দুবাই: মধ্য যুগে এ্যরাবিয়ান গালফ জুড়ে হরমুজ রাজত্ব বিরাজমান ছিল ঠিক এমনটিই মত দিয়েছেন ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত ইদ্রিস মেয়ার্স। তিনি বলেন, ‘জার্মানির ভূত্বত্ত্ববিদগণ এখানে খনন করে প্রমাণ পেয়েছেন যে এই স্থানে অন্তত ৮০,০০০ মানুষের বসবাস ছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘১৪৫০ সালে অবধি টিকে থাকা এই রাজত্ব বর্তমানের লন্ডন বা প্যারিসের চাইতেও বড় ছিল।’ এসব কথা বলার সময় তার নীল চোখ জোড়া উত্তেজনায় ভরপুর হয়ে উঠে তার মতে, ’১৫ শতকে এ অঞ্চলে আহমাদ ইবনে মাজিদ নামে একজন বিখ্যাত মানচিত্র কর বসবাস করতেন।’
দুবাইয়ের আল ফাহাদি নামক ঐতিহাসিক জেলায় ‘Alserkal Cultural Foundation’ এর সন্নিকটে ইদ্রিস মেয়ার্সের ‘Muslim world’ নামের বইয়ের দোকানটি অবস্থিত। কিন্তু তার সাথে আলোচনা করার অর্থ হচ্ছে মুসলিম ইতিহাসের অনেক দিক উঠে আসা।
ইদ্রিস মেয়ার্স এমন একজন লোক যাকে আপনি বিরক্ত করতে দ্বিধা বোধ করবেন কারণ তার মুখ থেকে বের হওয়া প্রত্যেকটি বাক্য তার বলা পূর্ববর্তী বাক্যের চাইতে আকর্ষণীয়। হয়তবা বইয়ের সাথে জীবন কাটানোর ফলে এমনটি হয়েছে।
মেয়ার্স অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে অধ্যয়ন করেছেন এবং পরবর্তীতে তিনি পূর্ব এন্গালিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৬ সালে বইয়ের দোকান চালুর পূর্বে তিনি বেশ কয়েক বছর বই প্রকাশনার সাথে সংযুক্ত ছিলেন। তিনি যে কোনো তথ্য গভীর থেকে জানেন।
কিন্তু তার নিজের গল্প খুব বেশী অনন্য। তিনি ১৯৫১ সালে যুক্তরাজ্যের পূর্ব উপকূলবর্তী অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং ১৯৫৪ সালে তার পিতামাতার সাথে বাহরাইনে চলে আসেন। তার পিতা সেখানে একটি বৃহৎ তেল উৎপাদন কারী কোম্পানিতে চাকুরী করতেন এবং তারা কোম্পানির বিদেশী ক্যাম্পে বসবাস করতেন।
ইদ্রিস মেয়ার্স বলেন, ‘এটি অনেকটা সেনা বাহিনীর ক্যাম্পের মত দেয়াল দ্বারা আবৃত ছিল। আমি সেখানে যা দেখেছিলাম তা হচ্ছে, ইউরোপিয়ান এবং আমেরিকান বিশেষজ্ঞরা স্থানীয় লোকজনদের সাথে খুব বাজে আচরণ করত। স্থানীয়দের সম্পর্কে তারা খুব নিচু ধারণা পোষণ করতেন এবং ধরে নিতেন যে, তাদের কোনো যোগ্যতা নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমি চিন্তা করতাম কেন তারা নিজেদের কে নিয়ে এত বেশী গর্ববোধ করে? এমন করার তাদের কোনো অধিকার নেই। আর এভাবেই আমি আমার নিজের সমাজের প্রতি প্রশ্ন করতে থাকি?’
১৯৫৯ সালে মেয়ার্স কে যুক্তরাজ্যের শারোপশায়ার শহরের বোর্ডিং বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। সে সময়ের স্মৃতি তিনি ঠিক ভাবে মনে করতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘তখন খুব শীত পড়ছিল এবং আমরা প্রতিদিনকার রুটিন মাফিক মাঠে চলে যেতাম।’
তিনি বলেন, ‘আমি একসময় পালিয়ে যাই এবং পাঠাগারে গিয়ে লুকিয়ে পড়ি। পাঠাগারে একটি মাত্র কক্ষ ছিল এবং সেখানে তারা অনেক পুরনো বই রেখেছিল কিন্তু আমি মনে করেছিলাম এগুলো আসলেই আকর্ষণীয়।’
মেয়ার্সের নয় বছর বয়সের সময় তার ভাষায় তিনি স্কটিশ ইতিহাসের উপর একটি ‘চমৎকার’ বই অধ্যয়ন করেছিলেন।
সাহিত্যের প্রতি তার তীব্র আকর্ষণ এবং বিদ্যালয়ে তার চমৎকার ফলাফল থাকা স্বত্বেও তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সময় পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারেন নি এবং একসময় তিনি অক্সফোর্ড থেকে ড্রপ আউট হয়ে পড়েন ফলে তার পিতামাতা তার উপর মনঃক্ষুণ্ণ হন।
মেয়ার্স বলেন, ‘আমি সেখানে যে ধরণের জ্ঞান অধ্যয়ন করতাম তার প্রকৃতি সম্পর্কে আমি অনেক প্রশ্ন করতাম। আমি মনে করতাম যদি আমি এখানে থেকে যাই তবে আমি এখানকার অধ্যাপকদের মত শেষ হয়ে যাবো। বিশ্ববিদ্যালয় একটি কারখানা এবং অধ্যাপক গণ এই কারখানার পণ্য।’
মেয়ার্স ব্যাখ্যা করে বলেন, অধ্যাপক গণের মধ্যে সকল ধরণের জ্ঞানের সন্নিবেশ ছিল কিন্তু তাদের কারোরই প্রজ্ঞা ছিল না।
১৯৭২ সালে তিনি লন্ডনে চলে আসেন এবং সেখানে তিনি পরীক্ষামূলক ভাবে একটি থিয়েটার কোম্পানিতে যোগ দেন। আর সেখানে স্কটিশ অভিনেতা ইয়ান ডালাসের সান্নিধ্যে এসে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইয়ান ডালাস বা আবদাল কাদির আস-সুফি মেয়ার্সের সাথে সাক্ষাতের পাঁচ বছর পূর্বে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
ইয়ান ডালাস যুক্তরাজ্যে বসবাসরত মুসলিমদের একটি ছোট সংগঠনে যুক্ত ছিলেন এবং তিনি ‘The Book of Strangers’ নামে একটি বই লিখেছিলেন।
১৯৬০ এর দশকে মেয়ার্স একজন টিনেজার ছিলেন এবং তিনি তখন সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য সমূহের উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছিলেন ঠিক ওই সময়েই ইয়ান ডালাসের সাথে তার দেখা হওয়াটা একটি মোক্ষম সময় ছিল।
তিনি বলেন, ‘তিনি আমার নিকট জানতে চেয়েছিলেন যে, যখন তুমি মঞ্চে থাক তখন তোমার দিকে কারা তাকিয়ে থাকে? তখন হঠান করেই আমি নিজেকে মঞ্চের উপরে ভাবতে থাকি: আমি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকি এবং চিন্তা করতে থাকি যে, আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে এসব চোখ গুলো কার? আমি বুঝতে পারি এগুলো আমার পিতা এবং মাতার চোখ।’
ইয়ান ডালাস এর পরে মেয়ার্সের সামনে মদ পানের সংস্কৃতি সম্পর্কে তুলে ধরেন এবং তার সাথে সুষ্ঠ সমাজ বিনির্মাণ সম্পর্কে অনেক আলোচনা করতে থাকেন। একসময় মেয়ার্স বুঝতে পারেন যে, ডালাস তার মনের আকুতি ধরতে পেরেছেন।
এর কিছুদিন পর মেয়ার্স যুক্তরাজ্যের মুসলিমদের সংগঠন ‘British Muslims in London’ এর একটি সভায় যোগ দেন এবং তিনি যুক্তরাজ্যের প্রথম ইসলামিক প্রকাশনা সংস্থা ‘Diwan Press’ এর সাথে পরিচিত হন পরবর্তীতে তিনি এর পরিচালক হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘তখন আমার বয়স ছিল ২১ আর আমি যেকোনো কিছু ধারণ করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।’
পরে তিনি ‘National Muslim Education Council’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং ‘Association of Muslim Schools’ এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৬ সাল থেকে ৬৮ বছর বয়সী মেয়ার্স দুবাইতে বসবাস করা শুরু করেন। কিন্তু দুবাইতে আসার পূর্ব থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে তার গভীর সখ্যতা গড়ে উঠে। ১৯৭৯ সালে তিনি প্রথম বারের মত আবুধাবির শরিয়া জুডিশিয়াল বিভাগের প্রধান আল শেইখ আহমেদ আব্দুল আজিজ হামাদ আল মুবারাকের সাথে দেখা করতে আবুধাবি সফর করেন এবং তিনি শেইখ আহমেদ আব্দুল আজিজের অনুমতি নিয়ে ইসলামিক আইন বিজ্ঞানের একটি বই অনুবাদ করেন।
১৯৯৮ সালে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসে ‘Jumeirah Islamic Learning Centre’ একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন যার উদ্দেশ্য ছিল দেশটিতে আশা পর্যটকদের কে ইসলামি সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া।
সে বছর তিনি একই সাথে আবুধাবির আন্তর্জাতিক বই মেলায় অংশ গ্রহণ করেন এবং নিজের অনুদিত ইংরেজি কিছু বই বিক্রয় করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি তখন আবুধাবি তে আমার সাহিত্যের প্রথম পদ চিহ্ন এঁকে দিয়েছিলাম বর্তমানে যে স্থানটি সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্য দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে আছে।’
তার প্রতিষ্ঠিত বুক কাতার নামক বইয়ের দোকানে ইসলামিক বিশ্বের অনেক মূল্যবান বই দ্বারা সমৃদ্ধ। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ের অন্তত ৩,০০০ বই রয়েছে যেগুলো এসেছে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এসকল বইয়ের মধ্যে নবী মুহাম্মদ(সা:) এর জীবনী থেকে শুরু করে অতি দুর্লভ কিছু বই রয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে বুক কাতার নামক বইয়ের দোকান ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মেয়ার্স বলেন, ‘বৃহৎ ভাবে আমি মনে করি, লোকজন তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য আমার প্রতিষ্ঠিত বইয়ের দোকানের পক্ষ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ইসলাম শুধুমাত্র কিছু নিয়ম কানুনের সমষ্টি নয় বরং এটি হৃদয় শুদ্ধ করার এবং সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসা পাওয়ার ধর্ম।’
তিনি বলেন, ‘পবিত্র রমজান মাসের চাইতে এত বেশী ভালো সময় আর আসে না। এ সময় শারীরিক ও মানসিক ভাবে মানুষ অনন্য অধ্যাত্মিকতা লাভ করে। একই সাথে লোকজন সিয়াম সাধনা করে কারণ তারা সৃষ্টি কর্তাকে খুশি করতে চায় এবং ত্যাগ করার মাধ্যমে সৃষ্টি কর্তার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটায়। এটি অতি সাধারণ মানবিক গুণাবলী।’
সূত্র: thenational.ae