লিখেছেন কামরুজ্জামান অমিত
জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ টিকটক বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি বেইজিং ভিত্তিক অ্যাপটিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করার কথা বলেছেন। তবে একেবারে নিষিদ্ধ না করে একে আমেরিকান মালিকানার অধীনেও নিয়ে আসতে পারেন। এক্ষেত্রে আমেরিকান মালিকানার অংশ হতে চাচ্ছে মার্কিন টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফট।
মাইক্রোসফট টিকটকের স্বত্ত্বাধিকারী চীনা কোম্পানি বাইটড্যান্স ও মার্কিন সরকারের সাথে আলোচনা করার জন্য ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছে। তাই পরবর্তীতে ট্রাম্প এক্সিকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমে ৪৫ দিনের সময় দিয়েছেন। এ সময়ের পর কোনো আমেরিকান কোম্পানি বা ব্যক্তি টিকটক বা তার স্বত্ত্বাধিকারী চীনা প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবে না। অর্থাৎ, এর মধ্যে টিকটক আর মাইক্রোসফট কিংবা অন্য কোনো মার্কিন কোম্পানির চুক্তি না হলে টিকটককে নিষিদ্ধ ঘোষণা আসবে যুক্তরাষ্ট্রে।
টিকটক অ্যাপ স্টোরগুলো থেকে ২০০ কোটিরও বেশি সংখ্যক বার ডাউনলোড করা হয়েছে। বর্তমানে এর ৮০ কোটি সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এটি ১৬৫ মিলিয়নেরও বেশি সংখ্যক বার ডাউনলোড করা হয়েছে। কিশোর-কিশোরীদের কাছে এটি খুবই জনপ্রিয় মাধ্যম। বর্তমানে তারকারাও অনেকে ব্যবহার করছেন এই অ্যাপটি।
তুমুল জনপ্রিয় এই অ্যাপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা মূলত তথ্য চুরি নিয়ে। গত বছর চীনা টেক জায়ান্ট হুয়াওয়েকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করার পেছনে কারণ ছিল ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত গোপন তথ্য চীন সরকারের কাছে পাচার করা। এটি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। টিকটক নিয়েও ট্রাম্প প্রশাসন একই নীতি অবলম্বন করছে।
যদিও টিকটক বা বাইটড্যান্সের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে তারা চীনা সরকারের কাছে তথ্য পাচার করছে না বা চীনের সাথে তাদের সম্পর্ক নেই। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আইন অনুযায়ী চীনা যেকোনো কোম্পানি সরকারের প্রয়োজনে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য সরকারের হাতে তুলে দিতে বাধ্য থাকবে। এটিই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অস্বস্তির কারণ।
ট্রাম্প এই কারণেই টিকটককেও নিষিদ্ধ করতে চাইছেন। তবে কোনো আমেরিকান কোম্পানি যদি তাদের দেশে পরিচালনা করার জন্য অ্যাপটি কিনে নেয়, আর ব্যবহারকারীর ডেটা আমেরিকার অভ্যন্তরেই রেখে দেয়, তাহলে তার নিষেধাজ্ঞা না আনলেও চলবে। মাইক্রোসফট টিকটকের আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের পরিচালনার অংশ কিনে নিতে চাচ্ছে। এটা নিয়ে দুই কোম্পানির মধ্যে সংলাপ চলছে। সেটা যদি সফল হয়, আমেরিকা ও মাইক্রোসফট উভয়ের জন্যই লাভজনক হবে। তবে এতে বেশ কিছু প্রশ্নও আছে।
গত ২ আগস্ট মাইক্রোসফটের পক্ষ থেকে এক ব্লগ পোস্টে জানানো হয়েছে, তারা বাইটড্যান্সের সাথে আলোচনা করছে টিকটক নিয়ে। তারা ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটা সমাধানে আসবে এবং এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সাথেও আলোচনা করবে। মাইক্রোসফট শুধু টিকটকের যুক্তরাষ্ট্র অংশের মালিকানাই কিনবে না; তারা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কানাডার অংশও পরিচালনা করতে চায়।
তারা আমেরিকান ব্যবহারকারীদের ডেটা যেন আমেরিকার অভ্যন্তরেই থাকে, সেটা নিশ্চিত করবে। দেশের বাইরে থাকা ডেটাগুলো আমেরিকায় নিয়ে আসবে। যদি সেগুলোর কোনো ব্যাকআপ বা কপি থাকে, সেগুলো যেন ডিলিট করে দেওয়া হয় সেটা তারা নিশ্চিত করবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবেও এই প্রক্রিয়ার খোঁজ রাখছেন। মাইক্রোসফট মূলত নিরাপত্তার দিকটিই খেয়াল রাখতে চায়। তবে এটাও জানিয়েছে, এসব কথাবার্তা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।
মাইক্রোসফট টিকটক কিনতে সফল হলে এটা তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসবে। কারণ তারা বিপুল পরিমাণ ব্যবহারকারীর ডেটা নিজেদের অধিকারে পাবে। এসব ডেটা তারা বিভিন্ন উপায়ে কাজে লাগাতে পারবে। তারা এক্সবক্স লাইভকে ব্যবহার করেছে ভবিষ্যতের সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার পণ্য তৈরিতে ধারণা নিতে। সাম্প্রতিক সময়ে সরাসরি ভোক্তা পণ্য পরিষেবায় মাইক্রোসফট উল্লেখযোগ্য সফলতা দেখাতে পারেনি। টিকটক তাদেরকে এই ক্ষেত্রে নিজেদের সীমাবদ্ধতা দূর করতে সাহায্য করতে পারে।
তাছাড়া মাইক্রোসফট এই ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপকে বিজ্ঞাপন ব্যবসাতেও কাজে লাগাতে পারবে। ফেসবুক, গুগল যেখানে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ আয় করছে মাইক্রোসফট সেখানে অনেকটাই পিছিয়ে। তারা সারা বছর বিজ্ঞাপন থেকে যে আয় করে, ফেসবুক সেটা এক সপ্তাহেই করতে পারে। টিকটকে বিপুল পরিমাণ ব্যবহারকারী থাকায় তারা সহজেই বিজ্ঞাপন থেকে অনেক আয় করতে পারবে। সারফেস, এক্সবক্সসহ নিজেদের অন্যান্য পণ্যের প্রচারও করতে পারবে টিকটকে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি নিয়েও মাইক্রোসফটের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা আছে। টিকটক ইতোমধ্যে তাদের অ্যাপে ফেসিয়াল রিকগনিশনের জন্য এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তাছাড়া অগম্যান্টেড রিয়েলিটি বা এআর প্রযুক্তির জন্যও এটি মাইক্রোসফটের জন্য দারুণ উপকারে আসবে। টিকটকের এক ঝাঁক মেধাবী কর্মীও মাইক্রোসফটের উপকারেই আসবে।
বর্তমানে ইন্টারনেটে সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে এক নম্বরে আছে গুগল, ইমেইলেও এগিয়ে আছে জিমেইল, মোবাইল ফোনে অ্যান্ড্রয়েড আর আইফোনের দাপট। তাছাড়া গুগল ডকস ও গুগলের অন্যান্য সেবা থাকায় এখন মাইক্রোসফটের সফটওয়্যার ছাড়াও আমেরিকানদের অফিস কর্মকাণ্ড করা করা সম্ভব। মোবাইল ফোনের বিপ্লবের সময়টাও মাইক্রোসফট কাজে লাগাতে পারেনি।
টিকটক যারা সহজে কিনতে পারে, সেই বড় কোম্পানিগুলো এখন কিছুটা ব্যাকফুটে আছে। গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক, অ্যামাজন মনোপলির অভিযোগে কংগ্রেসের জেরার সম্মুখীন হচ্ছে। মাইক্রোসফট তাই এই সুযোগটা কাজে লাগাতে চাচ্ছে। কিন্তু তাতে আদৌ কতটা সফল হতে পারবে সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
মাইক্রোসফট সরাসরি ভোক্তা পণ্য পরিষেবায় মুখ থুবড়ে পড়েছে বিভিন্ন সময়ে। গ্রুভ মিউজিক সার্ভিস, কাইনেক্ট এক্সবক্স একসেসরি, উইন্ডোজ ফোন, মিক্সার স্ট্রিমিং সার্ভিস- এসব সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। করোনা মহামারির সময়ে স্কাইপিও জুমের কাছে পরাজিত হয়েছে। নোকিয়া ফোনও ব্যর্থ হয়েছে। এসব ব্যর্থতার ইতিহাস থাকায় টিকটক নিয়েও সন্দেহ পোষণ করছেন অনেকে। তবে সত্য নাদেলা মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ছয় বছরে লিঙ্কড ইন ও গিটহাব কিনে সফলতা পেয়ছেন। সে কারণে নাদেলার ওপর আস্থা রাখছেন অনেকে।
টিকটক ক্রয়ের প্রক্রিয়াটিও উদ্ভট ও নজিরবিহীন। কারণ মাইক্রোসফট টিকটক পুরোপুরি কিনে নিচ্ছে না। তারা কেবল চারটি দেশে টিকটকের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে। এটা একটা উদ্ভট আঞ্চলিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিণত করবে টিকটককে। টিকটককে এই চার অঞ্চলের জন্য কীভাবে আলাদা করা হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। একজন আমেরিকান টিকটক ব্যবহারকারী কোনো ইউরোপিয়ান টিকটক ব্যবহারকারীর ভিডিও কীভাবে দেখবেন তা এখনো নিশ্চিত নয়। যদিও বলা হচ্ছে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন থাকবে না সেখানে।
তাছাড়া আলাদা করার প্রক্রিয়াটা কেমন হবে তাও বলা হয়নি। আমেরিকানদের জন্য কি আলাদা অ্যাপ থাকবে? তাহলে তার জন্য আলাদা সার্ভার, আলাদা কর্মীর দরকার হবে। সেটা আরো ব্যয়বহুল হবে। বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্যও কাজটা কঠিন হয়ে যাবে। টিকটকের বেশিরভাগ ব্যবহারকারীই এশিয়ার। মাইক্রোসফটকে এক-তৃতীয়াংশেরও কম ব্যবহারকারীর অংশ নিয়ে কাজ করতে হবে। এখানে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করা হবে, আয় হয়তো তার তুলনায় অনেক কম হবে।
টিকটক ব্যবহারকারীদের ভিডিওর রিচও হয়তো সীমিত হয়ে পড়বে। নতুন ব্যবস্থায় অ্যালগরিদম কীভাবে কাজ করবে তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। বাইটড্যান্স অ্যালগরিদমের জন্য সুনাম অর্জন করেছে। তারা হয়তো টিকটকের অ্যালগরিদম মাইক্রোসফটের কাছে ব্যবসায়িক গোপনীয়তার জন্য নাও প্রকাশ করতে পারে। সেক্ষেত্রে মাইক্রোসফটের মালিকানাধীন টিকটক মানহীন হয়ে পড়বে।
টিকটক নিয়ে বিতর্কের মূল কারণ হচ্ছে ডেটা। মাইক্রোসফট টিকটকের কাছ থেকে কীভাবে আমেরিকানদের ডেটা আলাদা করবে বা চার অঞ্চল বাদে বাকি অংশের ডেটা কীভাবে টিকটকের সাথে শেয়ার করবে তা এখনো বলা হয়নি। এসব ডেটা বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়াটি কারা রক্ষণাবেক্ষণ করবে সেটাও বলা হয়নি। তাছাড়া আমেরিকান সিনেটের নেতারাও অনেকে এই প্রক্রিয়াটি পছন্দ করছেন না। তারা টিকটককে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করে দেওয়ারই পক্ষে।
অথবা টিকটকের পুরো অংশটাই হয়তো বিক্রি করে দেওয়ার জন্য বাইটড্যান্সকে চাপ দেওয়া হতে পারে। টিকটকের প্রধান নির্বাহী কেভিন মেয়ার তখন কীভাবে কাজ করবেন সেটাও প্রশ্ন। তিনি বাইটড্যান্সের অধীনে থাকা টিকটকে কাজ করবেন, নাকি মাইক্রোসফটের অধীনে কাজ করবেন সেটা নিয়েও দেখা যাচ্ছে অনিশ্চয়তা। এদিকে টিকটককে নকল করে ফেসবুক নিয়ে আসছে ইন্সটাগ্রাম রিলস। তখন টিকটক প্রতিযোগিতায় কতটা টিকে থাকতে পারে, সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে অনেকের।
বাইটড্যান্সের পক্ষ থেকে ডেটা পাচারের অভিযোগ সবসময়ই অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়তো টিকটকের কিছু অংশ তাদের বিক্রি করতেই হবে। সম্প্রতি ভারতে টিকটক নিষিদ্ধ হওয়ায় বিপুল পরিমাণ ব্যবহারকারী হারিয়েছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রও নিষিদ্ধ করে দিলে আর দাঁড়াতে পারবে না কোম্পানিটি।
সরাসরি কোনো আমেরিকান কোম্পানির নাম বলা হয়নি তাদের পক্ষ থেকে। তবে মাইক্রোসফটের কাছেই বিক্রির সম্ভাবনা বেশি। বাইটড্যান্সের নির্বাহী ঝ্যাং ইমিং একসময় মাইক্রোসফটে কাজ করেছেন। টিকটক কিনে নেওয়াটা মাইক্রোসফটের দিক থেকে অনেক সুবিধা এনে দিলেও টিকটকের জন্য তা হবে দুঃখজনক। বৈশ্বিক পণ্য হওয়ার ক্ষেত্রে এটি হবে তাদের জন্য অনেক বড়ো বাধা।