লিখেছেন আরিফ জেবতিক
আপনি উচ্চস্তরের লেখালেখি করেন, সেটি বুঝার মতো মানুষ কম থাকবে। তারপর আপনি যত সহজ বিষয়ে, যত সহজ করে লিখবেন ততোই সেটি বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবে। ‘রিডেবিলিটি’ বা পাঠযোগ্যতায় জনসাধারণের জন্য লিখতে হলে আপনাকে ক্লাস এইট স্ট্যান্ডার্ড ধরে লিখতে হবে। অধিকাংশ মানুষ এই স্তরের। সুতরাং যখন আপনি পপুলারিটির জন্য লিখবেন তখন বাক্যের দৈর্ঘ্য হবে ছোট, বাক্য গঠন হবে সরল, যুক্তাক্ষর দেয়া শব্দ যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করবেন। ( তুমুল জনপ্রিয় লেখকদের লেখায় দেখবেন এই ফর্মুলা ব্যবহার করা হয়। এমনকি ১৪ ফন্ট দিয়ে বড়বড় করে লেখা হয়, লাইনস্পেস দেয়া হয় ১৩। এটা যে বইয়ের কলেবর বাড়াতেই শুধু করা হয় তা কিন্তু নয়, রিডেবিলিটি বা পাঠযোগ্যতাও এখানে বড় ব্যাপার। )
হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘জনপ্রিয়তা নিচে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি।’ অন্যভাবে দেখলে, আপনি যত নিচের স্তরে নামবেন, পিরামিডের সেই লেভেলে বেশি মানুষ। আর বেশি মানুষ মানেই বেশি জনপ্রিয় হওয়ার সুযোগ। আমি কয়েক বছর আগে থেকেই বলি (নিজের বুদ্ধিতে বলি না, অন্যদের দেখে বলি) যে অনলাইন ব্যবহার বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে ভিডিও কনটেন্ট। এর কারণ আছে। কারণ এটি রিডেবিলিটিরও নিচের স্তর। বিন্দুমাত্র পড়াশোনা না জানা মানুষটিও এখানে কানেক্ট করতে পারে। আর পড়াশোনা না জানা মানুষের সংখ্যাই বেশি, অর্থাৎ ভিডিও কনটেন্ট নিয়ে আপনি একেবারে বৃহত্তম স্তর পর্যন্ত কানেক্ট করতে পারছেন।
এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এই জনপ্রিয়তার জন্য একেবারে নিচের স্তরে নামা যাওয়ার এই প্রবণতাকে আমরা কতটুকু প্রমোট করব! এটি সাসটেইনেবল কী না।
একটা একটা করে বলি। জনপ্রিয়তার সবচাইতে সহজ দুটো উপাদান হচ্ছে রসিকতা এবং সেক্স। এই দুটোর বিক্রি সবচাইতে বেশি, চাহিদা সবচাইতে বেশি।
এখন একেবারে পিরামিডের নিচের স্তরে যাওয়ার প্রথম প্রয়াস নেয় বাংলা সিনেমা। এরা জাস্ট স্ক্রিপ্ট ছাড়া, গল্প ছাড়া, পরিচালনার কোনো ব্যাকরণ না মেনে এই পিরামিডের নিচের স্তরকে সরাসরি টার্গেট করে। বাজারে এলো মুনমুন-ময়ূরী। দুটো আইটেম গান এবং দিলদারের ভাঁড়ামো। পিরামিডের নিচের স্তরকে সহজেই সুখ দেয়া গেল- জনপ্রিয়তার টিকমার্ক অর্জিত হলো। কিন্তু এতে করে আমাদের সিনেমা শিল্প শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, দেখেন।
তারপর আসেন যাত্রাশিল্প। সিনেমার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে যাত্রায় এলো প্রিন্সেসের নাচ। একসময় যে যাত্রাপালা পরিবারের সবাই মিলে দেখত, সেই যাত্রা হয়ে গেল কিছু জুয়াড়ি মাতালতের উন্মত্ততার আসর। একের পর এক প্রিন্সেসের উলঙ্গ নৃত্য। হ্যাঁ, সেক্সের কারণে বিক্রি বাড়ল, জনপ্রিয়তাও বাড়ল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাত্রাশিল্প টিকে থাকতে পারল কী?
টিভির বাংলা নাটক দেখাটা একসময় একটা ছোটগল্প পড়ার মতোই আনন্দ দিত। সেই টিভিতে সেক্স আনা না গেলেও ‘রিডেবিলিটি’র চৌদ্দগুষ্টি আনা হলো। একেবারে নিচের স্তরের দর্শক ধরতে গিয়ে এতো এতো ফালতু ভাঁড়ামো নাটকের তুফান ছুটেছে যে কালেভদ্রে যে কয়টি ভালো নাটক হয়েছেও, তা কেউ আর মনেই রাখতে পারে না।
হুজুররাও ফর্মুলা বুঝে গেলেন। ওয়াজ মাহফিলে হিন্দি আইটেম সংয়ের প্যারোডি দিয়ে লোক টানা শুরু হলো। হুজুরকে কন্ট্রাক্টই করা হয়, ‘ফাডাইয়া দিতে হবে’ বলে, সুতরাং সেই ফাডাইয়া দেয়া হুজুর রাতভর নারীর দেহের রগরগে বর্ণনা দিয়ে ‘ফাডাইয়া দেয়’। আর আছে নানা অঙ্গভঙ্গি করে রসিকতা। ওয়াজের ভাবগাম্ভীর্য এখন অধিকাংশ ওয়াজেই আর পাওয়া যায় না।
টিকটক-লাইকির যুগে ভিডিও কনটেন্ট তুমুল গতিতে বাড়তে থাকবে। কিন্তু এই কনটেন্টে সবাই গা ভাসিয়ে দেয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না। ‘গরীব মানুষ স্টার হয়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্তের জ্বলে’-বিষয়টা এমন সরলীকরণ করাও যাবে না। নোলক বাবু-সালমা নামের লোকগানের শিল্পীরা কিন্তু গরীব মানুষই ছিল, তাঁদেরকে স্থান করে দিতে কিন্তু কেউ আপত্তি করে নি।
শিল্পের, সংস্কৃতি চর্চার একটা দায় হচ্ছে জনমানুষের বোধকে উন্নততর করা। সেই চেষ্টা বাদ দিয়ে আমাদের সিনেমা-নাটক-যাত্রা থেকে শুরু করে অনলাইন কনটেন্ট যদি শুধু জনমানুষের স্থূলরুচিতেই খাদ্য যোগান দেই, তাহলে শেষ পর্যন্ত ভালো কিছু আসবে না।
জনপ্রিয়তার আকাঙ্ক্ষা একটি ভয়াবহ রাক্ষস, যাকে প্রতিদিন একটি করে মানুষ যোগান দেয়া লাগে।
এভাবে দিতে দিতে একদিন আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না, তখন আমাদের ঘর থেকেই কাউকে সেই দৈত্যের গুহায় যোগান দিতে হবে কী না সেই প্রশ্ন লিখে রেখে গেলাম।
আরিফ জেবতিক : লেখক, সাংবাদিক।