কক্সবাজারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) একটি গোপন তদন্ত প্রতিবেদনে স্থানীয় পুলিশের বিরুদ্ধে সন্দেহভাজন অপরাধীদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, “হত্যার প্রতিযোগিতা[য়]” লিপ্ত থাকা পুলিশ একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যায়ও দ্বিধা করেনি।
ওই গোপনীয় প্রতিবেদনটির একটি কপি ও প্রতিবেদনের সাথে সংযুক্ত ছবি ও ভিডিও ক্লিপ নেত্র নিউজের হাতে এসেছে। জনগুরুত্ব বিবেচনায় আমরা প্রতিবেদনটি রিডাক্টেড আকারে (কিছু অংশ ঢেকে দেওয়া হয়েছে এমন) প্রকাশ করছি।
মেজর (অবঃ) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খাঁন নামক ওই কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনায় কক্সবাজার পুলিশ যেই বিবৃতি দিয়েছে, সেটির সঙ্গে ডিজিএফআইর করা মাঠ প্রতিবেদনটি সাংঘর্ষিক। পুলিশ দাবি করেছে, পুলিশের একটি বহর মেজর (অবঃ) সিনহার গাড়ি তল্লাশি করতে চাইলে তিনি নিজের ব্যক্তিগত অস্ত্র বের করেন। এ সময় আত্মরক্ষার জন্য পুলিশ গুলি করে।
তবে প্রত্যক্ষদর্শী ও ভিডিও ফুটেজের বরাত দিয়ে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, মেজর (অবঃ) সিনহা তার অস্ত্র বের করেননি। যখন তাকে গাড়ি থেকে বের হতে বলা হয়, তখন তিনি হাত উঁচু করে বের হন। এরপর কোনো বাতচিত ব্যতিরেকেই তাকে গুলি করে হত্যা করেন পুলিশবহর প্রধান এসআই লিয়াকত। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও ৪৫ মিনিট ধরে মেজর (অবঃ) সিনহাকে হাসপাতালে না নিয়ে ঘটনাস্থলেই ফেলে রাখে পুলিশ, “পুলিশ কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করে মৃত্যু নিশ্চিত করে মৃতদেহ হাসপাতালে আনা একটি পৈশাচিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ।”
প্রতিবেদনের “মন্তব্য” বিভাগে বলা হয় যে, টেকনাফ পুলিশের মধ্যে মাদক নির্মূলের নামে এক ধরণের “হত্যার প্রতিযোগিতা” বিদ্যমান। এতে বলা হয়, “[এই প্রতিযোগিতা] অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও আরও দিবে বলে ধারণা করা যায়।”
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের উপজেলা হিসেবে পরিচিত টেকনাফকে দেশে মাদক প্রবেশের সবচেয়ে বড় রুট বলেও বিবেচনা করা হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাদক নির্মূল অভিযানে সন্দেহভাজন অপরাধীদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে।
গোপন প্রতিবেদনে পুলিশের এমন প্রবণতার বিষয়ে ডিজিএফআই সমালোচনা করলেও, এই গোয়েন্দা সংস্থাটির বিরুদ্ধেও এই ধরণের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে টেকনাফ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর একরামুল হকের বহুল আলোচিত হত্যাকাণ্ডে ডিজিএফআই কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা আলোচিত হয়েছে।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি, অর্থাৎ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশজুড়ে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এরপর দুই-তিন মাসের মধ্যেই দেশজুড়ে ব্যাপক মাদক-বিরোধী অভিযানে দুই শতাধিক সন্দেহভাজন নিহত হন, আটক হন হাজার হাজার মানুষ। তখন অভিযোগ উঠেছিল, কেবল সাধারণ মাদক সন্দেহভাজনই নয়, সাধারণ নিরীহ মানুষ ও বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরাও এসব হত্যাকাণ্ড ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশ সরকারকে এ ধরণের হত্যাকাণ্ড বন্ধের আহ্বান জানালেও, সরকারের পক্ষ থেকে সবসময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। সরকার দাবি করেছে, কথিত “বন্দুকযুদ্ধে” আটককৃত সন্দেহভাজনের সঙ্গীরা অতর্কিতে হামলা করার পর, ওই হামলার জবাবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করলে আটককৃত সন্দেহভাজন ক্রসফায়ারে মারা যান।
কিন্তু মানবাধিকার সংস্থা ও সংবাদ মাধ্যমগুলো যা এতদিন ধরে বলে এসেছে, তাই দৃশ্যত নিশ্চিত করলো সরকারের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই।
একজন কর্নেল পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তার লেখা ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, “প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী নির্মূল করার প্রয়াসে” গাড়িতে মেজর (অবঃ) সিনহার একমাত্র সঙ্গী সিফাত, যাকে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের পর আটক করে নিয়ে যায়, তাকে “যে কোন সময়… অস্ত্র/মাদক উদ্ধার অভিযানের নামে হত্যা করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।”
“মাদক নির্মূল অভিযানের নাম করে [সচরাচর] হত্যা বন্ধ করার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা প্রদান করা[রও]” সুপারিশ করেছে ডিজিএফআই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির দেওয়া উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত কক্সবাজার উপজেলায় ২১৮টি বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে টেকনাফ উপজেলায় ঘটেছে ১৪৪টি “ক্রসফায়ার” ও “বন্দুকযুদ্ধে”র ঘটনা, যেখানে মারা গেছেন ২০৪ জন মানুষ।●