সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
১৯৭২ সালে ইতালো ক্যালভিনোর ইনভিজিব্ল সিটিজ বেরোলে পশ্চিমের নগর-পঠনের পালে নতুন হাওয়া লাগে। বইটি আমার হাতে আসে বছর দশক পরে, এবং ক্যালভিনোর পঞ্চান্নটি শহরের বর্ণনায় মানুষের কল্পনায়, স্মৃতিতে, স্মৃতিকাতরতায় লুকিয়ে থাকা যাপিত জীবনের, কিছুকালের পরিভ্রমণের অথবা শোনা গল্পের চেনা অথবা অচেনা শহর কীভাবে সপ্রাণ একটি উপস্থিতি হয়ে উঠতে পারে, মুগ্ধ হয়ে তা দেখেছি। তাতার সম্রাট কুবলাই খানের সঙ্গে পরিব্রাজক মার্কো পোলোর কথোপকথনে বর্ণিত এই শহরগুলো মার্কোর প্রিয় শহর ভেনিসেরই পঞ্চান্নটি অবতার। প্রতিটি শহরের নাম একটি মেয়ের নামে—অক্তাভিয়া, যে শহরটি মাকড়সা-জালের; ইউসাপিয়া, যে শহর হাসি-আনন্দে জীবনের কষ্ট ভুলিয়ে রাখে; অথবা অলিন্দা, যে শহরটিকে খুঁজে নিতে হয় একটি আতশ কাচে চোখ রেখে। শহরগুলোকে মার্কো ভাগ করেছেন কয়েকটি বর্গে। প্রতিটি বর্গের নাম দিয়েছেন শহরগুলোর আদি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলিয়ে, যেমন শহর ও স্মৃতি, শহর ও চিহ্ন, শহর ও বাসনা: অথবা চিকন শহর, সওদাগরি শহর, বা লুকিয়ে থাকা শহর। মার্কোর সব গল্পে কুবলাইয়ের বিশ্বাস নেই, কিন্তু তাঁকে শুনে যেতে হয়, কারণ তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যাখ্যাতীত শূন্যতায় মোড়া জীবন সায়াহ্নে, যখন তাঁর রাজ্যপাট, তাঁর শিরোস্ত্রাণ আর রাজদণ্ড তাঁকে জানায় বিদায়, দিন আর নেই, সব মিলিয়ে যাবে। শুধু মার্কোর গল্পে কুবলাই কিছুটা স্বস্তি পান, কারণ শিগগিরই ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়ার দণ্ড মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেয়াল আর মিনারের বর্ণনায় তিনি এমন কিছু দৃশ্য আবিষ্কার করেন, যেগুলো ক্ষয়ের, ঘুণপোকার স্পর্শ বাঁচিয়ে চলে। কুবলাই অমরত্ব চেয়েছিলেন, সেই অমরত্ব ইট-পাথরে নেই, সোনা-রুপাতেও নেই, তা তিনি হয়তো পান মার্কো পলোর দৃশ্যকল্পে, যারা সময়ের ও পরিসরের সীমানা ছাড়িয়ে অনন্তের দিকে যায়। একদিকে অবিশ্বাস, অন্যদিকে আশ্বাস—এ দুই অবস্থানের মাঝখানে মার্কোর গল্পগুলো নিজেদের মেলে ধরে।
শহর তো শুধু কয়েক বর্গমাইল জমি নয়, রাস্তাঘাট, ল্যাম্পপোস্ট, দালান, বাজার, চাতাল, চত্বর নয়, শহর অসংখ্য চিহ্নও—কষ্টও, গান অথবা গল্পও। শহরও যন্ত্র সমার্থক, অথচ শহরে মন ক্ষণে ক্ষণে উড়াল দেয়। শহরে রাত নামে, ভোর হয়, দিনের আলোয় ব্যস্ততা বাড়ে, ব্যবসা হয়, মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে অথবা হাসতে হাসতে তারা ব্যাংকে যায়। শহরে লেপ্টে থাকে ক্ষমতা আর অসহায়বোধ, বিত্ত আর নিঃস্বতা, জীবনের উদ্যাপন আর মৃত্যুর আলিঙ্গন। শহরে ঋতু আসে–যায়; রোদে পুড়ে বা বৃষ্টিতে ভিজে মানুষ ঘরে ফেরে; মানুষ বদলায় অথবা বদলায় না; মানুষের বিকার-বিক্ষোভ-বিবমিষা অথবা আনন্দ-পুলক জাগে। এ সবই কি শহরের মুখ, নাকি তারা মুখোশ?
স্মৃতির শহরে স্থিরতা, ঋজুতা নেই, সময় ঘড়ির কাঁটা থেকে ছুটি নেয়। স্মৃতির শহরে দিন-তারিখ, জন্মসনদ অথবা বুড়ো আঙুলের ছাপ কোনো বৈধতা পায় না। সেই শহরের ল্যাম্পপোস্ট রাত নামলে হাঁটতে বেরোয়, গাছ উড়াল দেয়, কবর থেকে মৃতেরা উঠে এসে দরজার কড়া নাড়ে, আকাশ থেকে পরিরা নেমে এসে চোখে ঘুম আনে। মার্ক শাগালের ছবির মতো, গার্সিয়া মার্কেসের মাকোন্ডোর মতো স্মৃতির শহর জাদুময়। স্মৃতির শহর শেষ পর্যন্ত একটি থাকে না, মার্কোর ভেনিসের মতো অনেক হয়ে দাঁড়ায়।
ভেনিসে চলছে শিল্পকলার বিশাল উৎসব, দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনী। সেখানে বাংলাদেশেরও প্রতিনিধিত্ব আছে। বহুদিন থেকে ইচ্ছা, ভেনিসে যাব। শহরটির সঙ্গে যে শুধু শিল্পকলা বা শেক্সপিয়ারের নাটকের সংযুক্তি, তা নয়, আছে পশ্চিমা রেনেসাঁসের, মসলা-রেশমি বস্ত্রের বাণিজ্যের, ক্ষমতার, বন্যা ও জলশাসন আর মার্কো পোলো অথবা কাসানোভার জড়িয়ে থাকার ইতিহাস। এ বছর মে মাসে যাওয়ার সুযোগ হলো, কিন্তু মাত্র কয়েক দিনের জন্য। ভেনিসে হাঁটতে হয়—শুধু পশ্চিমা ফ্ল্যানুর মতো উদ্দেশ্যহীন হাঁটা নয়, বরং নিশি পাওয়া মানুষের মতো হাঁটা। কত মাইল যে হাঁটলাম শহরটিতে, নৌকায় কত খাল ঘুরে ল্যাগুনে সময় কাটিয়ে এ শহরের ১১৭ দ্বীপের অনেক দ্বীপের পাশ দিয়ে, বুড়ি ছুঁয়ে গেলাম, হিসাব নেই। দেড় হাজার বছরের সারা শরীরজুড়ে ইতিহাস, যেদিকে তাকাই স্থাপত্য আর নির্মাণকলার আঁকিবুঁকি। সারা দিন শেষে সন্ধ্যা নামলে মার্কোর গল্পে কান পাতলাম, কুবলাইয়ের মতো অনুভব করলাম, পঞ্চান্নটি শহরই আছে ভেনিসের ভাঁজে ভাঁজে, এবং সবগুলো শহর মিলে যে বাস্তুকলা, যে স্বপ্ন-কামনা, সূক্ষ্মতা-স্থিতিস্থাপকতার চিত্রকলার জন্ম দেয়, তাতে মানবসৃষ্ট অমরতা খুঁজে নিতে পারে, মানব নিজেও।
একটা নৌকায় গা এলিয়ে সেন্ট-মার্কোর গির্জা থেকে ভেসে আসা ঘণ্টাধ্বনি শুনতে মনে হলো, স্মৃতির শহরগুলো এ রকমই হয়, অনেকটা ছেলেবেলার শরতে রৌদ্রছায়ার মিলিমিলিতে ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলানো মাঠ-প্রান্তরের মতো। সন্ধ্যার অন্ধকার যখন ল্যাগুনের ওপর বিছিয়ে যাচ্ছে, দেখলাম সেন্ট মার্কোর উঁচু মিনারটি ল্যাগুনের জলে একটা নৌকার রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আমার মনে পড়ল, আমার শৈশব-কৈশোরের শহর সিলেটের সুরমা নদীতে এভাবে আলী আমজাদের ঘড়িঘরের ছায়া দেখেছিলাম এক সন্ধ্যায় কিনব্রিজে দাঁড়িয়ে, মনে হয়েছিল অনেক দিন ডুবে থাকা এক স্টিমার যেন ভেসে উঠছে, যাতে চড়ে অলীক কোনো দিগন্তে চলে যাওয়া যাবে।
আমার শহরটাও, যার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি ১৮ বছর বয়সে, আসলে পঞ্চান্নটি শহর। এই শহর নিয়েও আমি লিখতে পারি। এই শহরের অলিগলিকে আমি চিনতাম আমার করতলের রেখার মতো, অথচ এখন গেলে কত অজানা মনে হয় তাদের। স্মৃতি খুঁড়ে কি ওই পথগুলো তুলে আনা যায় না? সেসব মানুষকে আমার কৈশোরে প্রকাণ্ড মনে হতো, নানা কারণে কেউ কেউ তো ছিলেন নায়ক—তাঁদের কি জাগাতে পারি না, মৃত্যুর ওপার থেকে হলেও? কত ঘটনা ভিড় করে আছে স্মৃতির ক্যানভাসে, তাদের কি নতুন করে সাজানো যায় না?
আরেকবার কি আমি ফ্ল্যানু হতে পারি, পথ হাঁটতে পারি আমার স্মৃতির শহরে?
কেন নয়!