লিখেছেন আমীন আল রশীদ
আলোকচিত্রী ফিরোজ আহমেদের তোলা রাজধানীর পল্টন ময়দানে মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলের সঙ্গে বোরকা পরা মায়ের ক্রিকেট খেলার ছবিটি গতকাল দ্য ডেইলি স্টারে ছাপা হয়। এরপর ছবিটি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে বোরকা নিয়ে তর্কটি ছাপিয়ে গেছে ক্রিকেটকেও। অর্থাৎ, পোশাকের ধাক্কায় মা ও ছেলের মধ্যে নিষ্পাপ ক্রিকেট খেলাটি হারিয়ে গেছে। যেমন: ধর্ষণের পরে অনেক সময় অপরাধের চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে ধর্ষণের শিকার নারীর পোশাক। ফলে যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো, সমস্যাটা বোরকার না মগজের?
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত শিশু ছেলে বল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অপর প্রান্তে বোরকা পরিহিত মা ব্যাট করছেন! মুহূর্তেই সেটি ছড়িয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বোরকা পরা নারীর নাম ঝর্ণা আক্তার, যিনি এক সময়কার সফল অ্যাথলেট। তার ১১ বছরের ছেলের নাম শেখ ইয়ামিন, রাজধানীর আরামবাগের একটি মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র।
এই ছবিটি নিয়ে মূলত দুই ধরনের লোকের অতি উৎসাহ বা উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। প্রথমত যারা মনে করেন, দেশে ইসলামী বিপ্লব হয়ে যেতে আর বাকি নেই এবং দ্বিতীয়ত, যারা নারীর সংক্ষিপ্ত পোশাককে তাদের এগিয়ে যাওয়ার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করলেও বোরকা বা হিজাব দেখলেই বিরক্ত হন বা এ ধরনের ধর্মীয় পোশাককে নারীর অগ্রযাত্রায় বিশাল বাধা মনে করেন।
এই দুই ধরনের লোকই কট্টরপন্থি। অর্থাৎ, যাদের কাছে মা-ছেলের ক্রিকেট খেলার চেয়ে পোশাকটিই অধিকতর গুরুত্ববহ। সুতরাং ধর্ষণের শিকার নারীর পোশাক, পয়লা বৈশাখ বা এরকম বাঙালি সংস্কৃতির উৎসবের দিনে নারীর পোশাক, থার্টি ফার্স্ট নাইটে পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে নারীর সংক্ষিপ্ত পোশাকের সমালোচনা আর এই বোরকা বা হিজাব নিয়ে আলোচনার মধ্যে চরিত্রগত কোনো তফাৎ নেই।
উভয়পক্ষই চরমপন্থি বা নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী নন।
আপনি যখন নারীর সংক্ষিপ্ত পোশাক দেখে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে পুলকিত হন, তখন এটিও মাথায় রাখতে হবে যে, পৃথিবীতে বোরকা ও হিজাব পরে লাখ লাখ বা কোটি কোটি নারী চাকরি করছেন, ব্যবসা করছেন, সংসার সামলাচ্ছেন আবার সেই সঙ্গে সংসার চালাচ্ছেনও। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এখানে পোশাক কোনো বাধা নয়। বরং আপনি যখন বোরকা পরা একজন নারীকে তার ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে দেখেন, তখন আপনি ঈর্ষান্বিত হন। কারণ আপনি মনে করেন, বোরকা বা হিজাব পরা নারীরা ঘরের মধ্যেই থাকবে অথবা বাইরে বের হলেও তারা আপনার বেঁধে দেওয়া বৃত্তের ভেতরে ঘুরপাক খাবে।
ধর্মীয় পোশাক পরে একজন নারী ক্রিকেট খেলবেন— এই দৃশ্যটি আপনি দেখতে চান না। কারণ, নারীর জন্য আপনি যে ধরনের সমাজ কল্পনা করেন, সেখানে নারীকে আপনি নিতান্তই শরীরসর্বস্ব প্রাণীর অধিক কিছু ভাবেন না।
এটা নারীর পোশাকের সমস্যা নয়; সমস্যা আপনার মগজের।
বোরকা বা হিজাব দেখলেই যারা দেশে তালেবানি বা আফগান ভুত দেখেন, তারা তাদের পরিবারে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন কত নারী হিজাব বা বোরকা পরেন। তারা সবাই কি আফগান? যদি তাই হয়, তাহলে তো আপনিও সেই আফগান পরিবারের সদস্য!
পোশাক প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিষয়। এটি আরেকজন ব্যক্তি এমনকি রাষ্ট্রও চাপিয়ে দিতে পারে না। সবাইকে হিজাব পরতে হবে—রাষ্ট্রের যেমন এ কথা বলার অধিকার নেই, তেমনি কেউ হিজাব পরতে পারবে না—এই নির্দেশনাও আরোপ করতে পারে না।
যারা নারীদের হিজাব দেখলেই দেশটা আফগানিস্তান হয়ে গেছে বলে চিন্তিত হয়ে পড়েন, আর নারীদের সংক্ষিপ্ত পোশাক দেখলেই যারা মনে করেন দেশটা উচ্ছন্নে গেলো, তারা উভয়ই ক্ষতিকর। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এত গোরা বা উগ্র নয়। এখানে মানুষের মতো পোশাকেরও বৈচিত্র্য রয়েছে এবং এটাই সৌন্দর্য।
বাংলাদেশের লাখো নারী বোরকা পরেন। এটা তাদের ধর্মবিশ্বাসেরও অংশ। কারো ধর্মবিশ্বাসকে হেয় করার সুযোগ নেই। ধর্ম পালনের অধিকার যেমন ব্যক্তির, তেমনি না পালনের অধিকারও রয়েছে। কিন্তু, কারো ধর্ম পালনে রাষ্ট্রও বাধা দিতে পারে না। ব্যক্তিও না।
বোরকা বা হিজাব এখন নারীর ফ্যাশনেরও অংশ। কোনো নারী যদি বোরকা বা হিজাবকে তার পোশাক বা ফ্যাশনের অংশ মনে করেন, তাহলে তাতে দেশ আফগানিস্তান হয়ে গেলো বলে চিৎকার করার প্রয়োজন নেই। যিনি পরেছেন, সেটা তিনি বুঝেশুনেই পরেছেন। আপনার পয়সায় তিনি বোরকা পরেননি। এমনকি আপনার স্ত্রী বা বোনও যদি বোরকা বা হিজাব পরতে চান, তাতে বাধা দেওয়ার আইনি বা নীতিগত অধিকার আপনার নেই। আপনি বরং তাকে অনুরোধ করতে পারেন বা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারেন। কিন্তু, অন্য একজন নারী বোরকা পরলেন বলে দেশে ইসলামী বিপ্লব হয়ে গেলো— এটা খুবই বিপজ্জনক চিন্তা।
মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর সব দেশের পোশাক বা ফ্যাশন এক নয়। আরবের পোশাকের সঙ্গে ইউরোপের পোশাকের পার্থক্যের মূল কারণ আবহাওয়া। আবার আমাদের দেশে আরব ও ইউরোপ— উভয় অঞ্চলের পোশাকের মিশ্রণ রয়েছে। কারণ, আমাদের দেশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ।
পোশাক নির্বাচনে অনেক সময় ধর্মও বড় ভূমিকা পালন করে। সুতরাং হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী কেউ যদি তার ধর্মীয় রীতি মেনে কোনো পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাতে মুসলমানের গা জ্বলার কিছু নেই। একইভাবে একজন মুসলমান পুরুষ বা নারী যদি তার ধর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কোনো পোশাক পরেন, তা নিয়ে আরেকজনের হাসাহাসি করার কিছু নেই।
আরবের পোশাককেই যে আমাদের দেশে ইসলামী পোশাক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, তা নিয়ে অ্যাকাডেমিক আলোচনা হতেই পারে যে, মরুভূমির ধুলাবালি থেকে বাঁচতে সেখানের লোকেরা মাথায় কাপড় পেঁচিয়ে রাখেন, যেটাকে আমাদের দেশে পাগড়ি বলা হয়— সেই পাগড়ি পরার বাস্তবতা আমাদের দেশের আবহাওয়ায় রয়েছে কি না বা আবহাওয়ার কারণে আরবের লোকেরা যে লম্বা পাঞ্জাবি পরেন, সেটিও আমাদের দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে কতটুকু মানানসই?
আরবের পোশাক না পরলে যে মুসলমান হওয়া যাবে না, তা তো নয়। কারণ, ইউরোপের মুসলমানরা লম্বা পাঞ্জাবি বা পাগড়ি পরেন না। কিন্তু, তারপরও কেউ যদি আরবের অনুকরণে পাঞ্জাবি আর নামাজের সময় মাথায় পাগড়ি পরেন; যদি এই পোশাক তার বিরক্তির কারণ না হয়, তাতে অন্যের তো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আপনি আপনার পছন্দের পোশাক পরছেন, তিনি তারটা। এখানে বিরোধ বা সংঘাতের কোনো কারণ নেই। একজন বোরকা বা হিজাব পরা নারীর যেমন আপনার পোশাক নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার নেই; তেমনি তার বোরকা নিয়ে কটাক্ষ করার অধিকারও আপনার নেই।
ধর্মের মতো অনেক সময় সামাজিক বাস্তবতাও পোশাকের স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করে। যেমন: ইউরোপের রাস্তায় খুবই সংক্ষিপ্ত বা আঁটোসাঁটো পোশাকের নারীর চলাফেরার দৃশ্যটি যতটা স্বাভাবিক, বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা এখনও সেটি অনুমোদন করে না। কিন্তু, যদি সংক্ষিপ্ত পোশাক পরে কোনো নারী রাস্তায় বের হন, রাষ্ট্রের আইন কি তাকে বাধা দিতে পারবে? পারবে না। কিন্তু, পৃথিবীর সব দেশে, সব সমাজেরই কিছু নর্মস থাকে। সেই নর্মস মেনে চলা নাগরিকের অন্যতম দায়িত্ব। সুতরাং অন্যের পোশাক নিয়ে সমালোচনা করা, বিশেষ করে নারীর পোশাক দিয়ে তাকে বিবেচনা করা বা বোরকা-হিজাব পরা দেখলেই সেই নারীকে মৌলবাদী বা তালেবান মানসিকতার বলে চিহ্নিত করা খুবই অনৈতিক ও বিপজ্জনক।
সবশেষ কথা হলো, প্রকাশ্যে মা-ছেলের ক্রিকেট খেলার এই ছবিটার মধ্যে শুধু পাজামা-পাঞ্জাবি আর বোরকাই নয়; বরং এখানে আরও অনেক কিছু আছে। এখন প্রশ্ন হলো, আপনি কী খুঁজতে বা দেখতে চান? আপনি কি এখানে বোরকাটাই দেখতে চান নাকি এখানে মা-ছেলের একটা নির্মল সম্পর্ক এবং তাদের নিষ্পাপ বিনোদন ও জীবনের উল্লাসকে দেখতে চান— সেটি নির্ভর করছে আপনার ব্যক্তিগত বিচার-বিবেচনা, রুচি ও সংস্কৃতির ওপর।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।