পুলিশের গুলিতে নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদের ল্যাপটপ, ক্যামেরা এবং হার্ডডিস্কসহ বেশকিছু আলামত মামলার তদন্তের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সিনহা মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের মামলায় গাড়িতে থাকা সিনহার ল্যাপটপ ও ক্যামেরার কথা উল্লেখ করা হয়নি। এসব বিষয়ে রোববার দিনভর ঝড় উঠেছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখানে ডকুমেন্টারি তৈরির অংশ হিসেবে সিনহা দীর্ঘদিন ধরে টেকনাফ এলাকায় ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত স্বজনদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয় বলে দাবি করা হয়।
এমনকি যেদিন রাতে খুন হয়েছিলেন সেদিন বিকালে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সাক্ষাৎকার নেয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। সাক্ষাৎকারের বিষয়টি প্রদীপের জন্য ছিল বিপজ্জনক। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছে তদন্ত সংস্থা র্যাব।
এদিকে মাদক, অস্ত্র এবং পুলিশের কাজে বাধা দান সংক্রান্ত বিষয়ে পুলিশ বাদী হয়ে সিনহার সহযোগী সিফাত এবং শিপ্রার বিরুদ্ধে যে দুটি মামলা করেছে সেগুলোর তদন্ত করতে চায় র্যাব। পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সিনহা এবং সিফাতের বিরুদ্ধে পুলিশ যে মামলা করেছে সেটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে র্যাব।
কারণ, একই ঘটনায় (হত্যাকাণ্ডসংক্রান্ত) দুটি মামলা হয়েছে। একটি করেছে পুলিশ, অপরটি সিনহার বোন। তাই র্যাব চায় পুলিশের করা মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হোক। অপরদিকে সিনহার বোনের করা মামলাটির তদন্ত চলুক। র্যাব জানিয়েছে, এ মামলাটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হলেন সিফাত।
তিনি জামিন পাওয়ার পরপরই র্যাব তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। রোববার তার জামিন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তার জামিনের সঙ্গে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের একটি বিষয় জড়িত আছে। রোববার সিফাতের জামিন না হওয়ায় কারাবন্দি প্রদীপসহ কোনো আসামিকেই এদিন রিমান্ডে নেয়া হয়নি।
আজ অন্তত তিন আসামিকে র্যাব হেফাজতে রিমান্ডে নেয়ার সম্ভাবনা আছে। পর্যায়ক্রমে কারাবন্দি ৭ আসামিকেই রিমান্ডে নেয়া হবে।
অপরদিকে সিনহা হত্যার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন রোববার জমা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনটি গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছে সিনহার শরীর। এদিন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন সিনহার অপর সহকারী শিপ্রা দেবনাথ। সিফাতের বিষয়ে আজ সিদ্ধান্ত দেবেন আদালত।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, তদন্তে সিফাত র্যাবের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। এ কারণে আদালতে তার জামিন এবং পুলিশের দায়েরকৃত দুটি মামলার তদন্ত চাওয়া হয়েছে।
আদালতের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর আগামীকাল (আজ সোমবার) প্রদীপদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তবে আসামিদের নাম-ঠিকানা যাচাইয়ের অংশ হিসেবে সোমবার দ্বিতীয়দিনের মতো চার আসমিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা হলেন- কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়া।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পুলিশের দায়েরকৃত মামলার তদন্তভার র্যাবে আসার পর দেখা হবে সেখানে কোন ধরনের আলামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা আদালতের মাধ্যমে পুলিশের কাছে সিনহার ল্যাপটপ, হার্ডডিস্ক, ক্যামেরা এবং অন্যান্য আলামত চাইব। যদি সেগুলো সিজার লিস্টে না থাকে তাহলে সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চালাবে র্যাব।
তিনি বলেন, নিহত হওয়ার আগে সিনহা কার কার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সে বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তা খতিয়ে দেখছেন।
তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে এখনই বিস্তারিত বলা যাবে না। তাছাড়া সিফাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই এ বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। সিফাত জামিন না পাওয়ায় আমরা এখনও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিনি।
এক প্রশ্নের উত্তরে লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, এখনও আমরা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। সোমবার তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আশপাশের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে একজন খলনায়কের জড়িত থাকার যে অভিযোগ এসেছে সেটিও তদন্ত কর্মকর্তা খতিয়ে দেখছেন।
৩১ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা রাশেদ খান।
এ ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন ও নিরাপত্তা বিভাগ।
একইভাবে তদন্তের স্বার্থে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলিসহ ১৬ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে সিনহা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করে। পরে ৫ আগস্ট বুধবার কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস।
এ মামলায় ৭ জন আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তিন দফা শুনানি শেষে তাদের সবার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আসামিরা হচ্ছেন- টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, গুলিবর্ষণকারী ইন্সপেক্টর লিয়াকত, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়া।
মামলার অপর দুই আসামি এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফার নামে জেলায় কোনো পুলিশের সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে র্যাব ও পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
ময়নাতদন্ত : কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পুলিশের কাছে জমা দিয়েছেন কক্সবাজার সিভিল সার্জন। শুক্রবার কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আরএমওর মাধ্যমে সিভিল সার্জন এ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পুলিশ সুপার বরাবরে জমা দেন বলে জানা গেছে। পাশাপাশি সেটি জমা হয় সংশ্লিষ্ট আদালতের নথিতেও। এ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সংগ্রহ করেছে তদন্তকারী সংস্থা র্যাবও।
সূত্রমতে, ময়নাতদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা চিকিৎসকদের বর্ণনা অনুযায়ী মেজর সিনহার শরীরে ৩টি গুলি করা হয়েছে। প্রথম গুলিটি সিনহার বাম হাতের বাহুতে লেগে ছিদ্র হয়ে বেরিয়ে যায়। পরের গুলিটি বাম কাঁধের নিচ দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
দুই গুলির জন্য সামনে ও পেছনের অংশে দুটি ক্ষত তৈরি হয়। শেষের গুলি, বুকের বাম পাশে এক জায়গা দিয়ে ঢুকে পিঠে ক্ষত তৈরি করে বেরিয়ে যায়। এ গুলি বুকের পাঁজরের হাড় ভেঙে ঢুকে, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস ভেদ করে বেরিয়ে যায়। খুব কাছ থেকেই সব গুলি ছোড়া হয়েছে বলে ধারণা ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের।
এছাড়াও সিনহার গলায় কিছু দাগ সংবলিত হালকা ক্ষতের চিহ্ন মিলেছে। তবে সেটা গুলির চিহ্ন নয় বলে নিশ্চিত করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ তিনটি গুলির ৬টি ক্ষতের কথা উল্লেখ আছে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে। কক্সবাজার মেডিকেল থেকে এ রিপোর্ট তদন্তকারী সংস্থা র্যাবও সংগ্রহ করেছে বলে জানা গেছে।
৭ জুলাই কক্সবাজার সদর হাসপাতালের রেসিডেন্সিয়াল মেডিকেল অফিসার (আরএমও) শাহীন আবদুর রহমান ময়নাতদন্ত শেষে প্রতিবেদনটি সিভিল সার্জনের মাধ্যমে পুলিশ সুপার বরাবর পাঠান। আরএমও শাহীন আবদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যু হয়েছে।
তাছাড়া তাকে হাসপাতালের পৌঁছানোর আগেই তিনি মারা যান বলে জানান আরএমও।
শিপ্রা মুক্ত : মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের সহযোগী শিপ্রা দেবনাথ জামিন পেয়ে কারামুক্ত হয়েছেন।
রোববার বেলা ৩টা ১০ মিনিটে তিনি কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসেন। জেল সুপার মোকাম্মেল হোসেন এ তথ্য যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন। শিপ্রার বিরুদ্ধে করা মাদক মামলায় রোববার শিপ্রার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ১-এর বিচারক দেলোয়ার হোসেন।
শিপ্রার পক্ষে আদালতে শুনানি করেন কক্সবাজারের সিনিয়র আইনজীবী অরূপ বড়ুয়া তপু। শিপ্রা দেবনাথের বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুর থানা এলাকায় এবং তিনি ঢাকার স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। সে সুবাদে মা-বাবা নিয়ে ঢাকার রামপুরা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকেন।
এছাড়া নিহত সিনহার আরেক সহযোগী সিফাতের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় করা মাদক ও অস্ত্র মামলার শুনানি হবে সোমবার। তিনি এখন কক্সবাজার জেলা কারাগারেই আছেন। সিফাতের আইনজীবী মাহাবুব আলম টিপু জানান, রোববার সকালে সিফাতে জামিন আবেদন করা হয় আদালতে। আদালত সোমবার জামিন শুনানির দিন রেখেছেন।