারি দপ্তরে বিএনপি জামায়াত (বিজাত) এর শ্রমিক নেতা তাঁরা এখন সরকারী দলের তুখোড় নেতা, পদ বাণিজ্যের মাধ্যমে।
এসব চালক বা অফিস সহকারী বা নিম্নমান সহকারীগণের মধ্যে যারা নেতা হয়েছেন তাঁরা ফুলটাইম অফিসের দামি গাড়ি ব্যবহার করেন। গাড়ির মেইন্টেনেন্সের নামে চলে লুটপাট সুনির্দিষ্ট গ্যারাজের মাধ্যমে। এখানে ভাগ পান বিআরটিএ’র কর্তাগণ। কারণ তাঁদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই গাড়ির ভুয়া রিপিয়ার বিল হয়। ৩ হাজার কিলোমিটার চলা বা ৩ /৪ মাস পরে গাড়ির ফিল্টার, ইঞ্জিন অয়েল, ইত্যাদি পরিবর্তন করতে হয় যার খরচ গাড়ির মডেল ভেদে ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এগুলো হয় না নিয়মিত তাই নতুন গাড়ি ৪/৫ বছরেই নষ্ট হয়ে যায়। গাড়ি যত নতুন হউক না কেন তাঁর মাইলেজ হবে ৫ কিলোমিটার ঢাকায়, ঢাকার বাইরে সবখানেই। একই অবস্থা হয় কারগরি দপ্তরের অন্যান্য যন্ত্রপাতির বেলায়ও। সরকারী অফিসের গাড়ি,যন্ত্রপাতির তেল চুরি, রিপিয়ার মেইটেনেন্সে পুকুর চুরি, টায়ার চুরি, ইত্যাদি এখন ওপেন সিক্রেট।
ঢাকায় এখন আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ সরকারিভাবে। কিন্তু, বাস্তবে তা নয়। অভিযোগ আছে যে, সরকারী দলের শ্রমিক কর্মচারী ফ্রন্টের নেতা বনে যাওয়া হোমরাচোমরাগন বিভিন্ন সরকারী অফিসের অভ্যন্তরে পড়ে থাকা ফাঁকা জায়গা ৩য়, ৪র্থ শ্রেণীর করমি বা তাঁদের আত্মীয়দের কাছে মৌখিক লীজ দিয়ে সেখানে টিন শেড বাসা বানানোর ব্যবস্থা করেন, এরা ভাড়াও দেন অনেকে। দেন অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগ যার বিল দেয় সেই সরকারী দপ্তরের সংশ্লিষ্ট অফিস। এখাত থেকে অফিস ভেদে শ্রমিক কর্মচারী নেতারা কোটি কোটি টাকা আয় করে ভাগ বাটোয়ারা করে নেন। এসব নেতাগণ ছোট ছোট টেন্ডারে ভাগ বসান, বড় কাজে বাঁধা দিয়ে বখরা নেন। তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মনিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত থাকেন।
বিদ্যুৎ, গ্যাস, ওয়াসায় সরকারী দলের শ্রমিক কর্মচারী ফ্রন্টের নেতা এতোই প্রভাবশালী যে তাঁরা বিভিন্ন বস্তি ও বাসায় অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগ দিয়ে শুধু ঢাকা শহরেই মাসে কোটি কোটি টাকা আয় করেন বলে অভিযোগ ও তার প্রমাণ আছে। বেশি টাকার দরকার হলেই বা সরকারী দলের শ্রমিক কর্মচারী ফ্রন্টের নেতা পরিবর্তন হলেই স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে বস্তিতে আগুন লাগে, নতুন সংযোগ হয়, হয় নতুন বাণিজ্য।
বেসরকারি পরিবহণ খাতে মালিকের গাড়ির সংখ্যা বাড়ে বছর বছর। কিন্তু সরকারী গণপরিবহণ খাত লোকসান গোনে সরকারী দলের শ্রমিক কর্মচারী ফ্রন্টের নেতা ও নষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সেটাও আর গোপন কথা নয়। সব দপ্তরের কথা লিখতে গেলে কড়ি দিয়ে কিনলামের মত ১৬ শ’ পৃষ্ঠার উপন্যাস লিখেও শেষ করা যাবে না। তাইতো পাপিয়াদের বিচার হতে এতো দেরি হয়। অবস্থা দেখে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন কাব্য চর্যাপদের কয়েকটি চরণ মনে পড়ে যায়, ‘নগর বাহিরে ডোম্বি তোহোরি কুড়িয়া, ছই ছই যায়সি ব্রাহ্ম নাড়িয়া’। কথা ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘নগরীর উপকণ্ঠে পাপিয়াদের মত ডোম্বি (দেহপসারিনী) দের আখড়া, সেখানে সমাজের বড় বড় মানুষেরা দৈনিক যাতায়াত করেন’।