৩৬ বছরের রাশেদ খান (সিনহা), মেজর ( অবঃ) ছিলেন বাংলাদেশের জন্য এক জলজ্যান্ত হুমকি। তিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠছিলেন যুবসমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ!২০১৮ সালে মানে ২ বছর আগেই সকল রীতিনীতি মেনে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন তিনি মাত্র ৩৪ বছর বয়সে!
আরে ব্যাটা, বাঙালির জীবনের একটাই লক্ষ্য, একটাই মোক্ষ, একটাই উদ্দেশ্য- সেটা হচ্ছে চাকরি! তাও আবার সরকারি উর্দি পড়া চাকরি, তাও আবার ঝকঝকে ক্যারিয়ারে অতি অল্প সময়ে তরতর করে প্রোমোশন পেয়ে, অনেক ট্রেনিং-এ সেনাবাহিনীর সেরাদের তালিকায় স্থান পাওয়া লোক কেন চাকরি ছেড়ে দিবে?
কেন ? কেন ? কেন?
কারণ আমার বন্ধু সিনহা চেয়েছিলেন জীবনের রূপ-রস-গন্ধ কিছুটা নিজের মত করে উপভোগ করতে। চাকরি, পরিবার, সমাজ এই সকল বাধার বাহিরেও নিজের প্রজ্ঞা ও জ্ঞানে বুঝতে পেরেছিলেন যে জীবন এ সবের বাইরেও অনেক বিশাল ও মহান। সেই বিশালত্বের কিছুটা ছোঁয়ার পাগলামি পেয়ে বসেছিল তাকে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে, সেনাবাহিনীর নিশ্চিন্ত ক্যারিয়ার ছেড়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন, মূলত বিশ্ব ভ্রমণের জন্য, নিজের মত জীবনটা দেখার জন্য।
এটা কোন কথা? এমন সোনার হরিণ চাকরি কেউ ছাড়ে? এই লোক যুবসমাজের জন্য ক্ষতিকর না তো কে ক্ষতিকর? উনার উদাহরণ দেখে যদি আরও দশজন এভাবে খেয়ালখুশী মত নিজের জীবন কাটাতে চায়, তাহলে হবে? এই সমাজ সেটা মেনে নিবে? নিশ্চয়ই না! এমন স্বপ্ন দেখা চলবে না।
সিনহা বিয়ে করেন নি, সংসার গঠনের কোন পরিকল্পনা তাঁর ছিল না, ছিল না সন্তান জন্মদানের ইচ্ছা। কারণ তিনি নিজের মত, সত্যজিৎ রায়ের আগন্তকের মতই সারা ভুবন দেখে এক তুচ্ছ জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।সেই লক্ষ্যে নিজেকে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ভাবে নিজেকে প্রস্তত করছিলেন অনেক বছর ধরে।এমন ঠাণ্ডা মাথার সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার স্বপ্নবাজ লোক অবশ্যই আমাদের জন্য হুমকি।
এরা কেন এমন স্বপ্ন দেখবে? সেই স্বপ্নকে বাস্তবেও পরিণত করবে?
সিনহার সবচেয়ে বড় দোষ ছিল উনি ছিলেন স্বপ্নবাজ স্বাধীনচেতা।
এই তো, ক’মাস আগে আমরা নওগাঁ জেলের ধীবর দীঘি দেখতে গিয়েছিলাম, বাঙালির প্রথম স্বার্থক বিদ্রোহের প্রতীক দিব্যক স্তম্ভ দেখতে, যা দীঘির মাঝখানের অবস্থিত। এখানে আমি অনেক বার গিয়েছি, ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী যে কোন বন্ধুকে নিয়ে আরও অনেক বার যাব। যেয়েই নৌকা নিয়ে যেয়ে দীঘির মাঝের সেই হাজার বছরের পুরনো স্তম্ভ ছুঁয়েও আসি। কিন্তু সিনহাকেই দেখলাম প্রথমজন, যে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে শর্টস পরে সোজা দিঘিতে ঝাঁপিয়ে পরে একজন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কমান্ডোর মত একটানা সাঁতরে যেয়ে স্তম্ভকে ছুঁয়ে ফের ফিরে আসল। প্রথম ছবিতে দেখছেন। এটা দেখার জন্য সেদিন দীঘির চারপাশে ভিড় জমে গেছিল।
সিনহা আমাকে বা কাউকেই কোনদিন বলেন নি যে উনি একজন মেজর, বা অবসর নিয়েছেন সেনাবাহিনী থেকে। সবসময়ই বলতেন, ‘আমি একজন ফুর্তিবাজ মানুষ, জীবনে শুধু ফুর্তি করি’।
আর ছিলেন ভীষণ পড়ুয়া, নানা বিষয়ের কঠিন –সহজ সব ধরনের বই পড়তেন দিন রাত। চতুর্থ ছবিতে দেখছেন সিনহার সাথে যখন শেষ দেখা হয়, সেদিন সে আমাদের লাইব্রেরী থেকে শেষ বার ধার নেওয়া বইগুলো ফেরত দিতে এসেছিল। যে ৩/৪ মাস সে রাজশাহী ছিল, এমন বেশ কবার গাড়ি ভরে বই নিয়ে যেত পড়ার জন্য, এবং যত্ন করে ফেরতও দিত।
ভীষণ ফিটনেস ফ্রিক ছিল, দিনে একাধিকবার জিম করত, সাঁতরাতো, সবসময়ই সিক্স প্যাকের অধিকারী ছিল। কমান্ডো ট্রেনিং প্রাপ্ত একজন দুর্ধর্ষ মার্কসম্যানের মতই তাঁর লাইসেন্স করা রিভলভার নিজের দেহের একটা অংশের মতই বহন করতেন সবসময়ই, সকলের অগোচরে। কোনদিন সেটা নিয়ে শো অফ বা বাচ্চামি করতে দেখি নাই। তিনি অস্ত্রের গুরুত্ব জানতেন, সেটাকে সন্মানও করতেন।
এস এস এফ ( স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সে) ছিলেন বেশ ক’বছর। এসএসএফ এর সর্বকালের সেরা অফিসারদের মধ্যে একজন গন্য করা হয় তাকে। সুনামের সাথেই মনে দাগ কেটেছেন সবার, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও।
সেনাবাহিনীতে এডিসি, ব্রিগেড মেজরের মত প্রেস্টিজিয়াস পদে চাকরি করেছে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। মানবিক গুনাবলী আর নিঃস্বার্থ ভাবে সবাইকে সাহায্য করার মানসিকতার কারনে সৈনিক ও অফিসারদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। রিফ্লেক্স, ফিটনেস,ফায়ারিং সবকিছু মিলে ছিলেন সেরাদের সেরা।
কঠোর নিয়মকানুন যেমন মানতেন তেমন তাঁর নামে এক পয়সার দুর্নীতির অভিযোগও নেই। ( লাশের সাথে অবশ্য ইয়াবার প্যাকেট পাওয়া যাচ্ছে, যেটা আকছারই যাচ্ছে ইদানীং, যে কেউ মারা গেলেই)
আর সবার সাথে মিশে যেতে পারত সহজে। বর্তমান সেনাবাহিনীতে ব্যাচমেট, জুনিয়র এমনকি সিনিয়রদের মাঝে তাঁর ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার কথা, অনেকের মনে আইকন হয়ে ওঠার কথা তাঁর সহকর্মীরা বলুক, আমি বলব আশেপাশের নানা পেশার, নানা মানুষের সাথে কী অবলীলায় মিশে যেত পারত সে, সেই কথা। সেই কবে রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে ছিল, অথচ বর্ণালীর মোড়ে মালাই চা খেতে গেলেই দোকানি একগাল হেঁসে বলত, ‘মামা, বহু দিন পর আইলেন, বা টি বাঁধের বাদাম বিক্রেতা। আমার নানী আজকেও দুইবার জিজ্ঞাসা করলেন যে সিনহা কী আসলেই আর নেই,যে ছেলেটা তাকে প্রায়ই গাড়ি করে ডাব দিয়ে যেত।‘
আমি শেষের ছবিটা দেখি, লোনা জল বাঁধ ভেঙে বুকের সমস্ত কষ্ট উথলে বেরিয়ে আসে, আমার বন্ধু বিছানায় শুয়ে আছে, প্রাণহীন। আর কোন দিন সেই হাসি দিয়ে উঠে বসবে না । গত চার মাস ধরে কত কত ঘণ্টা এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে হাইকিঙের প্ল্যান, ল্যাতিন আমেরিকা যাবার প্ল্যান, ইউরোপের সকল দেশের প্রায় সকল শহর নিয়ে বলা কথাগুলো কাজে লাগলো না বন্ধুটার, সে শুয়েই রইল।
কেন শুয়ে রইল? কেন পুলিশের বুলেট তাঁর মত উচ্ছল, সদালাপী যুবকের হৃৎপিণ্ড থামিয়ে দিল? কী বিচার হবে? যাইই হোক এমন একজন মানুষের জীবনকে অপচয় করার জন্য যে কোন শাস্তিই যথেষ্ট নয়।
বনানীতে সমাহিত করা হয়েছে ডানপিটে স্বপ্নবাজ মানুষটাকে।
সবচেয়ে বড় দোষ বড় কথা সিনহা কেন স্বপ্ন দেখেছিল?
কেন সে সবার মত আটপৌরে জীবনযাপন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না?
সবার শেষে গাঢ় আঁধারের মত ঘোরে ডুবে যেতে যেতে এইটুকুই বিড়বিড় করি বার বার, ‘আই মিস মাই ফ্রেন্ড’।
(সংগ্রহীত এবং ইষৎ সংক্ষেপিত।)(Facebook:Shahab Uddin)