অফিসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের পাঠানো লেখা ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ বইটি পেয়ে বাসায় নিয়ে এলাম। বই আমার কাছে এক চমৎকার উপহার। মুজিববর্ষে অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। আমি অনেক বই খুলেও দেখিনি। মতলববাজ নব্য মুজিবভক্তের বই কখনো ভাগাড়ে ফেলি, কখনো কাউকে ধরিয়ে দিই। প্রকৃত লেখকের হলে পাঠে ডুবি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে এ মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ছোট ভাই। আমার দেখা ও পর্যবেক্ষণে সোজা সরল ভদ্রলোক মানুষ। জীবনের ৩৭ বছর তিনি প্রবাসে কাটিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (অনার্স) এমএ, এলএলবি করা মোমেনের বইয়ের ফ্ল্যাপে হার্ভার্ড ও বস্টনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার কথা লেখা আছে।
এমনকি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কখন কোথায় কীভাবে তার বর্ণনা নেই। থাকলে পাঠক হিসেবে বুঝতে পারতাম। আশা করব এটা জানাবেন। সিলেটের সম্ভ্রান্ত পরিবারের রতœগর্ভা মায়ের সন্তান মোমেনের এক বোন জাতীয় অধ্যাপক ড. শাহলা খাতুনের হাতে আমার ছেলে অন্তরের জন্ম হয়েছিল। তাদের পিতা অ্যাডভোকেট আবু আহমেদ আবদুল হাফিজ সিলেট জেলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আমরা জানি, জাঁদরেল সিএসপি অফিসার আবুল মাল আবদুল মুহিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। তিনি একজন মুক্তচিন্তার সুলেখক ও ভাষাসৈনিক। আমাকে স্নেহ করেন। আমিও তাঁকে শ্রদ্ধা করি। তাঁর এক ভগ্নিপতি রাবির সাবেক প্রোভিসি প্রফেসর আতফুল হাই শিবলী দাপুটে শিক্ষকই নন, ক্যাম্পাসে ছাত্র-ছাত্রীদের হৃদয়ে আসন পাতা শিক্ষক ছিলেন।
মুহিত সেনাশাসক এরশাদের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম গঠিত হলে প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। দলটি গণসম্পৃক্ত হতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনিও অনেকের সঙ্গে সরে যান। স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যু হলে ২০০১ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা তাঁকে সিলেট সদর আসনে প্রার্থী করলে বিএনপির সাইফুর রহমানের কাছে পরাজিত হলেও হাল ছাড়েননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকার ব্যালট বিপ্লবে সাইফুর রহমানকে হারিয়ে জয়ী হয়ে টানা দুবার শেখ হাসিনার সরকারের অর্থমন্ত্রী হন। ব্যাংক লুটেরা, শেয়ার লুটেরা, বিদেশে অর্থ পাচার রুখতে না পারলেও দেশের অর্থনীতি শক্তিশালীকরণে ভূমিকা রাখেন। তবে শেয়ার ও ব্যাংক লুটেরা রুখতে ব্যর্থতার কারণ নিয়ে তাঁর সরল বক্তব্য সংসদের প্রসিডিংসে রাখলেও আর্থিক খাতে সংস্কার করে যেতে পারেননি। একজন সৎ নির্লোভ মানুষ হলেও কিছু আত্মীয় ও কর্মী নাম ভাঙিয়েছেন। স্বাধীনতা পদক কমিটির প্রধান হিসেবে নিজে স্বাধীনতা পদক নিয়ে আমাদের গর্বিত যেমন করেছেন তেমনি সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের গুণমুগ্ধ ভক্ত ও বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব নিখোঁজ হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ করুণাশ্রয়ী একজনকে এ পদক দিয়ে লজ্জিত করেছেন। অথচ অনেক জীবিত মৃত স্বাধীনতাসংগ্রামীর কপালে এ পদক না জুটলেও ইতিহাস তাঁদের অমরত্ব দিয়েছে।
যাক, এ কে এ মোমেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন ছয় বছর। ২০১৫ সালে শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশে ফেরেন। মুহিত অবসরে গেলে সর্বশেষ সিলেট সদরে মোমেনকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করেন। বিজয়ী হয়ে এ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অনেক বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক হলেও আমার খারাপ লাগেনি, কারণ তিনি না কূটনীতিক না রাজনীতিক। সোজা সরল কথাবার্তায় তিনি আর দশজন কূটনীতিক বা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো নাইবা হলেন! তিনি তো আলাদা। তাঁর কথাও আলাদাই হবে। এতে অবাক হওয়ার কী আছে। আমি একালের অনেক নেতা-মন্ত্রীর কথায় অবাক হই না। নিজেকে সেকেলে আর তাঁদের অনেক স্মার্ট চৌকস মনে হয়। আমার উচিত এই মন্ত্রীদের পাঠ করা।
কত দিন থেকে বলে আসছি অনলাইন নিউজপোর্টালের নিবন্ধন ঝুলিয়ে না রেখে দিয়ে দিতে। নতুবা গণমাধ্যম, সরকার, সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যে কেউ ভুঁইফোড় অনলাইন একজনে চালিয়ে যা খুশি গসিপ গুজব চরিত্রহননে গা ভাসাচ্ছে। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এখন আওয়ামী লীগের বড় নেতা। বড় নেতা হতে এখন বর্ণাঢ্য পোড় খাওয়া গণমুখী অতীত লাগে না। নেতা-মন্ত্রী বানিয়ে দিলেই কত মুখ চারদিকে ঘিরে রাখে, সেলফি তুলে, পেছনে হাঁটে। কেবল জনগণ দূরের আকাশে বাস করে। তাঁর বক্তব্য এ দেশের মিডিয়া ঠোঁট থেকে পড়তে দেয় না, লুফে নেয়। বাগ্মিতায় তিনি যদি শেখ হাসিনার অ্যাসেট হন, তাহলে রিজভী খালেদা জিয়ার সম্পদ। হাছান প্রথম দফায় ৪৪টি পোর্টালের তালিকা নিবন্ধনের জন্য প্রকাশ করেছেন। তালিকায় ঠাঁই পাওয়া নাম না জানা অনেক পোর্টাল তাঁর মন্ত্রণালয়ের বাছাইয়ে আসায় লা জবাব। রুচির দুর্ভিক্ষকালে আমার কোনো মন্তব্য নেই। বহু আগে বঙ্গভবনে সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেছিলেন, ৫০০ করে ছেড়ে দেবেন। ছাড়েননি তাঁরা। কেন ছাড়েননি তাঁরাই জানেন। একদা আমলারা ফাইল আটকে আনন্দ পেতেন, হয়তো এখন রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রীরাও পান। তবে ৪৪টির অনেকটিই কোন গলির কেউ জানে না। ফকিরাপুলের দৈনিক আর তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত অনেক পোর্টালের তালিকার কি মিল!
যাক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে এ মোমেনের ১৯৮ পৃষ্ঠার বইটিতে অনেক বিষয় উঠে এসেছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, ১৯৭১ স্মৃতিচারণামূলক লেখাটি প্রথমেই ঠাঁই পেয়েছে। আমি এ অংশটি পড়েই লেখার তাড়না অনুভব করি। তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় চমৎকার বর্ণনা করে গেছেন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রাম, গোটা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করে কীভাবে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আক্রমণে প্রতিরোধের আগুনে জ্বালিয়ে তোলা, স্বাধীনতার ডাকে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে টেনে নেওয়া। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদানকেও তিনি বড় করেই এনেছেন।
ইতিহাসের অনেক উপাদান আসায় লেখক এ কে এ মোমেন ও স্বাধীনতাকামী উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের কাছে কিছু প্রশ্ন রেখে দিলাম। ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে, ‘লেখক ইতিহাসের সাক্ষী নন, নিজেই ইতিহাস’। এখানেই প্রথম প্রশ্ন আসে এ কে এ মোমেন তখন কি ছাত্রলীগ করতেন? করলে অবশ্যই নেতৃত্বে থাকলে ইতিহাস। সেটা কীভাবে। তবে কি ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্ত দুই অংশের কোনো অংশের নেতা? হলে ইতিহাস কীভাবে। তিনি লিখেছেন মার্চ ’৭১-এর উত্তাল দিনে ছুটে যেতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উত্তাল অগ্নিঝরা আন্দোলন। মোমেন তখন কার সঙ্গে?
কিছুদিন আগে তাজ হাশমী নামে কানাডাপ্রবাসী এক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও হনুলুলো ইউনিভার্সিটির গবেষণা সহযোগী এ কে এ মোমেনকে লেখা এক খোলা চিঠি দিয়েছিলেন। সেখানে বলেছেন ষাটের দশকে তিনি ও মোমেন এনএসএফের ঢাবির দুই হলের নেতা ছিলেন। এ ছাত্র সংগঠনটি সামরিক একনায়ক আইয়ুব খান ও তাঁর দালাল মোনায়েম খানের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে পরিচিত ছিল। যার সন্ত্রাসী পাচপাত্তুদের ছাত্রলীগের সাহসী নেতারা প্রতিরোধ করেছিলেন। পরে সে খুন হয়।
তাজ হাশমী লিখেছেন, প্রিয় ড. মোমেন, আমি এ চিঠি লিখছি, গত ৩১ শে মে, ২০২০-এ ভারতীয় সাপ্তাহিক ‘দ্য উইকে’ প্রকাশিত আপনার একটি সাক্ষাৎকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, যা আমাদের পারস্পরিক বন্ধুমহল এবং দেশে-বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের কাছে ভিত্তিহীন, আপত্তিকর এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœকারী বলে মনে হয়েছে, যেটি রাষ্ট্রের প্রধান কূটনীতিক বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আপনি প্রতিনিধিত্ব করেন।
সঞ্চালক রবি ব্যানার্জির শেষ প্রশ্নের জবাব ছাড়া আপনার সাক্ষাৎকারের বিষয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। যেখানে আপনি, ‘মুজিবুর রহমানের সাথে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?’ এ প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, “আমি তার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানে (১৯৭০’এ) একটি গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে যাই (যারপর তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন)। আমি তার দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজের দেখাশোনা করতাম। স্বাধীনতার পর একজন জ্যেষ্ঠ আমলা হিসেবে আমি তার সাথে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি। আমি তাকে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হিসেবে আবিষ্কার করি।”
তাজ হাশমী লিখেছেন, আমি আপনাকে ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে চিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এনএসএফ)-এর একজন সহসদস্য ও অফিসধারণকারী একজন কর্মী হিসেবে। আমি জানি, ১৯৬৮ সালে ইসলামাবাদ যাওয়ার আগ পর্যন্ত, আপনি আইয়ুবপন্থি ছাত্র সংগঠন এনএসএফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের এসএম হল শাখার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমি এটাও জানি, সেই গোলটেবিল বৈঠকের সময়, শেখ মুজিবের আপনাকে ভ্রমণসঙ্গী করা দূরে থাক, আপনাকে চেনার পর্যন্ত কোনো কারণ নেই। সেই গোলটেবিল বৈঠক, যা কিনা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য দুই উইঙের রাজনৈতিক নেতাদের একত্র করতে আয়োজন করেছিলেন। যার জন্য শেখ মুজিব সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
যাই হোক, সেই গোলটেবিল বৈঠকটি ১৯৬৯-এর ১০-১৩ই মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং আপনি সঞ্চালক রবি ব্যানার্জির কাছে ভুল সাল উল্লেখ করেছেন। ১৯৬৯-এর পরিবর্তে আপনি ১৯৭০ সালকে গোলটেবিল বৈঠকের সাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন! মূলত আপনি তার ‘দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখাশোনা’ দূরে থাক, আপনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কখনোই ভ্রমণ করেননি। যেহেতু আপনি সঞ্চালকের কাছে মিথ্যা দাবি করেছেন, আপনি সম্ভবত তাই গোলটেবিল বৈঠকটির সঠিক সালটিও জানেন না। এবং আপনাকে জানিয়ে রাখি, মুজিব গোলটেবিল বৈঠকের পর গ্রেফতার হননি, তিনি ১৯৭১ সালের ২৫/২৬ মার্চ পাকবাহিনীর ক্র্যাক ডাউনের আগ মুহূর্তে জীবনে শেষবারের মতো গ্রেফতার হয়েছিলেন।
চিঠিতে তাজ হাশমী প্রশ্ন করেছেন, ‘দয়া করে আমাকে এই মর্মে একটি কারণ দেখান, কেন ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার মওদুদের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ উপদেষ্টা (যারা বিভিন্ন বিষয়ে তাকে পরামর্শ দিয়ে থাকতেন) থাকা সত্ত্বেও, সেই কনফারেন্সের সময় বঙ্গবন্ধু আপনাকে তার দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজ দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন? বরং সে সময় আপনি ইসলামাবাদে এমএ শেষবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। আর আপনি কখনোই আওয়ামীপন্থি ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন না, উলটো আপনি আওয়ামীবিরোধী এবং আইয়ুবপন্থি এনএসএফের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এনএসএফের সঙ্গে আপনার জড়িত হওয়ার জন্য আপনাকে আমি কোনো ধরনের দোষারোপ করছি না। কারণ, আমি নিজেও ১৯৬৯ সালে এনএসএফের জিন্নাহ হল (সূর্য সেন) শাখার প্রেসিডেন্ট ছিলাম। আসলে মানুষ তাদের কৈশোরের শেষ দিকে কিংবা যৌবনের প্রথম দিকে অনেক কিছু করে বসে বা অনেক গোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে, আবার দেখা যায়, জীবনের পরবর্তী অংশে তারা সেসব কিছুর সঙ্গে সম্পর্কছেদও করে। এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে। যাই হোক, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আপনাকে কিংবা অন্য কোনো ছাত্রনেতাকে ইসলামাবাদের গোলটেবিল বৈঠকে ডাকার কোনো কারণ ছিল না।
সাক্ষাৎকারে আপনি আরেকটি ভুল তথ্য দিয়েছেন, যা কারও মিথ্যাবাদী প্রবৃত্তির পরিচায়ক বলে প্রতীয়মান মনে হতে পারে। আপনি বলেছেন, “স্বাধীনতার পর একজন সিনিয়র আমলা হিসেবে আমি তার (শেখ মুজিবের) সাথে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি। আমি তাকে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হিসেবে আবিষ্কার করি।” বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ব্যাপারে আপনার এ মন্তব্য আমার কাছে তার প্রতি অবমাননাকর না হোক, অযাচিত বলে মনে হয়েছে।
তাজ হাশমী আরও লিখেছেন, ‘যা হোক, আপনি যেভাবে একটি ভিত্তিহীন তথ্য দিয়েছেন, যা কিনা মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর ছাড়া কিছুই না, তা আমার ধারণার বাইরে ছিল! অন্যভাবে বললে, আপনি দাবি করেছেন, স্বাধীনতার পর আপনি বঙ্গবন্ধুর সাথে ‘জ্যেষ্ঠ আমলা হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন’, যা অবাস্তব গালগল্প ছাড়া কিছুই না। প্রথমত, আপনি বঙ্গবন্ধুর না, বাংলাদেশের প্রশাসনের একটি অথবা কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাও কোনো ‘জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা’ হিসেবে (যেমনটি আপনি দাবি করেছেন) নয়, বরং অন্যতম কনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে, সে সময়কার বাংলাদেশ সরকারের (১৯৭৩-৭৫) মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর ব্যক্তিগত সহকারীর অধীনে একজন সেকশন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আপনি হয়তো জানেন, ’৬০-এর শেষ দিকে আর ’৭০-এর প্রথম দিকে, আমরা যারা আপনার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়ে উঠেছিলাম, আমরা জানি, আপনি কখনোই সিএসপি (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) অথবা পিএফএস (পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস) -এর কর্মকর্তা ছিলেন না বরং কিছুটা কম আকর্ষণীয় পাকিস্তান সরকারের সিএসএস (সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট সার্ভিস)-এর কর্মকর্তা ছিলেন। তাই, আপনার করা ১৯৭০-এর দশকে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হওয়ার মতো ধৃষ্টতাপূর্ণ দাবির কোনো মানে রাখে না।
আদতে আপনার সাক্ষাৎকার কিছু ভ্রান্ত আর মিথ্যা তথ্যের সমষ্টি ছাড়া কিছুই না। আমি শঙ্কিত, এগুলো আপনার অস্থির না-হোক, আত্মম্ভরী ও ভাববিলাসী চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। জনাব মোমেন, এভাবে লেখার জন্য আমি দুঃখিত কিন্তু একজন নির্ভুল, সত্য এবং সঠিক ইতিহাসের অনুসন্ধানী হিসেবে, আমি এজন্যই লিখছি, যাতে আপনি আপনার অসাবধানতার জন্য দেশবাসী ও আপনার প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চান। সত্যের স্বার্থে আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত। কারণ, দিন শেষে সবকিছু ছাপিয়ে, সত্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।’
হাশমী আরও লিখেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুকে মহিমান্বিত করার জন্য কারও সত্যের বরখেলাপ করার প্রয়োজন নেই। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। এবং কারও একই সঙ্গে নিজের নায়ক আর নিজেকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করা উচিত নয়। এমনকি সত্য হলেও, প্রত্যেকের নিজের স্তুতি আওড়ানো থেকে বিরত হওয়া উচিত। সংজ্ঞাতীতভাবে প্রমাণ ছাড়া কারও এ ধরনের কিছু করা সমীচীন নয়। আপনার জানা উচিত, আপনার বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীর অধিকাংশই, এ আইটি বিপ্লব-পরবর্তী যুগে, মিডিয়া বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত। একজন পুরনো বন্ধু হিসেবে আপনাকে একটি অপৃষ্ট উপদেশ দিতে চাই- এমন কিছু করবেন না যাতে বাংলাদেশের প্রধান কূটনীতিক হিসেবে আপনার অবস্থান দুর্বল হয় বা আপনার প্রতিনিধিত্ব করা সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়।’
তাজ হাশমী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কিছু বিতর্কিত মন্তব্যেরও উল্লেখ করে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি সব শেষে মোমেনকে লিখেছেন, ‘আপনার একজন শুভানুধ্যায়ী হিসেবে আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সত্য-মিথ্যা, শালীন-অশালীন, বাস্তবতা আর কল্পনার মধ্যকার পার্থক্যটা সরু কিন্তু স্পষ্টত দৃশ্যমান। এটি কারও আসল চুল আর সব থেকে দামি পরচুলার পার্থক্যের মতোই স্পষ্ট, যা দিয়ে কেউ তার বাস্তবতা লুকিয়ে রাখতে চায়!’
যাক, আমি এ বিষয়ে প্রিয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য আশা করছি, কারণ সত্য মানুষকে আলোর পথে টানে আর মিথ্যা বিভ্রান্তি বিকৃতির অন্ধকারে নিয়ে যায়। তাজ হাশমী সত্য বলেছেন? আপনার বক্তব্য কী মিস্টার পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এ কে এ মোমেন তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘১৯৬৯ সালে তিনি ইসলামাবাদ ইউনিভার্সিটির ছাত্র। তাঁর ভাই আবুল মাল আবদুল মুহিত আইয়ুব খানের কেবিনেট বিভাগের উপসচিব। তিনি বঙ্গবন্ধুর গোলটেবিল বৈঠকের সফরসঙ্গী দাবি করেননি। তবে তিনি জড়িয়ে যাওয়ার দীর্ঘ বর্ণনা করেছেন। আমিত্বের রেশটা ভালোই তুলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাকসুর নেতৃত্বে ছাত্র গণআন্দোলনের এবং তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের অগ্নিগর্ভ ইতিহাসের বর্ণনা নেই, আছে রাওয়ালপিন্ডিতে তাঁদের বীরত্বের কথা। আমরা যদিও জানি আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে প্যারোলে না যাওয়ার পক্ষে অনেকে এবং বেগম মুজিব অনড় সেখানে মোমেন লিখেছেন, মুহিত সাব তাকে জানান প্যারোলে যোগদান করতে রাজি না হলে মামলা বাতিল করেই মুক্ত মুজিবকে গোলটেবিল বৈঠকে যেতে দেবে। খবরটি ত্বরিত গতিতে নাকি মোমেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের জানান। এটা কি সত্য, এ জবাব শেখ হাসিনা ও তোফায়েল আহমেদই বলতে পারবেন।
মোমেন লিখেছেন, রাওয়ালপিন্ডি ছোট্ট এয়ারপোর্টে বঙ্গবন্ধু আসবেন শুনেই তারা সেখানে একটি ব্যানার টানান। যেখানে ‘বঙ্গ শার্দূল’ শেখ মুজিব লেখা ছিল। তখনো তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়নি। রাওয়ালপিন্ডির বৈঠক থেকে ফেরার পর তাঁকে রেসকোর্স ময়দানে এ উপাধি দেওয়া হয়! এ কে এ মোমেনের এ মিথ্যাচারে আমি বিস্মিতই নই, লজ্জিত। আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গবেষক দাবিদার, বিশ্ববিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো এ কে এ মোমেন এ ইতিহাসটাও জানেন না যে গণঅভ্যুত্থানের আগুনে পুড়ে সামরিক শাসক আইয়ুব খান ’৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন! আর গোলটেবিলে যাওয়ার আগেই ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানের সংবর্ধনা সভায় তোফায়েল আহমেদ ১০ লাখ সমবেত ছাত্রজনতার আবেগঘন উল্লাসে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন। এটা নিয়ে কখনো তো মিথ্যাচার হয়নি!
ষাটের দশকে ঢাকা কলেজ ও মহানগর ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক সংগঠনের প্রকাশনায় এক লেখায় বঙ্গশার্দূল, বঙ্গবন্ধু উপাধি দিলেও প্রচার পায়নি। ভারতবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামী চিত্তরঞ্জন দাশকে দেশবন্ধু উপাধি দেয়। সেদিন তোফায়েলকে নিয়ে ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতারা এর সঙ্গে মিলিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি চূড়ান্ত করেন। সেই থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হন।
মোমেন আরও লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুকে গোলটেবিল বৈঠকে নিয়ে যাওয়া উড়োজাহাজ যখন রাওয়ালপিন্ডির ছোট্ট এয়ারপোর্টে নামল, তখন হাজার হাজার জনতার ঢল। বঙ্গবন্ধুকে কার্গো দরজা দিয়ে বের করে নেওয়া হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরীকে জনতা বঙ্গবন্ধু ভেবে কাঁধে তুলে অগ্রসর হয়। অথচ, মিজান চৌধুরী সফরসঙ্গী হয়েই যাননি। জনতা সেখানকার এক নেতাকে নিয়েছিল। মোমেন আরও বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ঢাকা ফিরে আসার পর মুহিত সাবরা ছয় দফাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করে দাঁড় করানো যায় সেটি নিয়ে কাজ করেন। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় দফা গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে লাহোর গেলে মুহিত সাহেব ৮১ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট তাঁকে দিয়ে পাঠান গোপনে ড. কামাল বা ব্যারিস্টার মওদুদের হাতে দিতে। তিনি সেটি পালন করেন। মুহিত সাব নাকি আরও বলে দেন বঙ্গবন্ধু যেন ছয় দফা ছাড় না দেন। প্রশাসনিকভাবে এটা অর্জন সম্ভব। আর অনড় থাকলে আইয়ুবকে সরিয়ে মার্শাল ল জারি হবে। যা হয়েছিল এবং ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হন। এখন কথা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু ’৬৬ সালেই ছয় দফা দিয়ে যেখানে পুস্তিকাকারে বিলি করেন, দেশ সফর করে জনমত গড়েন, জেল খাটেন এবং তাঁর অবস্থান অনড় রাখেন, সেখানে আবুল মাল আবদুল মুহিতদের আদৌ কোনো ভূমিকা ছিল কিনা সেটি ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ভালো বলতে পারবেন।
একটা গল্প বলি, কবিতার রাজপুত্র শামসুর রাহমান অনেকবার সুনামগঞ্জ গেছেন। একবার তরুণ কবিরা তাঁকে নিয়ে সুধীজন সমাবেশ করল। আমিও তাদের সঙ্গে। একজন আইনজীবী কবিদের খবর রাখতেন না। সবাই যখন আলোচনায় কবিকেই বড় করে মেলে ধরছেন তখন সেই আইনজীবী বললেন, শামসুর রাহমান দৈনিক বাংলার স্বনামধন্য সম্পাদক, এইমাত্র জানতে পারলাম তিনি একজন কবিও। তেমনি আমিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে এ মোমেনের বই পড়ে জানতে পারলাম তিনি ইতিহাসের সাক্ষীই নন, তিনি নিজেই ইতিহাস!
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।