একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর পর ওই ঋণের টাকা ফেরত দেননি, বরং বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন, সুদ মওকুফসহ সব ধরনের সুবিধা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন। এর পরও ওই চেয়ারম্যান ৫ হাজার কোটি টাকার পরিচালক। তার মতো দেশের ৫৫টি ব্যাংকের পরিচালকরা পরস্পরের যোগসাজশে একে অন্যের ব্যাংক থেকে এক লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।
এক ব্যাংকের পরিচালকের অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা দীর্ঘদিনের। এমনকি নিজের ব্যাংক থেকে বেনামে ঋণের নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে কয়েকটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে। এসব বিষয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে এলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে তাদের নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের স্বার্থের অনুকূলে আইন সংশোধন করা হয়েছে, নতুন বিধিবিধান যোগ করা হয়েছে।
পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগির বিষয়টি নতুন করে সামনে এনেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৫৫টি ব্যাংকের পরিচালকরা একে অন্যের ব্যাংক থেকে এক লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি ১২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। পরিচালকদের নিজ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৬১৪ কোটি ৭৭ লাখ ১৭ হাজার টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ।
এ ছাড়া এসব ব্যাংক পরিচালকের বিরুদ্ধে বেনামেও প্রচুর ঋণ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে তা ঠিকমতো পরিশোধ করছেন না ওয়ান ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, মার্কেন্টাইল, সোশ্যাল ইসলামী, সাউথবাংলা ও এবি ব্যাংকের কয়েকজন সাবেক পরিচালক ও চেয়ারম্যান। কয়েকটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন। খাতাকলমে তারা ঋণখেলাপি না হলেও পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন সুবিধা নিয়েছেন বিশেষ ছাড়ে।
পরিচালকদের ঋণের বিপুল পরিমাণ অংশ পরে খেলাপি হয়ে যায়। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এই খেলাপি ঋণে বারবার সুদ মওকুফ, পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন ও অবলোপন ইত্যাদি বাড়তি সুবিধা নেওয়া হয়। যোগসাজশ থাকার কারণে ঋণখেলাপি পরিচালকের বিরুদ্ধে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে নোটিশ না দেওয়ায় ঋণখেলাপি হিসেবে তাদের চিহ্নিত ও ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে কোনো ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের ঋণখেলাপি হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নোটিশ করতে হয়। নোটিশ পাওয়ার পর ওই ঋণখেলাপি পরিচালককে অপসারণের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত মঙ্গলবার ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যাংক মালিক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার- এই তিন পক্ষও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ যে জনগণের সম্পদ সেটি ভুলে গিয়ে লুটপাটকারী তথা ঋণখেলাপিদেরই ক্রমাগতভাবে সুযোগ করে দিচ্ছে। অনেক সময় তারা ঋণখেলাপি, জালিয়াতিকারী, অর্থ আত্মসাৎকারী ও অর্থ পাচারকারীদের সহায়ক শক্তি হিসেবেও ভূমিকা পালন করছে। এমনকি সরকারকেও তাদের কাছে জিম্মি মনে হয়। যে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব জনগণের আমানত তদারকি এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা- তারাও নেতৃত্বের অদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঋণখেলাপিদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকের পরিচালক ও প্রভাবশালীদের ঋণ ফেরত না দেওয়ার মানসিকতার কারণে খেলাপি ঋণ কমানো যাচ্ছে না। বিভিন্ন ছাড় দেওয়া সত্ত্বেও ক্রমাগত খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুনে তা বেড়ে হয়েছে ৯৭ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। অথচ খেলাপি ঋণ কমাতে কয়েক বছরে কয়েক লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। গত বছর পুনঃতফসিল করা হয় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এ পর্যন্ত খেলাপির হিসাব থেকে বাদ দিতে অবলোপন করা হয়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করে তা পূর্ণাঙ্গ নয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্যমতে, গত বছরের জুন পর্যন্ত দেশের খেলাপি ঋণ ছিল দুই লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত ৫৪ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা যোগ করলে দাঁড়াবে ৩ লাখ কোটি টাকা।