সুদূর অতীতে কোনো রকম মিনিট, সেকেন্ড বা ঘণ্টার কাঁটা ছাড়াই ঘড়ির প্রচলন ছিল, যার নাম সূর্য ঘড়ি। ধারণা করা হয়, মিসরীয়রাই প্রথম প্রকৃতি নির্ভর সূর্যঘড়ির প্রচলন করে।
ইউরোপীয়রা যান্ত্রিক ঘড়ির রূপ দেয় ১৪ শতাব্দীতে। তারপর ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হয় ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ডের কাঁটাযুক্ত ঘড়ির নানা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নকশা। ঘড়িতে যুক্ত হয় নানা ধরনের বৈচিত্র্য, তৈরি হয় ঘড়ি নিয়ে অনেক অজানা গল্পও। তেমনি এক বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘড়ি সংবলিত টাওয়ার নিয়ে আজকের আয়োজন।
সারা বিশ্বের সময় নির্ধারিত হয়ে থাকে গ্রিনিচ মান সময় অনুসরণে। তবে গ্রিনিচ মানের দিন এখন শেষ হয়ে আসছে বলা যায়। কারণ দিন এসেছে মক্কা মান সময়ের। পৃথিবীর সময় নির্ধারক ঘড়িকে অতিক্রম করার পার। মক্কায় অবস্থিত মক্কা ক্লক এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঘড়ি।
পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র স্থান মক্কা নগরী। এই মক্কা নগরীর কাবা শরীফের পাশে অবস্থিত ১৩০ তলা উঁচু রয়েল ক্লক টাওয়ার। এই রয়েল ক্লক টাওয়ার, যার আরবি নাম আবরাজ আল-বাইত। জানা যায়, এই ক্লক টাওয়ার তৈরি করতে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়েছে।
সুইস ও জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের ২৫০ জন বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে, ৩৬ হাজার টনের এই ঘড়িটি স্থাপন করতে সময় লেগেছে আট বছর। এতে বিভিন্ন রঙের যে লেখা দেখা যায় তা ১৪ হাজার গ্লাসের টুকরার সমন্বয়ে বসানো। যার প্রতিটি গ্লাসের ওজন ১৬ টন। মূল্যবান এই গ্লাসগুলো পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। এই গ্লাসগুলো দিনে ও রাতে আলাদা আলাদা রং ধারণ করে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ঘড়িটি তৈরি করা হয়েছে কার্বন ফাইবার দিয়ে। ঘড়ি ও টাওয়ারের নকশা করেছেন জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের স্থপতিরা। রাতের বেলা ঘড়িটি আলোকিত হয় সবুজ আলোয়। চতুর্মুখী ঘড়িটির চারপাশে অসাধারণ শৈল্পিক কারুকার্যে বড় মোজাইকের শিলালিপির ওপরে অলংকরণ করে আরবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘আল্লাহু আকবার’।
এই টাওয়ারের ভেতরে ১৫০ সৌদি রিয়াল দিয়ে টিকেট কেটে প্রবেশ করলে ঘড়ির যন্ত্রপাতিসহ, সব তথ্য জানা যাবে। এই ঘড়ির ভেতরে রয়েছে সুরম্য হোটেল। যেখানে একসঙ্গে অনেক লোক অবস্থান করতে পারে। এই ঘড়িটির মিনিটের কাঁটার দৈর্ঘ্য ২৩ মিটার। আর ঘণ্টার কাঁটার দৈর্ঘ্য ১৭ মিটার। ঘণ্টার কাঁটাটি একবার স্থানান্তর হলে যে, টিক শব্দটি হয় তার ওজন দাঁড়ায় ২১ টন।
ঘড়ির ওপরে স্বর্ণ দিয়ে নির্মিত আল হেলাল বা চাঁদের দৈর্ঘ্য ২৫১ মিটার। এর ভেতরে সুবিশাল কক্ষে একসঙ্গে অসংখ্য মানুষ নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এর চাঁদে রয়েছে টেলিস্কোপ সেন্টার। ঘড়িটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, বোবা বা কালা লোকজন যেন দূর থেকে ঘড়ির কাঁটা দেখে নামাজের সময় বুঝতে পারেন।
আর সেজন্য দিনে সাদা কালো আর রাতে সাদা সবুজ রং ধারণ করে এই ঘড়ি। এই ঘড়িটি দেখতে গিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন প্রবাসীরা। মক্কা নগরী পাহাড়ি এলাকা হওয়া সত্ত্বেও, নামাজের সময় প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূর থেকে এই ঘড়িটি দেখে হাজিরা বুঝতে পারেন পবিত্র কাবা শরীফের স্থান।
রাতে সাদা এবং সবুজ রং ধারণকৃত ঘড়ি থেকে ১০ কিলোমিটার উপরে আলো ছড়িয়ে পড়ে। চারদিকে ৪৩ মিটার দৈর্ঘ্য এই ঘড়িটি। মাটি থেকে ৬০০ মিটার উঁচুতে স্থাপন করা হয় এই ঘড়িটি। উঁচু হওয়ার ফলে রাতের বেলা ঘড়িটি ৩৩ কিলোমিটার দূর থেকে দেখা যায়। পাশাপাশি নামাজের জন্য ঘড়ি থেকে বের হওয়া অ্যালার্মের শব্দ শোনা যায় ১০ কিলোমিটার দূর থেকেও।
ঘড়ির উপরের অংশের ওজন ১২ হাজার টন। ৩৯ মিটার লম্বা সর্বশক্তিমান আল্লাহ শব্দের আলিফ অক্ষরটির উচ্চতা ২৩ মিটার। পুরো আল্লাহু আকবার শব্দটি ২১ হাজার রঙিন বাতি দিয়ে লেখা হয়েছে। আর লেখাগুলো পড়া যায় ৩০ কিলোমিটার দূর থেকে। অনেকে লন্ডনের বিগ বেনের বা এলিজাবেথ টাওয়ারে স্থাপিত ঘড়িকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঘড়ি মনে করে। তবে তার থেকে এই ঘড়িটি ছয়গুণ বড়।
এটি সৌদি আরবের বাদশা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল আজিজের আমলে তৈরি করা হয়েছে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই ঘড়িটি তৈরির কাজ শুরু হয় ২০০৪ সালে। আর শেষ হয় ২০১১ সালে। ২০১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় এই রয়াল ক্লক টাওয়ারের। এই ঘড়িটি ২০১২ সালে প্রথম স্থান দখল করে নেয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা হাজিদের মক্কা নগরী ও কাবাঘর চিহ্নিত এবং নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে এই ঘড়িটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে।
ঘড়িটির ওপরে রয়েছে ৯৩ মিটার দীর্ঘ অগ্রচূড়া এবং স্বর্ণালি মোজাইক ও ফাইবার গ্লাসের তৈরি ৩৫ টন ওজনের নতুন চাঁদ। টাওয়ারের নিচ থেকে ওপরে বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বহু লাউড স্পিকার স্থাপন করা হয়েছে, যা সাত থেকে ১০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত আজান ও নামাজের ধ্বনি প্রচার করতে পারে।
বিশাল এই ঘড়িটি নির্মাণ করতে গিয়ে বেশ কিছু বিতর্কেরও সূত্রপাত হয়েছিল সেই সময়। ১৮ শতকে নির্মিত অটোমান স্থাপনা আজিয়াদ দুর্গ ধ্বংস করা এই বিতর্কের অন্যতম কারণ। তবে সৌদি পরিকল্পনা অনুযায়ী, সম্পূর্ণ আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলা হবে পবিত্র নগরী মক্কাকে। দেশটি প্রতি বছর হজ এবং পর্যটন থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার আয় করে।
তাই ইসলামের জন্মভূমিকে আরো পর্যটনবান্ধব করে তোলার জন্য বর্তমানে সেখানে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক বিলাসবহুল সব স্থাপনা। ১৯৫০ সালের মক্কার ছবিতে দেখা যায়, খুবই সাধারণভাবে হজ পালন করতে আসছেন ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা। তবে এখন পবিত্র কাবাঘরকে ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল মসজিদ।
যদিও এরই মধ্যে ভেঙে ফেলতে হয়েছে প্রাচীন অনেক স্থাপনা। ২০৪০ সালের মধ্যে মক্কার আশেপাশের স্থানসমূহ আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সৌদি সরকার। এখন যেখানে ৩০ লাখ মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন, সেই জায়গায় ৭০ লাখ মানুষের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করা হবে সুদূর ভবিষ্যতে।