লিখেছেন সাদমান সাকিব
– ভোজন ঠিক সে মাসালাদার নাহি থা।
– আবে সালে ইয়ে দিল্লি নাহি হ্যায়।
ভারতের কোনো হোটেলে খেতে বসলে দিল্লিবাসী দুজন ব্যক্তির এমন কথোপকথন শুনতে পারাটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। কারণ দিল্লির অধিবাসীরা খাবারে মসলার ব্যবহারে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।
দিল্লিবাসীরা অনেক আগে থেকেই খাবারে মসলা বেশি ব্যবহার করে। এটা তাদের ঐতিহ্য, গর্বের জায়গা। ভুল করেও যদি কোনো দিল্লিবাসী খাবারে মসলা বেশি হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে, তার অপমানিত হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। সে আদতেই দিল্লির অধিবাসী কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে। কারণ এটা ধরেই নেওয়া হয়, দিল্লিবাসী মানেই সে অন্য সবার চাইতে বেশি মসলাসহকারে খেতে অভ্যস্ত। খাবারে মসলা বেশি নিয়ে অভিযোগ তুলবে অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ, দিল্লির মানুষ কেন তুলবে? এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় যে মসলার বাজার, তা ভারতের দিল্লিতেই।
পুরান ঢাকার রাস্তায় আপনি যখন হেঁটে যাবেন, তখন কাচ্চি কিংবা বিরানির সুগন্ধে আপনার নাক ম–ম করবে। সেই ধোঁয়া ওঠা গরম কাচ্চির ডাক উপেক্ষা করতে যে কী পরিমাণ মানসিক শক্তির দরকার, তা এক গবেষণার বিষয়। টিউশনি কিংবা মাসশেষে অফিস থেকে বেতনটা পেলে বন্ধুবান্ধবসহ গিয়ে এক বেলা খেয়ে এসে সেই অতৃপ্তি মেটাতে হয়।
দিল্লির খাড়ি বাওলি রোড দিয়ে যখন আপনি হেঁটে যাবেন, তখন আপনার নাকে হরেক রকমের মসলার সুবাস লাগবে। আপনি মসলার সুগন্ধে একটি বড় করে শ্বাস নেবেন। ব্যস্ততা না থাকলে হয়তো কোনো এক মসলার দোকানে গিয়ে দারুচিনির ভাঙা টুকরো মুখে নিয়ে চিবাতে চিবাতে মসলার দাম জিজ্ঞেস করবেন।
পুরান ঢাকার ধোঁয়া ওঠা কাচ্চির সুঘ্রাণ আপনাকে যেভাবে টানবে, দিল্লির খাড়ি বাওলির রাস্তার পাশের মসলার দোকানগুলোর ঘ্রাণও আপনাকে ঠিক সেভাবেই টানবে।
সতের শতকের দিকে পিছিয়ে যাই। ভারতবর্ষ তখন শাসন করে মোঘল সুলতানেরা। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আস্তে আস্তে আসা শুরু করেছে। সম্রাট শাহজাহানের পাঁচ বিবির মধ্যে একজন ফতেহপুরি বেগম। তিনিই ফতেহপুর মসজিদ নির্মাণ করালেন। আর এই মসজিদের কাছেই গড়ে উঠলো এশিয়ার বৃহত্তম মসলার বাজার। খাড়ি বাওলি মসলা বাজারের শুরুর গল্পটা এরকমই।
দিল্লির যে অংশে গড়ে উঠলো বিখ্যাত মসলার বাজার, সেই অংশে পানির প্রচন্ড অভাব ছিল। শের শাহর পুত্র ইসলাম শাহ্ ১৫৫১ সালে ওই এলাকার অধিবাসীদের সুবিধার্থে একটি কুয়ো বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কুয়োর পানি ছিল লবণাক্ত। খাড়ি শব্দের অর্থ লবণাক্ত, আর বাওলি শব্দের অর্থ কুয়ো। সেই লবণাক্ত কুয়োর জন্য স্থানটির নাম হয়ে যায় ‘খাড়ি বাওলি’। সেই থেকে এখনও সেই নামই বহাল আছে জায়গাটির।
তবে যে লবণাক্ত পানির কুয়োর জন্য জায়গাটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘খাড়ি বাওলি’, সেই কুয়োটির এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। সেই কুয়ো এখন শুধু ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া যায়।
খাড়ি বাওলি বাজারের মসলার দোকানগুলো যেন আস্ত ইতিহাসের খনি। চারশো বছরে ভারতবর্ষে কত ঘটনাই না ঘটেছে! বাজার শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক দোকান এখনও নাম পরিবর্তন করেনি। চারশো বছর আগে যে নামে চলতো, সে নাম এখনও বহাল আছে। ‘চাওয়াল ওয়ালে তেরাহা’, ‘পান্দ্রা নাম্বার কি দুকান’ এরকম নামের অনেক দোকান আপনি এখনও দেখতে পাবেন সেখানে।
পুরো ভারতবর্ষে যত ধরনের মসলা পাওয়া যায় তার সবই পাবেন এ বাজারে। অনেক মসলা আছে যেগুলো ভারতে উৎপাদিত হয় না, সেগুলোও পাবেন। আফগানিস্তান, নেপাল থেকেও এখানে মসলার চালান আসে। কিছু দুর্লভ মসলা আছে, যেগুলো বহু খুঁজেও পাওয়া যায় না। খাড়ি বাওলিতে নিশ্চিতভাবেই আপনি সেগুলো পাবেন। অপরিশোধিত গোলাপি সৈন্ধব লবণ কিংবা আমচুর পাউডারের মতো জিনিসও এখানে অনায়াসে খুঁজে পাবেন।
খাড়ি বাওলির যে স্থায়ী দোকানগুলো দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলো বংশ পরম্পরায় চলছে যুগের পর যুগ ধরে। অনেক দোকানে নবম কিংবা দশম প্রজন্ম ব্যবসা করছে। পুরো ভারতে তরুণরা যখন ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটছে, তখন এখনকার ব্যবসায়ীদের ঐতিহ্য সম্পূর্ণ আলাদা। তারা তাদের সন্তানদের শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসার উত্তরাধিকারী হিসেবে গড়ে তোলাতেই সন্তুষ্ট থাকছে।
আপনি যদি চা-প্রেমী হন, তবে আপনার অবশ্যই একবার খাড়ি বাওলির ‘মেহের চাঁদ এন্ড সন্স’ এর দোকানে ঘুরে আসা উচিত। একশো বছরেরও পুরোনো এই দোকান মশলার এক বিশাল আধার। সবচেয়ে ভালো মানের মসলা এখানে পাবেন আপনি। তবে মসলার সুখ্যাতি ছাপিয়ে যে জিনিসটির কারণে দোকানটি বিখ্যাত হয়ে উঠেছে, তা হলো এর নামকরা ‘মাসালা চা’। এর দুর্দান্ত স্বাদ একে কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে গেছে। দিল্লিতে কোনো গৃহিণী স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি স্বাদের চা বানালেই বাড়ির কর্তা বলে ওঠেন, “আরে ইয়ে চা তো মেহের কি চা জায়সি হো গায়ি হ্যায়!“
খাড়ি বাওলি নিছকই একটি ঐতিহাসিক বাজার– এমনটা ভেবে থাকলে ভুল করবেন। দিল্লিতে যারা বেড়াতে আসেন, তারা একবার হলেও ঘুরে যান এই বাজারটিতে। নানা রঙের, নানা গন্ধের মসলা পর্যটকদের আকর্ষণ করে নিমিষেই।
আলোকচিত্রীদের জন্য পুরাতন দিল্লির এই বাজার একটি আদর্শ জায়গা। নানা রঙের মসলার মাঝে মানুষের কর্মব্যস্ততার নিখুঁত আলোকচিত্র তোলার সুযোগ রয়েছে এখানে। আর খাড়ি বাওলির রাস্তার পাশের বহুতল ভবনের ছাদে গেলে পুরো বাজারের দৃশ্য আপনার দৃষ্টিগোচর হবে।
খাড়ি বাওলিতে শুধু মসলা পাওয়া পাওয়া যায় না। নানা রকমের শুকনো ফল, শুকনো মরিচ, ভেষজ গুণসম্পন্ন মসলা, বিভিন্ন জাতের চাল পাওয়া যায়। দিওয়ালির সময় মানুষ বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার বানানোর জন্য মানুষ এখান থেকে শুকনো ফল কিনে নিয়ে যায়। ‘রিথা’ নামের একটি ভেষজ ফল পাওয়া যায় এই বিখ্যাত বাজারে। এই রিথা ‘শিকাকাই’ নামের আরেকটি ভেষজের সাথে মিশিয়ে তৈরি করা হয় চুল পরার বিরুদ্ধে পৃথিবীর সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ।
বাজারের বিশালতা, যানবাহন চলাচলের জায়গার স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও খাড়ি বাওলিতে কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা বা অনিয়ম হয় না। ব্যবসায়ীরা মসলা সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় বসে থাকেন। প্রতিদিন সকালে খারি বাওলির পুরোনো রাস্তাগুলোতে প্রাণ ফিরে আসে।
১৯৩০ সালে পাঞ্জাবে একটি আইনের কারণে অনেক ব্যবসায়ীর ব্যবসা ভেঙে পড়ে। ব্যবসা হারিয়ে দিল্লিতে চলে আসে। পরে তারা আবার কিছু পুঁজি সংগ্রহ করে পুরাতন দিল্লির বাজারগুলো বিশেষ করে খাড়ি বাওলিতে ব্যবসা শুরু করে। তাই খাড়ি বাওলিতে প্রচুর পাঠান ব্যবসায়ীর দেখা পাওয়া যায়।
খাড়ি বাওলি আগে যেরকম প্রশস্ত ছিল, এখন আর সেরকম নেই। রাস্তার পাশের অস্থায়ী দোকানগুলো এখন এক মিটারের বেশি জায়গা পায় না। আগে বাজারের পাশে একটি আস্তাবল ছিল, সেখানে এখন বিশাল ভবন হয়েছে। তবে এত পরিবর্তনের মাঝেও খারি বাওলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ম্লান হয়নি মোটেও। খাড়ি বাওলি তার শৌর্য-বীর্য ধরে রেখেছে আগের মতোই। আগের মতোই কর্মচাঞ্চল্য আছে জায়গাটিতে। আগের মতোই পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা আসে, কেনাকাটা করে, চলে যায়। পর্যটকরা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে মসলার দিকে। পথচারীদের নাক ভরে ওঠে মসলার সুঘ্রাণে। অনেক দোকানদার আপনাকে মসলা কেনার সময় মসলার উৎপত্তিস্থল, কীভাবে আনা হলো, কীভাবে চাষ করা হয় সব বলে দেবে।
খাড়ি বাওলির পুরোনো রাস্তাগুলোতে হাঁটতে হাঁটতে মসলার ঘ্রাণের সাথে ইতিহাসের ঘ্রাণও যেন শুঁকতে পারবেন আপনি!