বাংলাদেশে গণতন্ত্র খুনের সহযোগি এই চারজন। শেখ হাসিনা সরকারের দালালীর মাধ্যমে বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্র ধ্বংস করাই ছিল তাদের দায়িত্ব! বিনিময়ে ৪ জনকেই প্রধান বিচারপতি পদে বসিয়ে পুরস্কৃত করেন শেখ হাসিনা। এদের ৩ জনকে প্রধান বিচারপতি পদে বসাতে সিনিয়রকে টপকাতে হয়েছিল। শেখ হাসিনার অধীনে ভোটার বিহীন নির্বাচন করার মূল কারিগরিটা করেছেন এই চার ব্যক্তি। তারা কিভাবে এটা করলেন? ভোট তো হয়েছে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে। ভোট কেন্দ্র দখল করা হয়েছে পুলিশ ও গুন্ডা বাহিনী দিয়ে। সেনাবাহিনী ছিল তাদের নিরাপত্তার সার্বিক দায়িত্বে! তাহলে এই চার ব্যক্তি দায়ী হবে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর গুলো খুজতেই আজকের এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।
২০০৯ সালের জানুয়ারীতে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। সেনা নিয়ন্ত্রিত জরুরী আইনের সরকারের অধীনে একটি সমঝোতার নির্বাচন হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। সে নির্বাচনে অবিশ্বাস্য ব্যবধানে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট। তখন দেশের সংবিধানে ৫৩ অনুচ্ছেদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল। নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের মেয়াদ শেষ হলে দায়িত্ব নিতেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ৯০ দিনের মধ্যে একটি নির্বাচনের আয়োজন করা হত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ১৯৯৬ সালের ২৫ মার্চ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান। তীব্র আন্দোলনের চাপে সেদিন রাতব্যাপি সংসদ অধিবেশন চলে। সে অধিবেশনে সংবিধানে সংযোজিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই সাংবিধানিক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন এবং ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ৫ বছর মেয়াদ শেষে বিদায় নেয়ার পর নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে চার দলীয় জোট। সে অনুযায়ী ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর মেয়াদ শেষে বিদায় নেয় চার দলীয় জোট সরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগ আবারো নামে ধ্বংসাত্মক আন্দোলনে। এবার তাদের দাবী, প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কার করতে হবে। ফলে স্বাভাবিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, ক্ষমতা নেয় মঈন উদ্দিনের সেনা নিয়ন্ত্রিত জরুরী আইনের সরকার। সে সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। এ নির্বাচনে ডিজিএফআই-এর সমর্থনে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর শুরু হল ১৯৯৬ সালে তারই আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের প্রক্রিয়া। চাইলে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই এটা করা যেত। কারন ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয়ী দল ক্ষমতায়। কিন্তু শেখ হাসিনা বিচার বিভাগকে ব্যবহার করেন। আশ্রয় নেন বিচার বিভাগের। তার বিশেষ অনুগত ৪ বিচারক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বিলোপের কাজটি করে দেন।
হাইকোর্ট যা বলেছিল
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে চার দলীয় জোট সরকারের আমলে একটি রিট আবেদন করা হয়েছিল হাইকোর্ট বিভাগে। এ মামলায় গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত ছিল। তাই ৩ জন সিনিয়র বিচারকের সমন্বয়ে গঠন করা হয় একটি বৃহত্তর বেঞ্চ। শুনানি শেষে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্তর্ভুক্তিকে বৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ে উল্লেখ করা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার হচ্ছে দেশের গণতন্ত্রের জন্য অলঙ্কার স্বরুপ। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই ব্যবস্থার ফলে দেশের জনগনের জন্যে ভোটে অংশ নেয়ার অবাধ সুযোগ তৈরি হয়েছে। জনগণ এ্ই পদ্ধতিকে গণতন্ত্রের জন্য ভাল বলেই গ্রহণ করেছে। এই বলে খারিজ করে দেয়া হয় রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুলটি।
আপিলে যেভাবে বাতিল হয় হাইকোর্টের রায়
এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন রিট আবেদনকারী আইনজীবী। আপিলটি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে একান্ত বিশ্বস্ত খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি পদে আসীন করেন। বছর খানেক প্রধান বিচারপতি পদে থেকে সরকারের নানা উদ্দেশ্য হাসিলে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি। প্রধান বিচারপতি পদে শপথের এক মাসের মধ্যে শুনানি ছাড়াই বাতিল করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি। শেখ হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় রাখার চূড়ান্ত পদক্ষেপটি নেয়া হয় তাঁর উদ্যোগে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বৈধ বলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলটি খুজে বের করেন খায়রুল হক। চাকুরি থেকে বিদায়ের আগেই আপিলটি শুনানি করে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি শুরু হয় ২০১১ সালের মার্চ মাসে। শুরুতে ৭ জন সিনিয়র আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি (অর্থাৎ আইন পরামর্শক) হিসেবে নিয়োগ দেয় আপিল বিভাগ। তারা হলেন- জ্যোষ্ঠতম আইনজীবী টিএইচ খান, ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, ড. এম জহির, এম আমির-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও আজমালুল হোসাইন। ৭ জনের মধ্যে ৬ জনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে অভিমত দেন। একমাত্র হাসিনার অত্যন্ত অনুগত আজমালুল হোসেন কিউসি অভিমত দেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে।
আপিল বিভাগে তখন ৭ বিচারকের বেঞ্চ। প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। আপিল আদালতে ২০১১ সালের ১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত ১১ কার্যদিবস শুনানি হয়। শুনানি শেষে ১০ মে (২০১১) ছিল চূড়ান্ত রায়ের দিন। সেদিন উন্মুক্ত আদালতে রায় ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয়, ৪/৩ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ১৩ তম সংশোধনীটি বাতিল করা হয়েছে। অর্থাৎ ৪ জন হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দিয়েছেন। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযোগ করে সংবিধানের ১৩ তম সংশোধনী বাতিল হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট বিভাগের রায়টি আর বহাল থাকেনি। তবে সেদিনের সংক্ষিপ্ত রায়ে উল্লেখ করা হয় যে, পরবর্তী দুইটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যাবে। কোন চারজন হাইকোর্টের রায় বাতিল করে ১৩ তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলেন এবং কোন তিনজন সংবিধানের ১৩ তম সংশোধনীকে বৈধ বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে রায় দিলেন সেটা স্পষ্ট ছিল না সেদিন। চূড়ান্ত রায় প্রকাশের পর বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এতে দেখা যায়, খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সংবিধানের ১৩ তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছেন।
রায় ঘোষণার পরের দিনই অবসরে চলে যান খায়রুল হক। রায় লেখার দায়িত্ব নেন তিনি নিজে। অবসরে গিয়ে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে রায়টি লিখেন বাংলায়। যদিও সুপ্রিমকোর্টের প্রথা হচ্ছে ইংরেজিতে রায় লেখা। অবসরে গিয়ে ১৪ মাস ধরে রায় লেখার বিষয়টি নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠেছিল। পরবর্তীতে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর সার্কুলার জারি করেন। সুরেন্দ্র কুমারের সার্কুলারে বলা হয়, অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা বৈধ নয়। অথচ তিনি নিজেই খায়রুল হকের অবসরে যাওয়ার পর লেখা রায়ের সাথে একমত পোষণ করেছেন।
১৪ মাস পর লেখা রায়ে দেখা যায়, উন্মুক্ত আদালতে ঘোষিত দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। চার কুশিলব মিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে দিলেন। তারপর পরিবর্তন করলেন তাদের ঘোষিত উন্মুক্ত আদালতের রায়ও।
বাকী রইলেন ৩ বিচারক। তারা হলেন নাজমুন আরা সুলতানা, আবদুল ওয়াহাব মিঞা ও ইমান আলী। নাজমুন আরা সুলতানা এবং আবদুল ওয়াহাব মিঞা হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের সাথে একমত পোষণ করেন। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বৈধ এবং গণতন্ত্রের অলঙ্কার হিসাবে বহাল রাখেন। ইমান আলী বৈধ বা অবৈধ কোন পক্ষে বলেননি। তিনি বিষয়টি জাতীয় সংসদে জনগণের প্রতিনিধিদের বিবেচনার জন্য ছেড়ে দেয়ার পক্ষে অভিমত দেন।
হাসিনার দালালি করে পুরস্কৃত ৪ কুশিলব
পরবর্তীতে দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে রায় দেয়া সকলেই প্রধান বিচারপতির পদ দ্বারা পুরস্কৃত হন। ২ জন সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল রায় দেয়ার আগেই। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে একমত হয়েছিলেন মোজাম্মেল হোসেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এ চারজনের পদক্ষেপের মাধ্যমে শেখ হাসিনার আজীবন ক্ষমতায় থাকার স্বাদ এখন পর্যন্ত পূর্ণ হয়েছে। খায়রুল হককে দ্বিতীয়বার পুরস্কৃত করা হয় প্রধান বিচারপতির বেতন ভাতায় আইন কমিশনের প্রধান হিসাবে নিয়োগ দিয়ে। এখনো তিনি এ পদে বহাল আছেন।
খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার পর মোজাম্মেল হোসেন প্রধান বিচারপতি হন। মোজাম্মেল হোসেন অবসরে যাওয়ার পর প্রধান বিচারপতি হন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। অথচ তখন সিনিয়র হিসাবে প্রধান বিচারপতি পদের দাবীদার ছিলেন নাজমুন আরা সুলতানা। তাঁকে প্রধান বিচারপতি করা হলেও সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে প্রধান বিচারপতি করা যেত। কারন নাজমুন আরা সুলতানা প্রধান বিচারপতি পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পরও সুরেন্দ্র কুমারের সুযোগ ছিল। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পক্ষে রায় দেয়ায় নাজমুন আরার উপর আস্থা রাখতে পারেননি শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার আস্থা ছিল সুরেন্দ্র কুমারের প্রতি। তাই নাজমুন আরাকে ডিঙ্গিয়ে সুরেন্দ্র কুমারকে প্রধান বিচারপতি করা হয়।
পরবর্তীতে সুরেন্দ্র কুমারের সাথে শেখ হাসিনার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিরোধের প্রেক্ষিতে তাঁকে অস্ত্রের মুখে চাকুরি থেকে পদত্যাগ এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এক অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে সিনিয়র হিসাবে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পান আবদুল ওয়াহাব মিঞা। বেশ কয়েক মাস ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে আবদুল ওয়াহাব মিঞার ভিন্নমত থাকায় তার ওপর আস্থা রাখতে পারেননি শেখ হাসিনা। তখন তাঁর জুনিয়র সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে দেয়া হয় প্রধান বিচারপতির পদ।
দেখা যাচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদানকারী চারজনই প্রধান বিচারপতি হন সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে। এই রায়কে ভিত্তি করেই দেশে ভোটের গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। কোর্টের রায়ের দোহাই দিয়ে সরকার সংবিধান সংশোধন করে ২০১২ সালের জুন মাসে। সংবিধানের ১৫ তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানকে ঝেটিয়ে বিদায় করা হয়। এর মাধ্যমেই শেখ হাসিনার অধীনে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন আয়োজনের পথ পরিষ্কার করা হয়। এই পথ তৈরি করার নেপথ্যে কুশিলব হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন চার আওয়ামী বিচারক। মূলত এরাই হলেন বাংলাদেশে ভোটের গণতন্ত্র ধ্বংসের মূল কারিগর।