লিখেছেন আলী রীয়াজ
লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) বরাবর ভারত ও চীনের মধ্যে চলমান উত্তেজনা ও অচলাবস্থা কেবল চীন-ভারত বিরোধই নয়, প্রতিবেশিদের সাথে ভারতের সম্পর্ককেও আলোচনায় এনেছে। এবার চীনের সঙ্গে ভারতের এই সংঘাতের পর চারদিকে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। অথচ, আগে পাকিস্তান ব্যতিত অন্য প্রতিবেশি দেশগুলোর অকুণ্ঠ সমর্থন পেতো ভারত। ভারতের জন্য আরও খারাপ বিষয় হলো, নেপালের পার্লামেন্ট ভারতের সাথে বিবদমান তিনটি এলাকা সমেত একটি সংশোধিত মানচিত্র অনুমোদনের জন্য এই সময়কেই বেছে নিয়েছে। আর ওদিকে বাংলাদেশে চীনের কাছ থেকে চীনা বাজারে বাংলাদেশের ৯৭% পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের প্রস্তাব এসেছে, যা অনতিবিলম্বে কার্যকরও হয়েছে।
বেইজিংয়ের দেওয়া প্রস্তাবের যথার্থতা বা লাদাখের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের দিকে মনোনিবেশ করার পরিবর্তে বাংলাদেশ বরং ব্যস্ত ছিল এই শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের বিষয়টি ভারতীয় গণমাধ্যমে কীভাবে প্রচারিত হচ্ছে তা নিয়ে; বিশেষ করে একটি প্রতিবেদন নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য হয়েছে, যেখানে চীনের সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক লেনদেনের বিষয়টি বর্ণনা করতে অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার করা হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বেইজিং “খয়রাতি” দিয়ে বাংলাদেশের মন পেতে চাচ্ছে। জনরোষ, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের সমালোচনা পত্রিকাটিকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।
ভারতের সেই দৈনিকের প্রতিবেদনটির বিরুদ্ধে জনগণের তীব্র প্রতিক্রিয়া আবারও প্রমাণ করে যে ভারতের সাথে সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে অস্বস্তি জিইয়ে আছে; যদিও দুই দেশের সরকারই দাবি করে যে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক এক সোনালী যুগে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের অনেকেই এই ধারণা পোষণ করেন যে, সম্পর্কটি খুবই একপেশে এবং ভারতের দিকেই অনেক বেশি ঝোঁকা। গত মার্চে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্ধারিত বাংলাদেশ সফরের আগেও একই রকম বৈরী প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পরে ওই সফর বাতিল হয়।
ভারতীয় গণমাধ্যমের সেই প্রতিবেদনের দিক থেকে মনোযোগ সরে গেলেও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখনও আলোচনায় রয়ে গেছে। তবে তাতে নতুন মোড় যুক্ত হয়েছে, তা হলো চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি। আগে যা একাডেমিক আলোচনার বিষয় ছিল, তা এখন গণমাধ্যমে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরে ভারতীয় গণমাধ্যম উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছে যে, চীন ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে কাছে টানছে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছে, বাংলাদেশ এখন ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) বাংলাদেশের যোগ দেওয়া, সাবমেরিন কেনা, বাংলাদেশে চীনের ৩৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ — এরকম কিছু বিষয়ের কথা বলা যায়। পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়ার বিষয়টি এমন সময়ই আসলো, যখন চীন বাংলাদেশে সিস্টার-সিটি স্থাপনের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। এই পদক্ষেপগুলো এসেছে যখন চীন এই এক দশক ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাববলয় প্রসারিত করতে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করে আসছে। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক যা একসময় গুটিকতক খাত, বিশেষত প্রতিরক্ষা ক্রয়ে সীমাবদ্ধ ছিল, তা রূপান্তরিত হয়েছে; ভারতকে ছাড়িয়ে চীন এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে।
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের এই উন্নয়ন ভারতকে এতটাই ক্ষুদ্ধ করেছিল যে, ২০১৮ সালের গোড়ার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করতে হয়েছিল যে, এতে ভারতের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে তার সরকারের কট্টর সমর্থক ভারত। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনী থেকে বোঝা যায়, ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত সরকারের কাছ থেকে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে ভারত ভূমিকা রেখেছিল। একটি বহুল প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে ভারতের সক্রিয় সমর্থন, বিশেষত ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সফর, ছাড়া আওয়ামী লীগের পক্ষে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন হত। গত এক দশক ধরে ভারত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে অকুন্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছে। চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় পড়ে ভারত বাংলাদেশ সরকারকে দু’বার ক্রেডিট লাইন দেওয়ার মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়িয়েছে। কিন্তু বেইজিং যা দিচ্ছে তার তুলনায় এটি খুবই নগণ্য। পাশাপাশি, যেকোনো অর্থেই এই আর্থিক প্যাকেজগুলো এই দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান অত্যন্ত অসম রাজনৈতিক সম্পর্ককে আড়াল করতে যথেষ্ট ছিল না।
যদিও বাংলাদেশ তার দিক থেকে বেশ ধৈর্য্য নিয়ে ভারতের চাহিদা পূরণ করেছে, ভারতীয় পণ্যের বিনামূল্যে ট্রানজিট দিয়েছে, বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে, দেশে উপকূলীয় নজরদারি ব্যবস্থার জন্য রাডার স্থাপন করতে দিয়েছে, ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের যৌক্তিক দাবিগুলোকে ভারত পাত্তা দেয়নি। এছাড়া কিছু ভারতীয় রাজনীতিক বাংলাদেশিদের অবজ্ঞার চোখে দেখেন। এই ভারসাম্যহীন সম্পর্ক, পাশাপাশি অন্য প্রতিবেশিদের প্রতি ভারতের নীতি, হয়তো এমন একটি ধারণা তৈরি করেছে যে ভারত বিশ্বাস করে, বাংলাদেশ সবসময় নয়াদিল্লির প্রভাববলয়ের মধ্যেই থাকবে।
তাই চীনের সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা ভারতের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে এমন একটা সময়ে, যখন চীন-ভারত রেষারেষি তুঙ্গে উঠেছে; এবং বেইজিং অপেক্ষাকৃত ছোট দেশগুলোর সাথে মৈত্রী গড়ার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়ে চলছে। ভারতের গণমাধ্যম ও থিংক ট্যাংক বাংলাদেশের নীতি নিয়ে যে ক্রমবর্ধমান হারে সমালোচনা করছে, বাংলাদেশ “ঋণের ফাঁদে” পড়তে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ প্রকাশ করছে, তা বস্তুত এই অসন্তুষ্টিরই বহিঃপ্রকাশ।
তবে তাই বলে এটা ভাববার অবকাশ নেই যে বাংলাদেশের প্রতি চীনের এই আচরণ কোনো মহানুভবতা। ভারতের সাথে চীনের ভূ-রাজনৈতিক লড়াই শুরু হয়েছে ২০১৪ সালের পরপরই। পরের বছরগুলোতে এর তীব্রতা বেড়ে চলেছে। ভারত ও চীন উভয়দেশেই তাদের নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশকে তাদের পক্ষে রাখার চেষ্টা করে আসছে। ভারত যেখানে স্বল্পমেয়াদী ভাবনায় ভরপুর ও শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক রেখেছে, চীন সেখানে সুদুরপ্রসারী চাল চেলেছে এবং মনে হচ্ছে বেশ ভালোভাবে ঢুকে পড়েছে।
যাই হোক, চীনের অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও বিশাল বিশাল বিনিয়োগ চীনের ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডার বাইরে নয়। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্টত অনুপস্থিতি ও নিজের কাজের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা, আর এর সাথে প্রতিবেশিদের সাথে ভারতের চিড় ধরা সম্পর্ক এ অঞ্চলে প্রভাব বাড়াতে চীনের আগ্রাসী পদক্ষেপকে সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু ভারতীয় নীতিনির্ধারক ও তাদের বিদেশনীতি-বিষয়ক থিংক ট্যাঙ্কগুলো তাদের নিজেদের নীতি-কৌশলের সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করে, চীনের কৌশলের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে। মনে হয় অতীতের ভুল থেকে শেখার কোনো তাড়না নেই। তবে ভারত অবশ্যই তার নিয়ন্ত্রণ থেকে পরীক্ষিত মিত্রকে বের হতে দেবে না।
ভারত ও চীনের সাথে হাসিনা সরকারের ভারসাম্যমূলক আচরণকে অনেকে স্বাগত জানাচ্ছেন। অন্যরা হতবাক হয়েছেন যে তিনি (শেখ হাসিনা) কেন তার প্রধান সমর্থককে বিরক্ত করার ঝুঁকি নিচ্ছেন। এখন এই ব্যাখ্যাটি প্রচলিত যে চীনের সাথে বাংলাদেশের নতুন ঘনিষ্ঠতা অর্থনৈতিক বিকাশের প্রয়োজনে, বিশেষত অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য। এই ব্যাখ্যার সারমর্ম হলো, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক হবে মূলত রাজনৈতিক; আর চীনের সাথে সম্পর্ক সীমাবদ্ধ থাকবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে।
এমন বিভাজন সম্ভব কিনা এবং হাসিনার সরকারের এই সিদ্ধান্ত শুধু অর্থনৈতিক বিবেচনায় কিনা তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। ধাপে ধাপে এই পরিবর্তনের পেছনে রাজনৈতিক বিবচেনাও আছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশে বর্তমান শাসক দলের নৈতিক বৈধতার অভাব রয়েছে। তাই কাজ দিয়ে তারা বৈধতা তৈরির দিকে মনোনিবেশ করেছে এবং আশা করছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়ে গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতার অভাবের ঘাটতি পূরণ করতে পারবে।
কিন্তু গত বছর অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য যেভাবে বেড়েছে, তাতে সেই আশা ম্লান হয়ে গেছে। কোভিড-১৯ মহামারী, বিশেষত সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থারয় ব্যর্থতা ও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি, আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক কৌশলের দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। তারপরও ক্ষমতাসীন দল একই অর্থনৈতিক কৌশল অব্যাহত রাখতে চাওয়ায়, তাদের চীনের অর্থনৈতিক সহায়তার ওপর নির্ভর করার পথ বেছে নিতে হয়েছে। কর্তৃত্ববাদের প্রতি আওয়ামী লীগের ঝোঁক দলটির কাছে ক্রমেই গণতান্ত্রিক প্রতিবেশির চেয়ে চীনকে ভালো বিকল্প হিসেবে হাজির করছে। মোদির আমলের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে গণতন্ত্রের মারাত্মক ধস নামা সত্ত্বেও দেশটি কোনো উঠতি কর্তৃত্ববাদী গোষ্ঠীকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করে যাবে কিনা, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। প্রহসনটা হলো ভারতের সমর্থনেই আওয়ামী লীগের পক্ষে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল আর সেই দলটিই তার একসময়ের পৃষ্ঠপোষকের বিনিময়ে বাংলাদেশকে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীর কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে।
নিশ্চিতভাবেই সামনের মাস ও বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও চীনের দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের মাঝে অবস্থান থাকায়, বাংলাদেশ হবে এই দুই দেশের ভবিষ্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখার একটি প্রধান রঙ্গভূমি।●
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর — এই প্রবন্ধটি আটলান্টিক কাউন্সিলের নিউ আটলান্টিস্ট ব্লগে ২ জুলাই প্রথম ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়।