মিনার রশিদ
পথ হারানো বিএনপিকে পথের দিশা দেখানোর জন্যে আবারো চরম পেরেশানিতে পড়ে গেছে প্রথম আলো গং। লাইলীর প্রেমে মজনু যেমন, শিরির প্রেমে ফরহাদ যেমন, জুলিয়েটের প্রেমে রোমিও যেমন তেমনি বিএনপির প্রেমে প্রথম আলোকে দিওয়ানা বলে মালুম হচ্ছে। সেই প্রেম ও উৎকণ্ঠা থেকেই পত্রিকাটির যুগ্ম সম্পাদক ও কবি সোহরাব হাসান একটি শায়ের লিখেছেন। প্রেম নি:সৃত ও বেদনা কাতর আঁখি খুলে প্রশ্ন রেখেছেন, পথ হারানো বিএনপি কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?
প্রেমাস্পদ বিএনপিকে ঘুরে দাঁড় করানোর নিমিত্তে এই পেরেশানিটুকু নিজের জন্মলগ্ন থেকেই দেখিয়ে এসেছে দৈনিক প্রথম আলো। বিএনপির আশু করণীয় নিয়ে এই টাইপের শায়ের বা ‘লাভ-লেটার’ গত দেড় যুগ ধরে অসংখ্য লিখেছে!
সোহরাব হাসানের এই লেখাটি পড়ে অনেকেরই গা জ্বালা শুরু করে দিয়েছে। তাকে কোন বিশেষণে বিশেষিত করলে মনের জ্বালাটি মিটবে তা অনেকেই খুঁজে পাচ্ছেন না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অনেক সদস্যও মনের গোপন কথা তাদের নিজস্ব ফোরামে এমনকি স্ব স্ব স্ত্রীদেরও বলতে পারতেন না। কিন্তু সেই গোপন কষ্টের কথা হয় সোহরাব হাসান নতুবা আব্দুল গাফফার চৌধুরীদের নিকট নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যক্ত করেন!
বিএনপির শত্রু কারা, তা সহজেই বোঝা যায়। বিএনপির বন্ধু কারা, তাও গত বিয়াল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতায় কিছুটা ঠাহর করা সম্ভব হয়েছে। এমতাবস্থায় উক্ত কবিকে বিএনপির পাগল-মজনু হিসাবে অভিহিত করলেই বোধহয় যথার্থ হবে।
মূলত: বাংলাদেশের তথাকথিত এলিট শ্রেণীর কাগজ গুলো বিএনপিকে বোকা কুমিরের মত গণ্য করে। এই কাগজগুলোকে এলিটের সারিতে তুলেছে এবং প্রতিপক্ষকে নমশূদ্রদের কাগজ হিসাবে নাক সিটকানোর সুযোগ করে দিয়েছে বিএনপিরই বিশাল নেতা-কর্মী-শুভাকাঙ্ক্ষী বৃন্দ। বিএনপির প্রচার সেল এই দিকে একটু নজর দিলে বা আরেকটু সক্রিয় হলে বিএনপির প্রতি এই কিছিমের প্রেম প্রদর্শন কঠিন হয়ে পড়ত!
এদেশের রাজনীতিতে মিডিয়া এবং বিএনপির মাঝে শিয়াল কুমিরের খেলাটি প্রায়ই জমে ওঠে। ধূর্ত শিয়ালের পাল্লায় পড়ে কুমির তার সন্তানসন্ততি ও সংসার সব হারিয়ে ফেলে। সেই শিয়ালকে একদিন নদী পার হওয়ার সময় মাঝ নদীতে পাকড়াও করে। শিয়ালের পায়ে জাপটে ধরে কুমির। বিপদ দেখে শিয়াল আবার ফন্দি আঁটে। নদীর স্রোতকে শুনিয়ে বলে, দেখো দেখো স্রোত ভায়া! কুমিরটা কত্তো বোকা! আমার পা রেখে লাঠি জড়িয়ে ধরেছে!
এমতাবস্থায় কোনটা পা আর কোনটা লাঠি তা ঠাহর করতে কুমির আবার মুশকিলে পড়ে যায়। শিয়ালের পরামর্শ মত লাঠি ছেড়ে পায়ে ধরে। আর এই সুযোগে হাতের লাঠিটি ফেলে পগার পার হয়ে যায় ধূর্ত শিয়াল।
বর্তমান ফ্যাসিবাদকে সরাতে সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির ইস্পাত কঠিন ঐক্য ছাড়া কোনো বিকল্প নাই। একজন বাচ্চা ছেলেও বিষয়টি বুঝে। কিন্তু জাতি যখন ঐক্যজোটকে দেখে একটু আশান্বিত হলো তখনই তাদের পুরনো ‘হাড় কড়মড়ে’ ব্যারামগুলি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সকলে মিলে ফ্যাসিবাদকে হঠানোর পরিবর্তে জামায়াত হঠানোই মূল টার্গেট করে নিল। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। গণভবনের সংলাপটি (২০১৮ সালের মিডনাইট নির্বাচনের আগে আগে) পুরনো সহকর্মীদের স্মৃতি রোমন্থন কিংবা ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের মিলন মেলায় পরিণত হয়!
এসময় বিএনপির এই মজনু গ্রুপ সুর তুলে যে, সাথে জামায়াতকে রাখা জায়েজ হবে কি না। বিএনপির সামনে তখন প্রশ্ন, আগের বিশ দলীয় জোট নাকি নতুন ঐক্য জোট? এখানে কোনটা শিয়ালের পা আর কোনটা লাঠি তা ঠাহর করা কঠিন হয়ে পড়ে। দুইটাকে একসাথে ধরে রাখার উপায় নেই। একটাকে (ঐক্যজোটকে) পেতে গেলে অন্যটাকে (বিশ দলীয় জোটকে) ছাড়তে হবে। যাই হোক, প্রথম আলোদের মন্ত্রণায় বিএনপি শিয়ালের পা ছেড়ে ধরল লাঠি। পরে দেখে শিয়াল পগার পার!
এভাবে ধূর্ত শিয়াল কুমিররূপী বিএনপিকে বার বার বিভ্রান্ত করেছে। বিএনপি শিয়ালের পায়ে ধরার উপক্রম হলেই বিভ্রান্ত করে হাতে লাঠি ধরিয়ে দিয়েছে।
বিএনপির মজনু দাবিদার এই কবি সোহরাব হাসান লিখেছেন, “১ সেপ্টেম্বর বিএনপি ৪২ বছর পেরিয়ে ৪৩ বছরে পদার্পণ করল। এই বয়সী কোনো দলকে নাবালক বলা যায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, চার দশকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির যে পরিপক্বতা অর্জন করার কথা, তা পারেনি মূলত নেতৃত্বের দোদুল্যমানতা, সিদ্ধান্তহীনতা ও ক্ষেত্র বিশেষে হঠকারিতার জন্য। তাদের আচরণে দেশবাসী তো বটেই, দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও হতাশ।
ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশে কোনো দল জনগণের আস্থা ধরে রাখতে পেরেছে, এমন নজির নেই। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ওপরই জনগণের ভরসা রাখার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো মানুষ ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল—উভয়ের প্রতি আস্থা হারিয়েছে।”
বিএনপির প্রতি এই মজনু মিয়ার আরো কয়েকটি লাইন লক্ষ্য করুন, “অনেকে মনে করেন, বিএনপি মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করার কারণে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। বিএনপির নেতাদের দাবি, সরকারের দমন-পীড়নের কারণে যেখানে তাঁরা রাস্তায় নামতে পারছেন না, সেখানে আন্দোলন গড়ে তুলবেন কীভাবে? তাঁদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে অতীতে কোনো সরকারই বিরোধী দলকে জামাই আদরে রাখেনি। জেল-জুলুমের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই বিরোধী দলকে আন্দোলন করতে হয়।”
প্রিয় পাঠক, এখন মগজটি খাটিয়ে একটু স্মরণ করতে চেষ্টা করুন এই সরকারের বিরুদ্ধে বিশ দলীয় জোটের সর্বাত্মক আন্দোলনের সময় এই প্রথম আলোদের ভূমিকা। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এরকম কঠিন আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনোই হয় নাই। সেই আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে এই প্রথম আলোদের নেতৃত্বেই ‘পেট্রোল বোমা থেরাপি’ প্রয়োগ করা হয়েছে। সরকারের নানা এজেন্সি বাসে পেট্রোল বোমা মেরে আগুন ধরিয়েছে। আর এগুলি ইনিয়ে বিনিয়ে মানুষকে জানিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সৃষ্ট ক্ষোভকে এই মজনুরাই ফিউজ করেছে।
দুটি প্রতিবন্ধকতার কারণে এই মজনুরা বিএনপির প্রতি শতভাগ প্রেম দেখাতে পারেন না। এক, পার্টি প্রধান হিসাবে তারেক রহমান। দুই, জোট সঙ্গী হিসাবে জামায়াত। এই দুটির সংশ্রব ও সহবত না থাকলে প্রেমিক পুরুষ সোহরাব হাসানরা বিএনপির প্রতি প্রেম কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি তা উদাহরণ সহ দেখিয়ে দিতেন।
সাবালক মজনু মিয়াদের চোখে নাবালিকা বিএনপির জনপ্রিয় ভুলগুলি হলো ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাত বাতিল, আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পরপর শেখ হাসিনাকে সহানুভূতি জানাতে বেগম জিয়ার অফিসে প্রবেশ করতে না দেয়া, জামায়াতের সাথে এখনও সম্পর্ক ছিন্ন না করা, ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিএনপির এই পাগল মজনুগণ একটা চেইন তৈরি করে এই মহব্বতের প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। বিএনপির ভুলগুলি প্রথমে নজরে আনেন এই মজনু চেইনের প্রান্তে থাকা ওবায়দুল কাদের এবং হাসান মাহমুদ গণ। বিএনপির সেই ভুলগুলি আরেকটু দরদ মাখিয়ে তুলে ধরেন কিছু টিভি চ্যানেল এবং তাদের গ্ল্যামারাস উপস্থাপিকাগণ। মজনু চেইনের তৃতীয় সারিতে থাকেন এই সোহরাব হাসান গণ। চতুর্থ সারিতে হলেন বিএনপির ট্যাগ মারা কিছু বুদ্ধিজীবীগণ। ফলে ওবায়দুল কাদের এবং হাসান মাহমুদের যে প্রেমময় বাক্য শুনে আপনার গা চুলকাবে সেই কথাটিই কিছুদিন পর হুবহু বিএনপির কোনো কোনো নেতা কর্মীর মুখে হতাশার আকারে শুনতে পাবেন। বিজ্ঞের মত বলবে, ‘বিএনপি এটা না করে ওটা করলেই ভালো হতো।’
মানুষের মধ্যে বানরের বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেলে তাদেরকে সোজা কথায় বলা হয় বান্দর। শব্দটির স্ত্রী-লিঙ্গ করলে হয় বান্দরী। এই বান্দরদের একটি অন্যতম স্বভাব হলো অপরকে খোঁচানো।
এই বান্দরদের খোঁচানোর প্রথম জায়গাটি হলো এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম বিশ্বাস। ইসলাম ধর্মকে না খোঁচালে এদের পেটের ভাত হজম হয় না। আমরা জানি যে ১৯৭১ সালে যারা রাজাকার ছিলেন তাদের খুব কম জনের মুখেই দাঁড়ি এবং মাথায় টুপি ছিল। অথচ এই সাংস্কৃতিক বান্দরেরা এদেশে যত সিনেমা নাটক বানিয়েছে সে সব সিনেমা নাটকের শতকরা নিরানব্বই ভাগ রাজাকারের মুখে দাঁড়ি এবং মাথায় টুপি দিয়েছে।
যে বান্দর এদেশের ধর্মকে খোঁচায় সেই একই প্রজাতি আবার এদেশের গণতন্ত্রকেও খোঁচায়। গণতন্ত্রের মর্ম বোঝার মত ঘিলু এই বান্দরদের মাথায় নেই। এই বান্দরদের খোঁচানো চরমে পৌঁছে গিয়েছিল চার দলীয় জোট সরকারের আমলে। এদের মূল লক্ষ্য ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিকে বিতর্কিত করা। সে লক্ষ্যে মিডিয়া, সংস্কৃতি, বিনোদন জগতের সকল বান্দরেরা নেমে পড়ে। এরা খোঁচানো শুরু করে বিচারপতি এমএ আজিজকে। অথচ এই বিচারপতির পেশাগত জীবনে কোনো দুর্নাম ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, অত্যন্ত সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত বিচারপতি এম এ আজিজ তার অসততা কিংবা অনিরপেক্ষতা দেখানোর সুযোগটিও তখন পান নাই। অর্থাৎ অপরাধ করার আগেই এই বান্দরেরা বিচারপতি এমএ আজিজকে দোষী সাব্যস্ত করে বসে। এদের বুদ্ধিবৃত্তিক সেই সব বাঁদরামোর সামনে সকল শুভবোধ ও যুক্তি অসহায় হয়ে পড়ে। যে বান্দরেরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আওতায় বিচারপতি এমএ আজিজের অধীনে নির্বাচনে অংশ গ্রহণকে ঠিক মনে করে নাই।
সেই বান্দরেরাই এখন বিএনপিকে দোষারোপ করছে কেন ২০১৪ এর নির্বাচন অংশগ্রহণ করে নাই। এই চিড়িয়াদের মনের আসল কথাটিই বেরিয়ে এসেছে, “রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও মনে করেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। যত প্রতিকূল অবস্থাই হোক, বিএনপি ওই নির্বাচনে গেলে তারাই সংসদে প্রধান বিরোধী দল হতো।”
অর্থাৎ এই মজনুর দৃষ্টিতে বিএনপির অপরাধ- কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলকে খুশী মনে গ্রহণ করে তাদের জন্যে ন্যায্য বিরোধীদলের আসনটি অলংকৃত করলো না! এই লেখা পড়ে মেজাজ ঠিক রাখা আসলেই কঠিন!
আশা করা যায়, এই কঠিন সময়টি জাতি অতি শীঘ্রই পার করবে। বুদ্ধিবৃত্তিক বান্দরদের সাম্প্রতিক লেফট-রাইট দেখে তাই মনে হচ্ছে। দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করে জাতির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে যারা হুমকির মুখে ফেলেছে, দেশের সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি ধ্বংস করতে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা করেছে, ইতিহাস সেইসব বান্দরদেরও একে একে চিহ্নিত করবে। যারা বলেছিল- এক এগারো আমাদেরই ব্রেইন চাইল্ড – সেই সব জ্ঞানপাপীদের উপর আঠারো কোটি মানুষ এবং তাদের আগত প্রজন্মের অভিশাপ বর্ষিত হতে থাকবে। ইতিহাস এদের কাউকেই ক্ষমা করবে না, অবশ্যি অবশ্যি এই চিড়িয়াদের বন্দি করবে তাদের জন্যে নির্মিত বিশেষ চিড়িয়াখানায়।
লেখক: কলামিষ্ট, রাজৈনিতক বিশ্লেষক